ভারতে নির্মিত উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য-ভাস্কর্য গুলির মধ্যে মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প ছিল অন্যতম। ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সম্রাটদের দ্বারা নির্মিত ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্য, সাধারণত ষোলো থেকে আঠারো শতকের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল।
এই স্থাপত্যশৈলী গুলি এখনো পর্যন্ত বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কারণ। যার মধ্যে শাহজাহান দ্বারা নির্মিত তাজমহল হল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটি।
এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প, স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্য, মোগল যুগের স্থাপত্য শিল্পের নাম এবং কোন সম্রাট কোন শিল্পের উপর অনুরাগী ছিল তার সম্পূর্ণ বিবরণ পাবেন।
মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প । Mughal Architecture in Bengal
1526 সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করে বাবর মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাবর তার শাসন কালে বেশ কিছু স্থাপত্যশৈলী নির্মাণ করে ছিলেন, তবে বাবরের নাতি সম্রাট আকবরের আমলে নির্মিত ফতেহপুর সিক্রি, ফোর্ট সিটি, আগ্রা ফোর্ট এবং বুলন্দ দরওয়াজা ছিল উল্লেখযোগ্য।
আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর দ্বারা কাশ্মীরের শালিমার গার্ডেনটি চালু করা হয়। ইতিহাসে সম্রাট শাহজাহান দ্বারা নির্মিত স্থাপত্যশৈলী গুলি বিশ্ব দরবারে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।
শাহজাহানের সময় কালে তাজমহল, জামা মসজিদ, ওয়াজির খান মসজিদ, লাহোর দুর্গ পুনর্নির্মাণ এবং লাহোরের শালিমার গার্ডেন ছিল উল্লেখযোগ্য। আর আওরঙ্গজেবের সময়ে বাদশাহী মসজিদ, বিবি কা মাকবারা এবং মতি মসজিদের নকশা উল্লেখযোগ্য।
ক্রমিক সংখ্যা | মুঘল সম্রাটের নাম | স্থান | মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প |
1 | শাহজাহান | আগ্রা | তাজমহল |
2 | শাহজাহান | দিল্লি | লাল কেল্লা |
3 | শাহজাহান | দিল্লি | জামা মসজিদ |
4 | বেগা বেগম | দিল্লি | হুমায়ুনের সমাধি |
5 | আকবর | আগ্রা | ফতেহপুর সিক্রি |
6 | আকবর | আগ্রা | আগ্রা ফোর্ট |
7 | আকবর | সিকান্দ্রা | আকবরের সমাধি |
8 | জাহাঙ্গীর | শ্রীনগর | শালিমার বাগ |
9 | আসিফ খান | শ্রীনগর | নিশাত বাগ |
10 | নুরজাহান | লাহোর | জাহাঙ্গীরের সমাধি |
11 | শাহজাহান | লাহোর | শীশ মহল |
12 | আওরঙ্গজেব | লাহোর | বাদশাহী মসজিদ |
13 | গভর্নর ওয়াজির খান | লাহোর | ওয়াজির খান মসজিদ |
14 | আজম শাহ | আওরঙ্গাবাদ | বিবি কা মকবারা |
15 | আদিল শাহ | বিজাপুর | গোল গুম্বাজ |
16 | বাবর | আগ্রা | বাবরি মসজিদ |
17 | হুমায়ুন | দিল্লি | হুমায়ুনের সমাধি |
18 | হুমায়ুন | আগ্রা | আগ্রায় আগ্রা দুর্গ |
19 | আকবর | আগ্রা | ফতেপুর সিক্রি |
20 | জাহাঙ্গীর | দিল্লি | জাহাঙ্গীর মহল |
21 | আওরঙ্গজেব | দিল্লি | আলমগিরি গেট |
22 | আওরঙ্গজেব | ঔরঙ্গাবাদ | বিবি কা মাকবারা |
23 | মুহম্মদ শাহ | দিল্লী | রোশনারা বাগ |
24 | আহমদ শাহ বাহাদুর | দিল্লী | জাফর মহল |
25 | শাহ আলম দ্বিতীয় | আগ্রা | আকবরাবাদ |
26 | শাহ আলম দ্বিতীয় | দিল্লী | হাউজ খাস |
27 | বাবর মির্জা কামরান | লাহোর | কামরানের বারাদারি |
28 | হুমায়ুন | দিল্লি | নীলা গুম্বাদ |
29 | বাহাদুর শাহ | দিল্লি | খান-ই-খানার সমাধি |
30 | ফররুখসিয়ার | দিল্লি | কুদসিয়া বাগ |
31 | মুহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা | দিল্লী | মুহাম্মদ শাহের সমাধি |
32 | আহমদ শাহ দুররানি | দিল্লি | আহমদ শাহ দুররানির সমাধি |
33 | আলমগীর তৃতীয় | দিল্লি | মতি মসজিদ |
34 | শাহ আলম দ্বিতীয় | দিল্লি | জিনাত-উল-মসজিদ |
35 | বাহাদুর শাহ দ্বিতীয় | দিল্লি | খুনি দরওয়াজা |
36 | বাহাদুর শাহ তৃতীয় | ইয়াঙ্গুন (বার্মা) | বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি |
37 | জাহান্দর শাহ | দিল্লী | জাহান্দর শাহের সমাধি |
38 | মুহাম্মদ শাহ দ্বিতীয় | দিল্লি | বাদশা পাসন্দ |
39 | মুহাম্মদ শাহ তৃতীয় | দিল্লি | বাগ-ই-বেদিল |
40 | শাহজাহান | লাহোর | শাহী হাম্মাম |
41 | শাহজাহান | দিল্লী | দিওয়ান-ই-খাস |
42 | নুরজাহান | আগ্রা | ইতিমাদ্দৌলার সমাধি |
43 | জাহাঙ্গির | লাহোর | বেগম শাহী মসজিদ |
44 | আকবর | এলাহাবাদ | এলাহাবাদ দুর্গ |
45 | আকবর | অ্যাটক | অ্যাটক ফোর্ট |
46 | আকবর | লাহোর | লাহোর ফোর্ট |
47 | আকবর | আগ্রা | জ্যোতিষ সভা স্থান |
48 | আকবর | আগ্রা | হিরণ মিনার |
49 | আকবর | আগ্রা | ইসলাম খানের সমাধি |
50 | আকবর | আগ্রা | শেখ সেলিম চিস্তির সমাধি |
51 | আকবর | আগ্রা | জামা-ই-মসজিদ |
52 | আকবর | আগ্রা | বীরবল মহল |
53 | আকবর | আগ্রা | মরিয়মের কটেজ |
54 | আকবর | আগ্রা | যোধাবাই মহল |
55 | আকবর | আগ্রা | তুর্কি সুলতানার কুটির |
56 | আকবর | আগ্রা | বুলন্দ দরওয়াজা |
57 | আকবর | আগ্রা | পঞ্চমহল |
58 | আকবর | আগ্রা | দেওয়ান-ই-আম |
59 | শের শাহ | মায়ানমার থেকে আফগানিস্থান পর্যন্ত | সাদাক-ই-আজম |
60 | শের শাহ | দিল্লী | কিলা-ই-কুহুনা |
61 | শের শাহ | সাসারাম | শের শাহের সমাধি |
62 | হুমায়ুন | দিল্লী | দিনপানাহ |
63 | বাবর | আগ্রা | বাগ-ই-গুলফশান |
64 | বাবর | অযোধ্যা | অযোধ্যা মসজিদ |
65 | বাবর | পানিপথ | কাবুলিবাগ মসজিদ |
মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্য
- তাজমহল (আগ্রা): সম্রাট শাহজাহানের নির্মিত সাদা মার্বেলের সমাধি।
- লাল কেল্লা (দিল্লি): এটি একটি প্রাসাদ দুর্গ ।
- জামা মসজিদ (দিল্লি): ভারতের বৃহত্তম মসজিদগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৷
- হুমায়ুনের সমাধি (দিল্লি): পারস্য ও মুঘল স্থাপত্যের সংমিশ্রনে একটি বিশাল সমাধি।
- ফতেহপুর সিক্রি (আগ্রা): প্রাসাদ সহ প্রাঙ্গণ।
- আগ্রা ফোর্ট (আগ্রা): চিত্তাকর্ষক স্থাপত্য এবং বাগান সহ প্রাসাদ।
- আকবরের সমাধি (সিকান্দরা): চিত্তাকর্ষক নকশা এবং কারুকার্য বিশিষ্ঠ সম্রাট আকবরের সমাধি।
- শালিমার বাগ (শ্রীনগর): এটি একটি মুঘল উদ্যান সঙ্গে ঝর্ণা রয়েছে।
- নিশাত বাগ (শ্রীনগর): ডাল লেকের মনোরম দৃশ্য সহ মুঘল বাগান।
- জাহাঙ্গীরের সমাধি (লাহোর): সুন্দর বাগান সহ সমাধি।
