আজ এই আর্টিকেলের আমরা মুঘল সম্রাট আকবরের কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা করবো। আকবর ছিলেন মুঘল সম্রাটদের মধ্যে অন্যতম শাসক, কারণ তিনি সব ধর্মের সমন্বয়ে তার রাজ্যকে বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। যে কারণে তিনি তার আগের শাসকদের দ্বারা প্রচলিত জিজিয়া করকে প্রত্যাক্ষান করেন।
এর জন্য তিনি ইসলাম বিরোধী বা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেননি, তিনি চেয়েছিলেন সর্বধর্মের সমন্বয় সাধন করতে, যে কারণে তিনি কিছু প্রশাসনিক সংষ্কার করেছিলেন। ভারতের ইতিহাসে তার মহান কৃতিত্বের জন্য তাকে একজন মহান শাসক, সেনাপতি ও সৈনিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। চলুন মুঘল সম্রাট আকবরের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানা যাক।
বহুগুণের অপূর্ব সমাবেশ
১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র তের বৎসর বয়সে দিল্লীর সিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়া আকবর প্রায় পঞ্চাশ বৎসর ভারতের একচ্ছত্র সম্রাট হিসাবে পরিপূর্ণ সার্থকতার সহিত রাজত্ব করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার জীবনের অসামান্য সাফল্যের জন্য তাঁহার চরিত্রের অশেষ গুণাবলীই প্রধানতঃ দায়ী ।
তাঁহার চরিত্রে বহুগুণের এরূপ অপূর্ব সমাবেশ ঘটিয়াছিল যাহা ইতিহাসে বিরল। সমসাময়িক এবং আধুনিক ঐতিহাসিকগণ তাঁহার বহুগুণের, ব্যক্তিত্বের এবং রাজোচিত আভিজাত্যের বর্ণনা দিয়া গিয়াছেন। “He was in face and stature fit for the dignity of king.”-Monserrate.
আকবরের চরিত্র (Akbar‘s Character):
সিংহাসনে আরোহণের পর হইতেই আকবর বিভিন্ন সময়ে তাঁহার সাহসী হৃদয়ের পরিচয় দিয়াছেন ।
নিৰ্ভীক যোদ্ধা অসাধারণ সামরিক প্রতিভা
তিনি ছিলেন সাহসী বীর, সকল বিপদে অকুতোভয় ৷ অল্প বয়সেই সামান্য সহায় সম্বল লইয়া হিমুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রার মধ্যেই তাঁহার সাহসী হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায় ৷
মানসিক উৎকর্ষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে নানা গুণের পরিচয়
তিনি যে কেবলমাত্র নির্ভীক যোদ্ধা ছিলেন তাহাই নয়, তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ সামরিক প্রতিভা- সম্পন্ন সেনাপতি । তাই বিজেতা হিসাবে তিনি সার্থক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়া গিয়াছেন ।
কেবল মাত্র বিজেতা হিসাবে নয় অন্যান্য ক্ষেত্রেও তিনি তাঁহার মানসিক উৎকর্ষের পরিচয় দিয়া গিয়াছেন। তাঁহার কার্য নিপুনতা, দূরদৃষ্টি ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় তাঁহার প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থায় ৷
প্রজাহিতৈষণা, ন্যায় ও সততার প্রতি অনুরাগ
তিনি ছিলেন প্রজারঞ্জক; প্রজাহিতৈষণার জন্য তিনি অমর হইয়া আছেন । এইখানেই তাঁহার চরিত্রের মাধুর্য; প্রজাবাৎসল্যের দ্বারা তিনি প্রজাবর্গের অন্তর জয় করিয়াছিলেন। ন্যায় ও সততার প্রতিও তাঁহার গভীর অনুরাগ ছিল।
অন্যের চরিত্র বুঝিবার মত অন্তর্দৃষ্টি পরধর্ম সহিষ্ণুতা
অন্যের চরিত্র বুঝিবার মত অন্তদৃষ্টি তাঁহার ছিল; পরের গুণকে তিনি উদারভাবে স্বীকার করিতে পারিতেন; সেইজন্যই অপরকে নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করিবার মত মনোবলও তিনি রাখিতেন।
ধর্ম সম্বন্ধে তিনি ছিলেন উদার ৷ প্রথম দিকে তিনি যখন নিষ্ঠাবান সুন্নী মুসলমান হিসাবে ধর্মচর্চা করিতেন তখনও পরধর্মসহিষ্ণুতা ছিল তাঁহার জীবনের মূলমন্ত্র।
উচ্চ রাজ আদর্শ যুদ্ধ ও পররাজ্য গ্রাম-নীতি
এই সমস্ত চারিত্রিকগুণের ফলেই তিনি একটি উচ্চ রাজাদর্শ মনে প্রাণে গ্রহণ করিতে পারিয়া- ছিলেন। তিনি অবশ্য সে যুগের ধারা অনুসারে যুদ্ধ ও পররাজ্য গ্রাস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ‘প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে জয় করিতে সর্বদা যত্নবান’ থাকিতেন ।
