আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা মুঘল সম্রাট শাহজাহানের জীবনী নিয়ে আলোচনা করবো। মুঘল সম্রাট শাহজাহান 1628 থেকে 1658 সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।
বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভগুলির মধ্যে একটি তাজমহল নির্মাতা শাহজাহানের জন্ম 1592 সালে বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে।
তিনি ছিলেন তিমুরিদ রাজবংশের পঞ্চম তম মুঘল সম্রাট। নিচে সম্রাট শাহ জাহানের ব্যপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের জীবনী | Biography of Shah Jahan in Bengali
নাম | শাহজাহান |
সিংহাসন আরোহন | 8 ফেব্রুয়ারী 1628 সাল |
বংশ | তিমুরিদ রাজবংশ |
জন্ম | 1592 সালে |
জন্মস্থান | বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে |
পিতার নাম | জাহাঙ্গীর (নুরউদ্দিন মুহাম্মদ সেলিম) |
মায়ের নাম | জগৎ গোসাইন |
ছেলের নাম | আওরঙ্গজেব |
মেয়ের নাম | জাহানারা বেগম, রওশনারা বেগম, বেগম সাহেবা প্রমুখ |
স্ত্রী | মমতাজ মহল, কান্দাহারী বেগম, আকবরবাদী মহল, ফতেপুরী মহল, সিরহিন্দি বেগম ও লাল কুনওয়ার। |
রাজত্বকাল কাল | 8 ফেব্রুয়ারি 1628 – 31 জানুয়ারী 1658 |
রাজধানী | আগ্রা (1628-1638), দিল্লি (1638-1658) |
উল্লেখযোগ্য অবদান | তাজমহল নির্মাণ |
মৃত্যু | 22 জানুয়ারী 1666 খিষ্টাব্দে আগ্রা ফোর্টতে |
সমাধিস্থল | আগ্রার তাজমহল |
শাহজাহানের সিংহাসন আরোহণ
১৬১৭ খ্রীষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হইলে শাহজাহান উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে জয়ী হইয়া সিংহাসন দাবী করিতে পারে এরূপ সকলকে ধরাপৃষ্ঠ হইতে নিশ্চিহ্ন করিয়া ১৬২৮ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তাঁহার দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর রাজত্বকাল ভারত ইতিহাসে নানা দিক দিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এই সময় মোগল সাম্রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হইয়াছিল। “Shahjahan’s reign marks the climax of the Mughal dynasty and empire.”-Dr. Smith.
শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি (His Deccan Policy):
দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি
সিংহাসনে আরোহণের দুই বৎসরের মধ্যেই শাহজাহান সমস্ত বিদ্রোহ-প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিয়া সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক হইলেন, এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করিলেন।
প্রথমেই তিনি দৃষ্টি দিলেন দাক্ষিণাত্যের দিকে। পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটগণের আরব্ধ কার্য সম্পন্ন করিবার জন্য তিনি ১৬৩০ খ্রীষ্টাব্দে এক বিরাট বাহিনী আহম্মদনগরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।
দাক্ষিণাত্য জয়ের প্রেরণা ও উদ্দেশ্য
এই অভিযান প্রেরণে আকবর ও জাহাঙ্গীরের ন্যায় তিনি যে কেবলমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা প্রণোদিত হইয়াছিলেন তাহা নহে।
তিনি ছিলেন গোঁড়া সুন্নী মুসলমান এবং দাক্ষিণাত্যের সুলতানগণ ছিলেন সিয়া । এই সিয়া সম্প্রদায়ের আধিপত্য ধ্বংস করিবার ধর্মনৈতিক উদ্দেশ্যও তাঁহাকে প্রেরণা দিয়াছিল ।
আহম্মদনগর আক্রমণ
১৬৩০ খ্রীষ্টাব্দে মোগল বাহিনী আহম্মদনগর রাজ্য আক্রমণ করিয়া বিশেষ কৃতকার্য হইতে পারিল না। অতঃপর মোগল সেনাপতি ষড়যন্ত্রমূলক পন্থা অবলম্বন করেন। আহম্মদনগরের অভ্যন্তরে তখন সুলতানের সহিত মন্ত্রী ফতে খাঁর বিবাদ চলিতেছিল ।
ফতে খার সহিত মোগল সেনাপতির গোপন সম্পর্ক স্থাপিত হইল। মোগল শক্তির সমর্থনে ফতে খাঁ স্থলতানকে সিংহাসনচ্যুত ও হত্যা করাইয়া নাবালক হুসেন শাহ্ কে সিংহাসনে বসাইলেন, এবং নিজেই সর্বেসর্বা হইয়া উঠিলেন ।
আভ্যন্তরীণ অবস্থা দৌলতাবাদ অবরোধ
অতঃপর তিনি মোগলদের সহিত অনুষ্ঠিত গোপন সর্তাদি পালনে অস্বীকৃত হইলে মোগল বাহিনী দৌলতাবাদ অবরোধ করিল। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক ফতে খাঁ প্রচুর উৎকোচ গ্রহণ করিয়া মোগল বাহিনীর নিকট দুর্গটি সমর্পণ করিলেন।
আহম্মদ নগর রাজ্যের অস্তিত্ব বিলুপ্ত
ইহার পর আহম্মদনগরের প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল হইয়া পড়ে এবং ১৬৩৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে আহম্মদনগর রাজ্যটির অধিকাংশই মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়। ইহার পর সমগ্র রাজ্যটি শাহজাহান ও বিজাপুরের সুলতানের মধ্যে বণ্টন করিয়া লওয়া হইল ।
গোলকুণ্ডার বখতা বিজাপুর আক্রান্ত
১৬৩৬ খ্রীষ্টাব্দে আহম্মদনগর জয় সম্পূর্ণ হইবার পর, শাহজাহান গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। গোলকুণ্ডার সুলতান ভীত হইয়া শাহজাহানের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করিয়া লইলেন এবং বাৎসরিক করদানে স্বীকৃত হইলেন।
কিন্তু বিজাপুরের সুলতান অস্বীকৃত হওয়ায় মোগল বাহিনী বিজাপুর রাজ্য আক্রমণ করিল। অবশেষে বিজাপুরের সুলতানও মাথা নত করিতে বাধ্য হইলেন।
তিনি প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হইয়া বাৎসরিক উপঢৌকন পাঠাইতেও প্রতিশ্রুত হইলেন। তিনি অবশ্য আহম্মদনগর রাজ্যটির একটি অংশ লাভ করিলেন ।
ঔরঙ্গজেব শাসনকর্তা নানারূপ সংস্কার
অতঃপর শাহজাহান দাক্ষিণাত্যের প্রদেশগুলির জন্য ঔরঙ্গজেবকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করিলেন। ঔরঙ্গজেবও দক্ষিণ ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি অনুসরণ করিয়া নাসিকের নিকটে বাগলোনা নামক স্থানটি সাম্রাজ্যভুক্ত করিয়া লইলেন।
ঔরঙ্গজেব যখন ১৬৫৩ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয়বার দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন, তখন তিনি রাজস্ব ও কৃষি বিষয়ক নানা সংস্কার সাধন করিয়া দাক্ষিণাত্যের আর্থিক উন্নতি সাধন করিলেন।
গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর সম্বন্ধে নীতি
এইরূপভাবে মোগল শক্তি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়া আরও শক্তিশালী হইয়া উঠিলে ঔরঙ্গজেব আবার গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন ।
ঔরঙ্গজেবের উদ্দেশ্য
সাম্রাজ্য বিস্তার ও ঐশ্বর্যের প্রতি লোভ ছাড়া, গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের সিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত সুলতানগণকে দমন করাও ছিল পরধর্মদ্বেষী ঔরঙ্গজেবের আন্তরিক ইচ্ছা । সুতরাং অজুহাতের অভাব হইল না; ঔরঙ্গজেব ১৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দে গোলকুণ্ডা আক্রমণ করিয়া রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হইলেন।
গোলকুণ্ডা আক্রমণ ও সন্ধি
