ভারতকে কেন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলা হয়?

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
Rate this post

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর ভারতীয় গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হলে ভারতের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রি জওহরলাল নেহেরু যে লক্ষ্যমূলক প্রস্তাব (The objective Resolutions) পেশ করেন (১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৪৬) তাতে ভারতকে ‘স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ রূপে অভিহিত করা হয়।

ব্রিটিশ শাসন তখনও বজায় থাকলেও স্বাধীনতার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। তাই ভবিষ্যৎ ভারতের শাসনব্যবস্থার রূপরেখা ঐ লক্ষ্যমূলক প্রস্তাবের মধ্যে নিহিত ছিল। নীচে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হল ।

প্রস্তাবনা:

ইদানীং পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবিধানে একটি ভূমিকা বা মুখবন্ধ দেখা যায়। ভারতের সংবিধানের শুরুতেই একটি ভূমিকা বা প্রস্তাবনা অংশ (Preamble) আছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুকরণে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানের নতুন সংবিধানের এবং স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশটি সংযোজিত হয়েছে।

প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি ‘সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র (Sovereign Democratic Republic) বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রস্তাবনায় ভারত রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলা হয়েছে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ন্যায় (Justice) প্রতিষ্ঠা করা, বাক স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দান করা (Liberty), সরকারী সুযোগ সুবিধা, মর্যাদার ক্ষেত্রে সকলকে সমদৃষ্টিতে দেখা (Equality) এবং সকলের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা (Fraternity)।

সার্বভৌম

সার্বভৌম’-এর অর্থ কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের অনুগত বা নিয়ন্ত্রিত নয়। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতার আধিকারী হল রাষ্ট্র। ‘গণতান্ত্রিক’ শব্দের অর্থ হল সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জনগণই চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী।

প্রজাতন্ত্র

প্রজাতন্ত্র‘ শব্দের অর্থ ভারতে রাজা বা রাজতন্ত্র নেই প্রজা বা জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতা বা চরম ক্ষমতার উৎস। ভারতের রাষ্ট্রপতিও জনগণের পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। ‘আমরা ভারতের জনগণ’ এই সংবিধানের স্রষ্টা।

১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আদর্শ যুক্ত হয়।

ফলে সংশোধিত প্রস্তাবনায় ভারত রাষ্ট্রকে ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

রঘুনাথ রাও বনাম ভারতরাষ্ট্র – ১৯৯৩, মামলায় সুপ্রিম কোটের রায়ে প্রস্তাবনাকে কোনোওভাবে সংবিধানের আনুষ্ঠানিক অংশ নয় বলে ঘোষণা করা হলেও প্রস্তাবনার মধ্যে দিয়ে সংবিধান তথা রাষ্ট্রের আদর্শ ও আকাক্ষার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 ভারতীয় গণপরিষদের গঠন ও কার্যাবলী

সংবিধান:

ভারতের সংবিধান পৃথিবীর বৃহত্তম লিখিত সংবিধান। এই সংবিধান প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়দের সার্বজনীন ভোটাধিকার দান করেছে; দান করেছে বিভিন্ন মৌলিক অধিকার। এই সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার কতকগুলি নির্দেশমূলক নীতি (Directive Principles of State Policy) ।

এর দ্বারা জনগনের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার নির্দেশিত হয়েছে। সাথে সাথে রাষ্ট্রের প্রতি জনগনের দায়িত্ব ও কর্তব্য উল্লেখিত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো:

ভারতীয় গণ-পরিষদ একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হলেও তিনিই শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং রাষ্ট্র প্রধান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে ভারতেও একজন উপ-রাষ্ট্রপতি আছেন।

প্রবর্তিত হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র, যে সংসদ জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা গঠিত।

যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে প্রত্যেক রাজ্যে নিয়মতান্ত্রিক শাসক, রাজ্যপাল আছেন। আছে রাজ্য আইন সভা, স্থানীয় শাসন পরিষদ-যেগুলি জনগনের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত।

এছাড়া আছে সুপ্রিম কোর্ট, যা সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা। নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষা কর্তা। কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধের ব্যাখ্যা কর্তা, ভারতীয় গণতন্ত্রের রক্ষা কর্তা।

গণতান্ত্রিক শাসন:

ভারতীয় গণতন্ত্র বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। এখানে সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। কারণ জনগনের দ্বারাই সরকার নির্বাচিত হয়।

আবার জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধি, যারা বিরোধীদল তারাও সরকারকে সংযত রাখে। পার্লামেন্টের যে- কোনো কক্ষে যে-কোনো সমস্যা সম্বন্ধে প্রশ্ন বা আলোচনা করা যায়। সরকারি নীতি গ্রহণ, ব্যয় বরাদ্দের হিসাব, ব্যয় মঞ্জুরী, অর্থবিল সংক্রান্ত আলোচনায় জনস্বার্থ বিবেচিত হয়।

মন্ত্রিসভা তার কাজের জন্য পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার কাছে দায়ী থাকে। এই দায়িত্ব হলো যৌথ দায়িত্ব (Collective Responsibility) । কোনো মন্ত্রি অভিযুক্ত হলে বা অনাস্থা প্রস্তাব পাশ হলে সমগ্র মন্ত্রিসভার পতন ঘটে।

সংসদীয় ব্যবস্থায় আইন, বিচার, শাসন বিভাগ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে (Mutual check and balance) কাজ করে। এমনকি বিচারকদের পদচ্যুতির ক্ষেত্রেও পার্লামেন্ট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।

গণতন্ত্রের সঙ্গে দলব্যকথা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে লোকায়ত সার্বভৌমিকতার (Popular Sovereignty) আদর্শ রূপায়িত করে।

আর্থ-সামাজিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা অধিকাংশ দল নির্বাচনে জনসমর্থনের ভিত্তিতে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করে। যোগ্যতা থাকলে দরিদ্রতম ব্যক্তিও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পায়। এই রাজনৈতিক দলগুলির লক্ষ্য হল জনকল্যান সাধন।

সংবিধানের দেওয়া অধিকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা জনগণ সভাসমিতি, পত্রপত্রিকা, চলচিত্র দূরদর্শন ও রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে জনমত গঠন করে তা প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন নির্বাচনে সেই সকল জনমতের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।

মূল্যায়ন:

এভাবে কেন্দ্রীভূত ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে স্বাধীন ভারত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে গণতন্ত্রকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক কাঠামো ভারতে প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। তাই ভারতকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ বলা হয়।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment