দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পৃথিবী দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়লে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়। পৃথিবীর দ্বি-মেরুকরণও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
বিভিন্ন কারণে সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দুই শিবিরেই বহুকেন্দ্রিকতার উদ্ভব ঘটে। আবার বহুকেন্দ্রিকতাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতন, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন দেখা দিলে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একক পরাশক্তিতে পরিণত হয়।
বিশ্বব্যবস্থা:
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যে মার্কিন প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু করেছিলেন, তার সূত্র ধরে পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেন (১৯৯১খ্রিঃ)।
ধারনাটি স্পষ্ট না হলেও প্রাক্তন জাপানি প্রধানমন্ত্রী তোসিকি কাইফু’র ভাষায় বলা যায়, ‘এই ব্যবস্থায় থাকবে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি প্রদর্শিত হবে শ্রদ্ধা আর মুক্ত বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে থাকবে সমৃদ্ধির আশ্বাস’ (L. Dhiravegin — The New International parametre and the new world order’ India quarterly, Vol – 50, No 3, Page – 67).
স্বরূপ: মার্কিন আধিপত্য হস্তক্ষেপ:
এই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনের দায়িত্ব জাতিপুঞ্জের উপর অর্পিত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য দেশগুলি এর নিয়ামক হয়ে উঠেছে। তাদের উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির প্রসার ঘটানো।
যেসব দেশ এই নীতির বিরোধী বা বাধা, তাদের বিভিন্নভাবে শাস্তি দেওয়া হবে। জাতিপুঞ্জের নামে আমেরিকার উদ্যোগে ওইসব দেশের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হবে।
অজুহাত হবে মানবিক অধিকার, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, জাতিগত সমস্যা, সন্ত্রাসবাদ, পরিবেশ দূষণ, মাদক দ্রব্য চোরাচালান প্রভৃতির যে-কোনো একটি-যা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় উপেক্ষিত ছিল (R. R. Ramchandani – L.N. Africa and the Dynamics of the new world order). এই হস্তক্ষেপের ঘটনা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে ঘটতে দেখা যায় তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিতে।
🔥আরও পড়ুনঃ-
নিরস্ত্রীকরণ:
পরমাণু অস্ত্রের প্রসার রোধ বর্তমানে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য। যে দেশ এই নীতির বিরোধী তার বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে ‘হাত ভাঙার নীতি’ (Front Line, June-2, 1995) – N. P.T’র মেয়াদ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাড়িয়ে CTBT কে সমর্থন করতে অন্য রাষ্ট্রগুলিকে বাধ্য করছে।
অনেকের আশংঙ্কা আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত রাশিয়া বা রুশ বিজ্ঞানীরা বিপুল নগদ অর্থের প্রলোভনে হয়ত তাদের মারণাস্ত্র বা প্রযুক্তি অন্যদেশ বা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠির কাছে হস্তান্তর করতে পারে (Monoroma Kohli – Disintegration of USSR) কিন্তু বর্তমান রুশ সরকার CTBT স্বাক্ষর করায় সে আশংঙ্কা দূর হয়ে মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জাতিপুঞ্জ:
নতুন বিশ্বব্যবস্থায় একমেরুকরণের প্রভাব বেশি দেখা যায় জাতিপুঞ্জে। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে এক অদ্ভুত ঐক্য গড়ে উঠেছে, ইউজিন রসটো যাকে ‘নয়া কোয়ালিশন’ বলেছেন।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পুরনো মিত্র চিন ও রাশিয়া আর্থিক সাহায্য ও বাজারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। শান্তির জন্য অংশীদারিত্বে’র সূত্রে NATO, European Union C. 7. W.TO প্রভৃতি সংস্থার দরজা রাশিয়ার জন্য খোলা।
মার্কিন একাধিপত্য লক্ষ্য করা যায় উপসাগরীয় যুদ্ধে (১৯৯০-৯১)খ্রিঃ। মার্কিন নেতৃত্বে ২৮ দেশের জোট বাহিনী কুয়েতকে ইরাকের দখল মুক্ত করতে অভিযান করে।
মূলত মার্কিন পেট্রোলিয়াম কোং-এর স্বার্থরক্ষা ছিল এর উদ্দেশ্য। পরাজিত ইরাকের অভ্যন্তরে ‘No Fly Zone” সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্র গঠন করে। আর্থিক অবরোধ শুরু হয়। জাতিপুঞ্জের সেখানে ভূমিকা ছিল মার্কিন আজ্ঞাবহের।
ইরান, ইরাকের OPEC সদস্য পদ মার্কিন সরকারের অসহ্য। তেলের দাম নির্ধারণে তাদের মতামতই চূড়ান্ত হবে এই তাদের আশা। এজন্য ইরাক গোপনে গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র মজুদ করেছে’ এই অভিযোগে সেবাদাস জাতিপুঞ্জের অস্ত্র পরিদর্শক দলকে ইরাকে পাঠায়।
ইরাক তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করলেও, পরিদর্শক দলের নেতা মহম্মদ আল বারাদেই ইরাকে গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র নেই’ এই মর্মে প্রতিবেদন দিলেও, জাতিপুঞ্জ অনুমতি না দিলেও, বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনী ইরাক দখল করে (২০০৩) এবং চালাবীর নেতৃত্বে ‘পুতুল সরকার’ প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য জাতিপুঞ্জকে নির্দেশ দেয়।
শান্তি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য (?) নোবেল জয়ী মহাসচিব কোফি আন্নান উৎসাহের সঙ্গে মার্কিন আজ্ঞা পালনে তৎপর হন।
জাতিগোষ্ঠী সমস্যার অভিযোগে NATO যুগোস্লোভিয়ার বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কুসুভোকে স্বাধীন করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিমান হানার (৯/১১ বা ১১/৯/২০০১) পরিপ্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবাদী নেতা ওসামা বিন লাদেনের (একদা মিত্র) ঘাঁটি আফগানিস্থানকে মার্কিন ও তাঁবেদার বাহিনী দখল করে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের পর হামিদ কারজাই সরকার প্রতিষ্ঠা (গণতন্ত্র) করে।
অর্থনীতি:
অর্থনীতির উদারীকরণের নামে মুক্ত বাজার গড়া হলেও বহু মানুষ (১০০ কোটি প্রায়) কাজ হারাতে থাকে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর তীব্রতা বেশি করে দেখা যায় (World Employment Report – 98-99) বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার চাপে উন্নয়নশীল দেশগুলি আমদানি শুল্ক কমিয়ে উন্নতদেশের পণ্য আমদানি করে নিজ নিজ শিল্প ধ্বংস করতে বাধ্য হচ্ছে।
মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক বিনিময়যোগ্য করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হচ্ছে। মুদ্রা মানের (তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির) অবনতি ঘটছে।
মুক্ত বাজারের নামে ‘মুক্ত পৃথিবী’ যখন সংকটাপন্ন, তখন আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারকে (IMF) সামনে রেখে হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ শুরু করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।
থাইল্যান্ডকে ১৭২০ কোটি ডলার ঋণ (২০ আগস্ট, ১৯৯৭খ্রিঃ) ইন্দোনেশিয়াকে ৩৪২০ কোটি ডলার ঋণ, দঃ কোরিয়া কে ৫৮০ কোটি ডলার ঋণ, রাশিয়াকে ২২৬ কোটি ডলার ঋণ এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ১৫০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়ে উদারীকরণের পথে চলতে সাহায্য করে।
ইদানীং তথ্য প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ব্যবসার রমরমা। এক্ষেত্রেও বহুজাতিক সংস্থাগুলির প্রাধান্য। ৩০০টি প্রতিষ্ঠানের (M.N.C) পুঁজির পরিমাণ পৃথিবীর মোট পুঁজির ২৫%।
তাদের বিক্রিত পণ্যের মূল্য তৃতীয় বিশ্বের জাতীয় আয়েরও বেশি। একদশক অতিক্রান্ত উদারীকরণ প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের কোনো সুবিধা হয়নি (Joseph Stiglitzs – Globalisation and it’s Discontent).
উপসংহার:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে একাধিপত্য এবং অর্থ নীতিতে যে নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার ফলে পৃথিবী একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠির দ্বারা পরিচালিত হবে।
আজ্ঞাবহ শাসক শ্রেণির (গণতান্ত্রিক) উপর কর্তৃত্ব করবে। সমাজে থাকবে বিত্তবান আর বিত্তহীনের বিশাল ব্যবধান।
উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হবে একচেটিয়া উৎপাদক গোষ্ঠীর লাভ-লোকসানের নিয়ম অনুসারে জনগণের প্রয়োজন সেখানে ‘তথ্য’ মাত্র হবে।