কিন্তু শাহজাহানের পরামর্শে তাঁহাকে গোলকুণ্ডা সুলতানের সন্ধি প্রস্তাব গ্রহণ করিতে হইল; ক্ষতি পুরণ হিসাবে প্রচুর অর্থ এবং একটি জেলা গ্রহণ করিয়া ঔরঙ্গজেব যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হইলেন; অতঃপর ঔরঙ্গজেব কিছুটা আভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ গ্রহণ করিয়া বিজাপুর রাজ্যটি আক্রমণ করিলেন।
বিজাপুর আক্রমণ ও সন্ধি
এখানেও যখন বিজাপুর বাহিনী বিধ্বস্ত হইয়া যাইতেছিল, তখন শাহজাহানের নির্দেশে তাঁহাকে যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হইতে হইল। বিজাপুরের সুলতান বিদর, কল্যাণী, পরীন্দা ও আরও কয়েকটি স্থান মোগলদের সমর্পণ করিয়া এবং প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে স্বীকৃত হইয়া সন্ধি করিতে বাধ্য হইলেন ৷
দাক্ষিণাত্য নীতির ত্রুটি-বাচ্যুতি
শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায় যে কোনরূপ যুক্তি বা নীতি দ্বারা এই অভিযানগুলি সমর্থন করা যায় না। ধনরত্নের লোভ, পররাজ্য গ্রাস ও পরধর্ম-অসহিষ্ণুতাই ছিল এই সমস্ত আক্রমণের একমাত্র যুক্তি।
মোগল সাম্রাজ্যের প্রয়োজনের দিক দিয়া এই সকল স্থানের কোন প্রয়োজন ছিল না। শাসনকার্যের দিক দিয়া এই সকল স্থান বরং অসুবিধাজনকই ছিল। তাহা- ছাড়া, যুদ্ধের যখন একবার সূত্রপাত করা হইল তখন বিজয়ের মূহুর্তে ঔরঙ্গজেবকে নিরস্ত করারও বিশেষ কোন যুক্তি ছিল না। কারণ ভবিষ্যতে এই রাজ্য দুইটি সাম্রাজ্যভুক্ত করার নীতি ঔরঙ্গজেবকে আরও দৃঢ়তার সহিত অবলম্বন করিতে দেখা গিয়াছিল।
সর্বশেষে একথা উল্লেখযোগ্য যে শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি কিছুটা সাফল্য লাভ কৰিলেও অনেকের মতে ভবিষ্যতে উহা মারাঠা শক্তি উত্থানের পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছিল ।
🔥আরও পড়ুনঃ-
শাহজাহানের যুদ্ধ বিগ্ৰহ (Other Adventures):
পর্তুগীজ শক্তি বিধ্বস্ত
বাংলাদেশে পর্তুগীজদের জলদস্যুতা, ক্রীতদাস ব্যবসা, বলপূর্বক খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা প্রভৃতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইলে শাহজাহানের নির্দেশে বাংলার শাসনকর্তা কাশিম খাঁ ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে হুগলীর পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন, এবং পর্তুগীজ শক্তি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করেন; অতঃপর আসামের অহোমগণও পরাজিত হয়।
কান্দাহার জয় পরিণামে ব্যর্থতা
সম্রাট শাহজাহান কান্দাহার পুনরুদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হন। কুটকৌশলের সাহায্যে তিনি ১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে কান্দাহার জয় করিতে সমর্থ হন। কিন্তু দশ বৎসর পর পারস্যরাজ উহা অবরোধ করিলে মোগল বাহিনী কান্দাহার রক্ষা করিতে পারে নাই, উহা পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়।
ইহার পর কয়েকটি অভিযান পর পর প্রেরণ করিয়াও শাহজাহান কান্দাহার পুনরুদ্ধার করিতে সক্ষম হন নাই। পারস্য বাহিনী মোগল সীমান্তে একটি বিপদের কারণ হইয়া রহিল ৷
মধ্য-এশিয়া সম্বন্ধে নীতি
মধ্য এশিয়ার বখ্, ও বদাখশান্ নামক স্থান দুইটি ছিল মোগল সম্রাটের পূর্বপুরুষগণের বাসভূমি। তৈমুর বংশীয় মোগল সম্রাটগণ স্বভাবতঃই ঐ স্থানগুলি জয় করিবার স্বপ্ন দেখিতেন।
আভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ গ্রহণ করিয়া শাহজাহান ১৬৪৬ খ্রীষ্টাব্দে এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করিলেন এবং বল্থ্ ও বদাখশান দখল করিলেন।
কিন্তু উজবেগদের প্রচণ্ড বিরোধিতার ফলে ঐ স্থান দুইটি মোগল বাহিনীর অধিকারে রাখা সম্ভব হইল না; বহু ক্ষতি স্বীকার করিয়া মোগল বাহিনীকে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করিতে হইল, শাহজাহানের মধ্য- এশিয়া সংক্রান্ত নীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল ।
ইহার পর ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দ হইতে তাঁহার পুত্রদের মধ্যে আত্মকলহ ও অবশেষে ঔরঙ্গজেবের জয় সূচিত হইলে তাঁহার সক্রিয় শাসনের অবসান হয়। দীর্ঘ আট বৎসর বন্দী অবস্থায় কাটাইয়া ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হয় ৷
শিল্পকলার উৎকর্ষ (Art and Architecture):
শাহজাহানের আড়ম্বর প্রিয়তা (শিল্পকলার উন্নতি)
টেভার্নিয়ে (Tavernier), বার্ণিয়ে (Bernier), মানুচি (Manucci) প্রভৃতি সমসাময়িক পর্যটকগণ শাহজাহানের আড়ম্বর প্রিয়তার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন।
তিনি আড়ম্বর প্রিয় ছিলেন সত্য, কিন্তু তিনি স্থাপত্য ও শিল্পকলারও পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বরং একথা বলিলে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না যে তাঁহারই আমলে মোগল স্থাপত্য ও শিল্পকলার চরম বিস্ময়কর প্রকাশ ঘটিয়াছিল ।
স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষ
পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটগণের আমলে নির্মিত সৌধগুলিতে লাল প্রস্তর ব্যবহৃত হইত। কিন্তু শাহজাহানের আমলে সর্বত্র মর্মর প্রস্তর ব্যবহৃত হয় । পূর্বে স্থাপত্য শিল্পে হিন্দু-মুসলমানের রীতির সমন্বয় ঘটিয়াছিল; কিন্তু শাহজাহানের আমলে নির্মিত সৌধগুলিতে ইন্দো-পারসিক রীতির ছাপ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয় ।
তাজমহল ময়ূর সিংহাসন
শাহজাহানের স্থাপত্য সৃষ্টির অপূর্ব কীর্তি হইল তাজমহল। বহু অর্থব্যয়ে এবং বহুদেশী ও বিদেশী শিল্পীর সমবেত প্রচেষ্টায় স্থাপত্য শিল্পের এই অপূর্ব নিদর্শনটি নির্মিত হয়। মনি-মুক্তাখচিত বিশ্ববিখ্যাত ময়ূর সিংহাসনটি তাঁহার শিল্পানুরাগের এক অপূর্ব নিদর্শন।
স্থাপত্য শিল্পের অন্যান্য নিদর্শন
শিল্পী বেবাদল খাঁর তত্ত্বাবধানে আর্টকোটি টাকা ব্যয়ে এই সিংহাসনটি নির্মিত হইয়াছিল। ইহা তাঁহার আড়ম্বর প্রিয়তারও একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই সময়ে দিল্লী, আগ্রা, লাহোর, কাবুল, কাশ্মীর প্রভৃতি স্থানে বহু সুরম্য প্রাসাদ, দুর্গ ও মসজিদ নির্মিত হইয়াছিল।
দিল্লীর উপকণ্ঠকে নূতন করিয়া গড়িয়া শাহজাহান উহার নাম রাখিলেন ‘শাহজাহানাবাদ’। শাহজাহানাবাদের দেওরানই-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, জাম-ই-মসজিদ এবং আগ্রার মতি মসজিদ সমস্তই স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন ।
চিত্র শিল্পরীতির নূতন ধারা
শাহজাহানের সময়ে চিত্র শিল্পেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়। এই সময় হইতেই হিন্দু-চিত্র-শিল্পরীতি ও ইউরোপীয় চিত্র-শিল্পরীতির সংমিশ্রণে এক নূতন শিল্পরীতির প্রচলন হয়।
স্বল্প রং-এর ব্যবহার ও হাতের অবিচল নিষ্ঠা এই সময়কার চিত্রশিল্পের বৈশিষ্ট্য হইয়া উঠিয়াছিল; ইহার ফলে চিত্রগুলিও জীবন্ত হইয়া উঠিত। এই যুগের শ্রেষ্ঠ শিল্পী নাদির সমরকন্দি শাহজাহানের রাজসভা অলঙ্কৃত করিতেন।
সাহিত্য ও সাহিত্যিক
সাহিত্যের প্রতিও শাহজাহানের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। তিনি নিজে ছিলেন বিজ্ঞান ও বিদ্যোৎসাহী। আরবী, ফার্সী ও হিন্দী ভাষায় তাঁহার যথেষ্ট দখল ছিল।
শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি অনেক বিদ্যালয় নির্মাণ করাইয়াছিলেন; ইহাদের মধ্যে দার- উল-বাকী ও দিল্লীর রাজ কলেজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মৌলনা মুহির আলী সৈয়াদী, আবদুল হাকিম নিরালকোটি, মীর আবদুল কাশিম প্রভৃতি সাহিত্যিক ও কবি তাঁহার রাজসভা অলঙ্কৃত করিতেন।
এই সময়েই আবদুল হামিদ লাহোরী তাঁহার বিখ্যাত ইতিহাস-সাহিত্য ‘বাদশাইনামা’ রচনা করিয়াছিলেন। এই একই সময়ে কাকী খাঁ তাঁহার ‘মুস্তাখাব-উল-লুবাব’ গ্রন্থখানিও রচনা করিয়াছিলেন। শাহজাহানের আমলে তুলসীদাস, বিহারীলাল, প্রমুখ হিন্দী কবিদেরও উদ্ভব হইয়াছিল ।
শাহজাহানের রাজত্বকালের গুরুত্ব ও তাঁহার কৃতিত্ব (Importance and Estimate):
শাহজাহানের চরিত্র
শাহজাহানের চরিত্র বিশ্লেষণ করিতে যাইয়া ঐতিহাসিকগণ একমত হইতে পারেন নাই। অনেক ইউরোপীয় পর্যটক ও ঐতিহাসিক তাঁহাকে নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী বা বর্ণনা করিয়াছেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে তিনি সিংহাসন লাভের জন্য এবং নূরজাহানের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিবার জন্ম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তিনি ধর্মের ক্ষেত্রেও সময় সময় নৃশংসতার পরিচয় দিয়াছেন।
কিন্তু সমসাময়িক যুগের যারা বিচার করিলে এ সমস্ত মোটেই অস্বাভাবিক বলিয়া মনে হইবে না। *If we take into consideration the times in which he (Shahjahan) was living, we lose half our rage in the pressure of circumstances that drove him to such a ghastly step.”-Dow
বহু বিরুদ্ধ গুণের সমাবেশ
এ কথা সত্য যে তিনি কিছুটা বিলাসপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও কর্মপ্রচেষ্টা, উত্তম, বুদ্ধিমত্তা ও স্নেহপ্রবণতা প্রভৃতি বহু গুণের সমাবেশ তাঁহার চরিত্রে দেখা গিয়াছিল। শিল্প ও সাহিত্যেও তিনি অনুরাগী ছিলেন। ধর্ম সম্বন্ধে তাঁহার চরিত্রে একদিকে আকবরের উদারতা, অপরদিকে ঔরঙ্গজেবের সংকীর্ণতা উভয়েরই আভাষ পাওয়া যায়।
সাম্রাজ্য বিস্তার
তিনি মধ্য-এশিয়া জয়ের ব্যর্থ-প্রচেষ্টা করিয়াছিলেন এবং কান্দাহার রক্ষা করিতে পারেন নাই সত্য, কিন্তু দাক্ষিণাত্যে তিনি মোগল সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হইয়াছিলেন। সুলতানি রাজ্যগুলিকে পদানত করিতে তিনি সমর্থ হইয়াছিলেন।
তিনি পর্তুগীজদের ঔদ্ধত্য দমন করিয়া- ছিলেন এবং আসামের অহোমদিগকে পরাজিত করিয়া কামরূপের পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্য বিস্তৃত করিয়াছিলেন।
শাসনকার্যে দক্ষতা
এই বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় শাহজাহান যে দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন তাহা দেশী ও বিদেশী সকল ঐতিহাসিকগণেরই প্রশংসা অর্জন করিয়াছে।
তাঁহার রাজত্বকালে কোন বহিঃশত্রুর আক্রমণ বা আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও শান্তি ভঙ্গ করে নাই। বরং দয়া-দাক্ষিণ্য ও জনকল্যাণ মূলক কার্যাবলীর জন্য তাঁহার শাসনব্যবস্থা জনপ্রিয় ছিল।
শিল্পকলারও এক অপূর্ব বিকাশ হইয়াছিল। “Although Akbar was conqueror and a law-giver yet for order, arrangement of territory and finances and the good administration of every department of the state, no prince ever reigned in India that could be compared to Shahjahan.”-Kaffikhan.
