১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বলশেভিক বিপ্লবের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা, সমাজতন্ত্রের সফল প্রয়োগ, বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি জয়, উন্নয়ন, প্রভৃতি ঘটনা ধনতান্ত্রিক পৃথিবীর কাছে আতঙ্কের বিষয় হলেও এবং সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর কাছে আদর্শ ও অনুকরণযোগ্য হলেও বিভিন্ন কারণে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পীঠস্থান সোভিয়েত ইউনিয়নের সংহতি বিনষ্ট হয়। আমরা তা আলোচনা করব।
কেন্দ্রীকরণ নীতি:
জার শাসিত রাশিয়া ও রুশ জনগণ যে অবস্থায় ছিল, বলশেভিক বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ একই অকথায় ছিল এবং জনগণ আরও দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে পড়ে। জার আমলে দমন নীতি সত্ত্বেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, জনগণ বিক্ষোভ দেখাত, কিন্তু বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
স্ট্যালিনের .সময় নিষ্ঠুর দমন নীতির ফলে প্রতিবাদী লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। কারারুদ্ধ, সাইবেরিয়ায় নির্বাসন স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে যে উন্নয়ন হয় তার ফলে সোভিয়েত রাষ্ট্রের উন্নতি হয়, জনগণ তার সুফল থেকে বঞ্চিত ছিল। নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের উৎপাদন নিতান্ত কম ছিল।
নিকিতা ক্রুশ্চেভ বি-স্তালিনকরণ নীতি অনুযায়ী ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার ও এককেন্দ্রিকতার নীতি ত্যাগ করলেও, ভোগ্য পণ্যের উৎপাদনে গুরুত্ব দিলেও, কঠোরতার অবসান ঘটালেও, তার উত্তরসূরী ব্রেজনেভ আবার স্টালিনবাদী পথে চলতে শুরু করেন।
আবার সবকিছুতে দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় (রতন খাসনবীশ—বাজার অর্থনীতি ঃ সমাজতন্ত্র ও মানবধর্ম)—সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়ায় গণ অভ্যুত্থান ঘটে। যুগোস্লোভিয়ার সঙ্গে মতভেদ ঘটে। পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত জনগণের মনে ক্ষোভ ধূমায়িত হয় —যা সোভিয়েত ইউনিয়নের সংহতি বিনাশের অন্যতম কারণ।
আর্থিক সংকট:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যয়ভার, যুদ্ধোত্তর সংকট, পুর্নগঠন, পশ্চিমী রাষ্ট্র জোটের সঙ্গে (NATO) প্রতিযোগিতার জন্য পূর্ব ইউরোপে Warshaw জোট গঠন, সেনা মোতায়েন, ব্যয় বহুল পরমাণু বোমা উৎপাদন, দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ, মহাকাশে গবেষণা ও প্রতিযোগিতা, মধ্যপ্রাচ্যের মিশর, সিরিয়া, ইরাক প্রভৃতি দেশের সঙ্গে মৈত্রী সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে কারিগরি ও আর্থিক সাহায্য দান, আফ্রিকার কঙ্গোয়, এঙ্গোলায়, লাতিন আমেরিকার নিকারাগুয়া, কিউবা, আর্জেন্টিনা, এল সালভাদোরে, প্রতিবেশী আফগানিস্থানে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে প্রচুর ব্যয় হয়। এভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের যুগে বিশ্বব্যাপী সামরিক তৎপরতায় আর্থিক দুর্বলতা সূচিত হয়।
বিশ্বায়নের যুগে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও সোভিয়েত অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কলকারখানাগুলির উৎপাদন ক্ষমতা, গুণমান হ্রাস পেয়েছিল। পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পিছিয়ে পড়ে। উৎপাদনের উপকরণগুলির রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেও সংকট দূর করা যায়নি। মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এই আর্থিক অবক্ষয় সোভিয়েত অর্থনীতিতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন সৃষ্টি করে।
🔥আরও পড়ুনঃ-
নতুন সংস্কার:
স্ট্যালিনোত্তর যুগে ক্রুশ্চেভের সময় যে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে, তার ফলে বাজার অর্থনীতির সূচনা ঘটে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির সূত্রে ভোগ্য পণ্যের উৎপাদন শুরু হয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বদলে গণতান্ত্রিকতা, এককেন্দ্রিকতার বদলে বহুকেন্দ্রিকতা নীতি চালু হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। দীর্ঘ দিনের অবরুদ্ধ মানুষ যেন মুক্তির স্বাদ পায়।
পরে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান মিখাইল গর্বাচভ কমিউনিস্ট পার্টির এক সম্মেলনে (কেন্দ্রিয় কমিটির) ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রৈকার প্রস্তাব দেন (২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬ খ্রিঃ)।