কিন্তু একথাও সত্য যে রাজার আদর্শ সম্বন্ধে তাঁহার আদর্শ ছিল অতি উন্নত। তিনি বিশ্বাস করিতেন যে “বিশ্বের প্রতিপালক সম্রাটের পক্ষে অত্যাচারী হওয়া অন্যায় ও ধর্ম-বিরুদ্ধ” ।
রাজার ধর্ম সম্বন্ধে বিশ্বাস স্নেহপ্রবণতা ও কোমলতা
তিনি সম্রাট হইয়াও সাধারণতঃ ছিলেন অত্যন্ত স্নেহ প্রবণ । তবে তিনি কোমলতারও যেমন পরিচয় দিতেন, তেমনি অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে কঠোর রুদ্রমূর্তি ধারণ করিতেও পারিতেন ।
স্মৃতিশক্তি ও জ্ঞান- পিপাসা অপরিসীম ছিল
তিনি সম্ভবতঃ নিজে ভাল লিখিতে পড়িতে জানিতেন না, কিন্তু তাঁহার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ, তাঁহার জ্ঞান-পিপাসাও ছিল অপরিসীম। প্রতিভাবান ব্যক্তিদের তিনি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করিতেন, তাঁহাদের সহিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করিতেন।
তিনি কোন সময়েই ক্লান্তি বোধ করিতেন না। তঁহার বিদ্যোৎসাহিতা, মানসিক উৎকর্ষ ও মৌলিকতার যে পরিচয় তিনি রাখিয়া গিয়াছেন তাহাতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্রাটগণের মধ্যে তাঁহার আসন অক্ষয় রহিয়াছে।
🔥আরও পড়ুনঃ-
আকবরের কৃতিত্ব (Achievements of Akbar):
১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে হুমায়ুনের মৃত্যুর পর আকবর যখন দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন মোগল রাজ্য দিল্লী, আগ্রা ও তাহার চতুস্পার্শস্থ স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
সাম্রাজ্য-বিস্তার ও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা
অসীম সাহসিকতা ও অসাধারণ সামরিক প্রতিভার দ্বারা তিনি কেবল যে বাবরের সাম্রাজ্যকেই পুনরুদ্ধার করিয়াছিলেন তাহা নহে, সমগ্র উত্তর-ভারত এবং দাক্ষিণাত্যের গোদাবরী নদী পর্যন্ত অঞ্চল তিনি তাঁহার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন; ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যকে তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।
সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা
কিন্তু সামরিক সাফল্যের চাইতে তাঁহার অধিকতর কৃতিত্ব প্রকাশ পাইয়াছে একটি সুষ্ঠু সুদক্ষ শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার মধ্যে। তিনি বহুবিধ সংস্কার সাধন করিয়া সমগ্র দেশ একটি স্থায়ী শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করিতে সক্ষম হইয়াছিল । হিন্দু ও মুসলমানের সম্প্রীতির ভিত্তিতেই তিনি তাঁহার শাসনব্যবস্থার ভিত্তি রচনা করিয়াছিলেন।
বিভিন্ন জাতির সম্প্রীতির ভিত্তি বিভিন্ন শাসন- নীতির সংমিশ্রণ
ভারতীয় ও পারসীক- আরবীয় শাসননীতির সংমিশ্রণে তিনি একটি জাতীয় শাসনব্যবস্থা স্থাপন করিতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তাঁহার প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা মোগল সাম্রাজ্যকে দীর্ঘদিনের জন্য স্থায়িত্ব দান করিয়াছিল। বাবর ও হুমায়ুন কেবল রাজ্য জয় করিয়া সেই রাজ্য রক্ষা করিতেই ব্যস্ত ছিলেন; আকবর সে রাজ্যকে বিস্তৃত করিয়া তাহাকে স্থায়িত্ব দান করিয়াছিলেন।
আকবরের শাসন- ব্যবস্থার স্থায়িত্ব
বহুবিধ সামাজিক ও অর্থ নৈতিক সংস্কার সাধন করিয়া বহু বিভেদ-মূলক কর উঠাইয়া দিয়া আকবর দেশের সমৃদ্ধির ও প্রগতির পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন। জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থণের ভিত্তিতে সাম্রাজ্য গড়িয়া তিনি ভারত ইতিহাসে একটি নূতন যুগের সূচনা করিয়াছিলেন।
এই জন্যই ঐতিহাসিকগণ আকবরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া তাঁহাকেই মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃত স্থাপয়িতা বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকেন ।
