দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য মন্ত্রিমিশন যে সমস্ত প্রস্তাব দিয়েছিল, তারমধ্যে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র বা সংবিধান রচনা করার জন্য একটি গণ-পরিষদ (Constituent Assembly) গঠনের কথাও ছিল।
মন্ত্রি মিশনের প্রস্তাব ব্যর্থ হলেও সেই রূপরেখা অনুযায়ী ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় (১৯৪৬) এবং তারই ফলে গণ- পরিষদ গঠিত হয়, যা স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা করে।
গঠন:
নতুন গণ-পরিষদ প্রাদেশিক আইন সভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি সমবায়ে গঠিত হয়। মন্ত্রি মিশনের প্রভাব অনুযায়ী প্রতি দশ লক্ষ জনগণের জন্য একজন প্রতিনিধির ব্যকথা ছিল (প্রাদেশিক আইন সভার) যে প্রদেশগুলি ছিল লেফটান্যান্ট গভর্ণরের (ছোটলাট) দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে শাসিত।
তার মোট সংখ্যা ছিল ২৯২ জন সদস্য। আর ব্রিটিশ ভারতের চীফ কমিশনার শাসিত অঞ্চলের ছিলেন ৪ জন সদস্য। এছাড়া ছিলেন ভারতের দেশীয় রাজ্যের ৯৩ জন সদস্য (মনোনীত)।
এভাবে মোট ৩৮৯ জন সদস্য সমবায়ে ভারতীয় গণ-পরিষদ গঠিত হয়। মুসলিম লীগ পৃথক গণ-পরিষদ গঠনের দাবী জানায়।
কারণ মুসলিম সংরক্ষিত আসনের প্রায় সবই মুসলিম লীগ জয় করেছিল এবং মুসলিম লীগই মুসলিমদের মুখপাত্র একথা প্রমান করেছিল।
তাই মুসলিম লীগ ভারতীয় গণপরিষদে সংবিধান রচনার জন্য যোগ না দিলে এবং ভারতের স্বাধীনতা আইন পাশ হলে ২৯৪ জন সদস্য সমবায়ে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য ভারতীয় গণ-পরিষদ পুর্নগঠিত হয়।
লক্ষ্য:
ইতিপূর্বে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর ভারতীয় গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ গণ- পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন।
সভাপতির ভাষনে তিনি বলেন, ভারতীয়দের অন্ন, বস্ত্র, এবং আত্ম বিকাশের ব্যবস্থা, সুষ্ঠু জীবন যাত্রা গড়ে তোলা হবে নতুন সংবিধানের লক্ষ্য (১১ই ডিসেম্বর, ‘৪৬)।
জওহরলাল নেহেরু লক্ষ্যমূলক প্রস্তাব (The objective Resolutions) হিসাবে ভারতকে ‘স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র’ রূপে গড়ে তোলার কথা বলেন (১৩ই ডিসেম্বর, ’৪৬)।
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান নতুন ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির কথা বলেন। এগুলিই ছিল ভারতীয় গণ-পরিষদের লক্ষ্য।
🔥আরও পড়ুনঃ-
কার্যাবলী:
এরপর স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য পুর্নগঠিত ভারতীয় গণ-পরিষদে দশটি বিভিন্ন ধরনের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলিতে ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, জওহরলাল নেহেরুর মত বিশিষ্ট কংগ্রেসি নেতারা সভাপতি ছিলেন।
কমিটিগুলি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে, ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন, ব্রিটিশ আমলের অন্যান্য বিধি বিধান, বিদেশী সংবিধান পর্যালোচনা করে বি.এন.রাও একটি খসড়া সংবিধান তৈরী করেন।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে আগষ্ট কেন্দ্রীয় আইন সভার আইন মন্ত্রি ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকর-এর সভাপতিত্বে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি ‘খসড়া কমিটি’ (Drafting Committee) গঠিত হয়।
অন্য পাঁচ জন সদস্য ছিলেন যথাক্রমে এ. গোপালস্বামী আয়েঙ্গার, আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী আয়ার, কে.এম.মুন্সী, সৈয়দ মহম্মদ শাহেদুল্লাহ, ডি.পি.খৈতান। খসড়া কমিটি খসড়া সংবিধানের প্রতিটি ধারা আলোচনা ও প্রয়োজনে সংশোধন করে।
তারপর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে নভেম্বর গণ-পরিষদ ঐ সংবিধান গ্রহণ করে এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জানুয়ারী নতুন সংবিধান কার্যকর হয়। এই দিনটি ভারতে সাধারণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র দিবস (Republic Day) হিসাবে পালিত হয়।
এছাড়া স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সম্পর্ক, ভাষা ভিত্তিক রাজ্য পুণর্গঠন প্রভৃতি বিষয়ে গণ-পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়।
মূল্যায়ন:
যে গণ-পরিষদ স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা করে, সেই গণ-পরিষদ প্রাপ্তবয়স্ক সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত ছিল না।
সীমিত সংখ্যক ভোট দাতাদের পরোক্ষ ভোটে দেশীয় রাজ্যের রাজাদের মনোনীত প্রতিনিধি সমবায়ে গঠিত ছিল এই গণ-পরিষদ।
তাই অভিযোগ করা হয়, এই গণ-পরিষদ ভারতের বিভিন্ন শ্রেণি, সম্প্রদায়, জাতি, ধর্ম, বর্ণের প্রতিনিধিত্ব করেনি। তবুও একথা স্বীকার করতে হয়, অকংগ্রেসী, অরাজনৈতিক ব্যক্তি ও এই গণ-পরিষদে ছিলেন।
তাই এই গণ-পরিষদ একদলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের, বিশেষ শ্রেণি চরিত্রের প্রতিষ্ঠান ছিল না। ভারতবাসীর সর্বাঙ্গীন কল্যান সাধনই গণ-পরিষদের লক্ষ্য ছিল।