বিদেশী পর্যটকগণের অভিমত
লেনপুল (Lanepoole), হান্টার (Hunter) প্রভৃতি ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ এবং ইতালীয় পর্যটক মানুচি (Manucci) সকলেই তাঁহার শাসন ও বিচার ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন । “Shahjahan ruled not as a king over his subjects but rather as a father over his family and children.”-Tavernier.
এই জন্যই ডক্টর স্মিথ বলিয়াছেন যে শাহজাহানের রাজত্বকালেই মোগল সাম্রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করিয়াছিল।
সাম্রাজ্যের দুর্বলতা
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে শাহজাহানের রাজত্বকালই মোগল সাম্রাজ্যের চরম গৌরবের যুগ। কিন্তু সমস্ত গৌরবচ্ছটার অন্তরালে এই সময়েই কাল মেঘও ঘনীভূত হইয়া আসিতেছিল। এই কাল মেঘই শেষ পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটাইয়া ছিল। সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ এই মেঘকে লক্ষ্য করিতে পারেন নাই ৷
সাম্রাজ্য পতনের বীজ অঙ্কুরিত
প্রথমতঃ, মধ্য-এশিয়ায় সামরিক অভিযানের ব্যর্থতা, কান্দাহার রক্ষার ব্যর্থ প্রচেষ্টা, সমস্তই মোগল বাহিনীর, ক্রমবর্দ্ধমান দুর্বলতা প্রকাশ করিয়া দিতেছিল।
দ্বিতীয়তঃ, আপাত দৃষ্টিতে দাক্ষিণাত্যে মোগল সাম্রাজ্যের জয় সূচিত হইলেও সুলতানি শক্তি খর্ব করিয়া মারাঠাদের উত্থানের পথই উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছিল।
সামরিক দুর্বলতা দাক্ষিণাত্য নীতির
তৃতীয়তঃ, যোগল সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে দেশের বিভিন্ন উপকূলভাগে ইউরোপীয়দের শক্তি বৃদ্ধি পাইতেছিল।
পরোক্ষ ফল ধর্মীয় সংকীর্ণতা
চতুর্থতঃ, শাহজাহানের ধর্মীয় সংকীর্ণতা হিন্দুদের আনুগত্যে শিথিলতা আনিয়া দিয়াছিল । শাহজাহানের আমলেই ঔরঙ্গজেবের হিন্দুবিরোধী আড়ম্বর ও বিলাসিতা নীতির ইঙ্গিত পাওয়া গিয়াছিল।
অত্যাচার ও শোষণ
সর্বশেষে শাসন- কর্তাদের অত্যাচার ও শোষণ, দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবীদের দুর্দশা এবং রাজশক্তির আড়ম্বর ও বিলাসিতা সাম্রাজ্যের কাঠামোকে দুর্বল করিয়া ফেলিয়াছিল ।
FAQs
প্রশ্ন: শাহজাহান এর মায়ের নাম কি?
উত্তর: শাহজাহান এর মায়ের নাম জগৎ গোসাইন ।
প্রশ্ন: সম্রাট শাহজাহানের কবর কোথায়?
উত্তর: সম্রাট শাহজাহানের কবর আগ্রার তাজমহলে অবস্থিত।