স্থাপত্য ও চিত্রশিল্প
শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে আকবর যে ক্বতিত্ব দেখাইয়াছেন তাহাও কম উল্লেখযোগ্য নহে। স্থাপত্য শিল্পের প্রতি তাঁহার অনুরাগ ছিল যথেষ্ট।
ফতেপুর সিক্রী, হুমায়ুনের সমাধি, আগ্রা দুর্গে অবস্থিত জাহাঙ্গীর মহল প্রভৃতি আকবরের স্থাপত্য কীর্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আকবরের সময় নির্মিত হর্মাদির গঠনকার্যে হিন্দু ও পারসিক উভয় রীতির সংমিশ্রণ দেখা যায় ।
আকবরের উৎসাহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্র শিল্পেও যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছিল। হিন্দু চিত্র-শিল্পীগণ পারসিক রীতি গ্রহণ করিয়া এক নূতন ধরণের চিত্রশিল্পের সৃষ্টি করিয়াছিল ।
সাহিত্য-সৃষ্টি নিজাম উদ্দিন ও বায়ুন
সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আকবরের রাজত্বকাল এক গৌরবময় যুগ । তাঁহার সময়ে আবুল ফজল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তি। নিজাম উদ্দিন ও বদায়ূনী আকবরের রাজত্বকাল সম্বন্ধে মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন।
আবুল ফজল ও ফৈজী
আবুল ফজলের ‘আকবর নামা’ ও আইন-ই-আকবরী’ দুইখানি অমূল্য গ্রন্থ । ফৈজী ছিলেন ঐ সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁহার রাজত্বকালে সংস্কৃত ও হিন্দী সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি দেখা গিয়াছিল।
আকবরের নির্দেশে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ ফার্সী ভাষায় অনূদিত হইয়াছিল । বীরবল ছিলেন আকবরের অন্যতম সভাকবি । সুরদাস, তুলসীদাস প্রভৃতি কবিগণ হিন্দী ভাষার উৎকর্ষ সাধন করিয়া গিয়েেছন।
সুতরাং আকবরের রাজত্বকাল ভারত ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। দেশের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা, একটি সুষ্ঠু সুদক্ষ উদার শাসন- ব্যবস্থা রচনা, ক্বষ্টি ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতি বহুবিধ ক্বতিত্বের জন্য আকবর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নৃপতিগণের মধ্যে আপন স্থান করিয়া লইয়াছেন ৷
“Akbar was a born King of men, with a rightful claim to rank as one of the greatest sovereigns known to history. That claim rests severally on the basis of his extraordinary natural gifts, his original ideas and his magnificent achievements,”–Dr. Smith
FAQ Akbar History in Bengali
প্রশ্ন: আকবরের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব কি?
উত্তর: আকবরের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো দক্ষ শাসন ব্যবস্থার প্রচলন যা মনসবদারি ব্যবস্থা নামে পরিচিত।
প্রশ্ন: আকবরের সমাধি কে নির্মাণ করেন?
উত্তর: আকবর তার জীবদ্দশায় সমাধিটির নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু 1605 সালে তার মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি জাহাঙ্গীর এটি সম্পূর্ণ করেছিল।
প্রশ্ন: মোগল সম্রাট আকবরের সমাধি কোথায় অবস্থিত?
উত্তর: মোগল সম্রাট আকবরের সমাধিটি ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রার কাছে সিকান্দ্রায় অবস্থিত।
প্রশ্ন: সম্রাট আকবরের মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?
উত্তর: মুঘল সম্রাট আকবরের মৃত্যুর সঠিক কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তবে সর্বাধিক গৃহীত তত্ত্ব অনুযায়ী আকবর 27 অক্টোবর, 1605 সালে সম্ভবত আমাশয় বা জটিল অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যান।
প্রশ্ন: মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল কত বছর?
উত্তর: সম্রাট আকবর ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ ৪৯ বছর রাজত্ব করেন।