গ্লাসনস্ত (স্বাধীন/মুক্তচিন্তা) ও ‘পেরেস্ত্রৈকা’ (উদারবাদ/খোলা) হাওয়ার নীতির লক্ষ্য ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতিতে যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এযাবৎকাল বলবৎ ছিল (ক্রুশ্চেভ আমলের সাময়িক বিরতি ছাড়া) সেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটানো।
এই নীতি অনুযায়ী একনায়কত্ব, ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার বদলে গণতান্ত্রিকতাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা হয়। কমিউনিস্ট দলের সার্বিক প্রাধান্য খর্ব করা হয়। দলের শাখা সংগঠনগুলিকে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তোলার ব্যবস্থা হয়। সেনাবাহিনীতে দলীয় শাখা নিষিদ্ধ হয়। অন্য রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার দেওয়া হয়।
অর্থনীতির ক্ষেত্রেও সংস্কার সূচিত হয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটিয়ে বাজার অর্থনীতি চালু করা হয়। রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদন, পণ্যের গুণমান নিয়ন্ত্রণ, ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা হয় ।
এই খোলা হাওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ে। মুদ্রণ যন্ত্রের স্বাধীনতা ফিরে আসে। সেজন্য গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রৈকাকে অনেকে ‘দ্বিতীয় সোভিয়েত বিপ্লব’ বলে থাকেন। খোলা হাওয়া বন্ধ অচলায়তনে প্রবেশ করে শুধু পরিবর্তনই আনেনি, ধ্বংসও করে দেয়।
ভাঙন শুরু:
গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকা নীতির বাস্তবায়ন শুরু হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের মধ্যে এক প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কমিউনিস্ট নেতৃত্বের মধ্যেও উন্মাদনা দেখা দেয়, যদিও কট্টরপন্থী গোষ্ঠী নিষ্ক্রিয় ছিল না। কেন্দ্রীয় কমিটির একাংশ নতুন সংস্কারের পক্ষে ও একাংশ বিপক্ষে ছিলেন। গর্বাচভ মন্ত্রীসভার রদবদল ঘটিয়ে নিজ অনুগত ও সংস্কারপন্থীদের সাহায্যে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রী এডওয়ার্ড শেভাদনাদজে পদত্যাগ করলে সংকট সৃষ্টি হয়।
ইতিমধ্যে বাল্টিক প্রজাতন্ত্রগুলি (ল্যাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া) স্বাধীনতার দাবি তোলে। তাদের দাবি ঐতিহাসিক এবং যুক্তিযুক্ত ছিল। সেই দাবি স্বীকারে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথমে আপত্তি ছিল। সোভিয়েত বাহিনী লিথুয়ানিয়ায় দমন নীতি চালায় কিন্তু জাগ্রত জনতার সামনে সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বাল্টিক প্রজাতন্ত্রগুলি স্বাধীন হয়ে যায়।
এই ঘটনার প্রভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলি সকলেই স্বাধীনতার দাবি তোলে, সমস্যা সমাধানের জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। (১৭ই মার্চ, ১৯৯১ খ্রিঃ)। গণ ভোটের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের হাতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি (সামরিক, আর্থিক, যুক্ত রাষ্ট্র, যোগাযোগ প্রভৃতি রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ‘বরিস ইয়েলিৎসিন ১০টি প্রজাতন্ত্রের গঠিত জোটের (রুশ ফেডারেশন) সভাপতি হন। সাথে সাথে রাশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হন (প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত)।
কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থী অংশ মিখাইল গর্বাচভকে গৃহবন্দি করে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। সেনাবাহিনী তলব করে। কিন্তু বরিস ইয়েলেৎসিন ও জাগ্রত জনতার সাহায্যে গর্বাচভ আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তার পর মিনাক শহরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিরা সমবেত হয়ে (৮ই ডিসেম্বর, ১৯৯১ খ্রিঃ) নিজেদের মধ্যে CIS গঠন করে (Common wealth of Independent States) প্রতিটি প্রজাতন্ত্রই স্বাধীন হয়ে যায়।
উপসংহার:
এইভাবে বলশেভিক বিপ্লবের পর যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী দেশগুলোর কাছে আতঙ্কস্বরূপ ছিল, সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠান্ডা যুদ্ধের ধাক্কায় মার্কিন পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত নিজ ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হল। সমাজতন্ত্র আর অন্যদেশে ছড়িয়ে পড়ল না। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হল না।