- শীশ মহল (লাহোর ফোর্ট): আয়নার কাজ এবং কাচের সজ্জা সহ জমকালো প্রাসাদ।
- বাদশাহী মসজিদ (লাহোর): মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ।
- ওয়াজির খান মসজিদ (লাহোর): রঙিন টালির মুঘল মসজিদ স্থাপত্যে।
- বিবি কা মকবারা (ঔরঙ্গাবাদ): এই সমাধিকে “দাক্ষিণাত্যের তাজ” বলা হয় ৷
- গোল গুম্বাজ (বিজাপুর): চিত্তাকর্ষক স্মারক গম্বুজ।
- লালবাগ কেল্লা (ঢাকা): প্রাসাদ, মসজিদ এবং বাগান বিশিষ্ট বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক মুঘল দুর্গ।
- শাহজাহান মসজিদ (ঠাট্টা): পাকিস্তানে সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে নির্মিত মসজিদ।
- শালিমার গার্ডেন (লাহোর): মুঘল আমলের একটি অত্যাশ্চর্য বাগান।
- রোহতাস ফোর্ট (ঝিলম): ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ জায়গা যেটি শের শাহ সুরি তৈরি করেছিলেন।
- হিরণ মিনার (শেখুপুরা): সম্রাট জাহাঙ্গীর নির্মিত পশুর ভাস্কর্যে টাওয়ার।
- পরী মহল (শ্রীনগর): সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে নির্মিত বাগান এবং মসজিদ।
- চিনি কা রৌজা (আগ্রা): পারস্য-শৈলীর টালির কাজ যুক্ত সমাধি এবং মসজিদ ।
- আয়না মহল (ভুজ): কাঁচের সজ্জা বিশিষ্ঠ বিখ্যাত প্রাসাদ।
- ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধি (আগ্রা): সূক্ষ্ম মার্বেল কাজের সমাধি। একে “বেবি তাজ” বলা হয়।
- ছোট ইমামবারা (লখনউ): মসজিদ এবং সমাধি।
🔥আরও পড়ুনঃ-
সমন্বয় সাধনের ধারা
তুর্কী আফগান আমলের শেষ দিকে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সূচনা হইয়াছিল, মোগল আমলে তাহা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাইতে থাকে।
এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ফলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের এক অভূতপূর্ব প্রচেষ্টা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। কি স্থাপত্য শিল্প, কি চিত্র শিল্প, কি সাহিত্য সর্বত্র এই প্রচেষ্টার ছাপ আজও তাহাদের নিদর্শনগুলি বহন করিয়া চলিতেছে।
মুঘল যুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য:
মুঘল শাসকরা একটি স্বতন্ত্র স্থাপত্য শৈলী নিয়ে এসে ছিল। স্বতন্ত্র স্থাপত্য শৈলী গুলির মধ্যে ভারতীয়, ইসলামিক ও ফার্সি সংমিশ্রনের ছোঁয়া পাওয়া যায়। মুঘল স্থাপত্য শৈলী গুলির মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত হল মুঘল সম্রাট শাহজাহানের নির্মিত তাজমহল। নিচে মুঘল সম্রাটদের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য আলোচনা করা হল-
বৈদেশিক প্রভাব ঐতিহাসিকগণের অভিমত
মোগল সম্রাটগণ স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে সব চেয়ে বেশী খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন। মোগল স্থাপত্যে বৈদেশিক প্রভাব কতখানি তাহা লইয়া ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতভেদ আছে। ফারগুসন ( Fergusson )-এর মতে মোগল, স্থাপত্যে বৈদেশিক রীতি যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল ।
কিন্তু হাভেলের ( Havell) মতে ভারতীয় শিল্পী ও স্থপতিগণই এক্ষেত্রে তাহাদের প্রাধান্ত বজায় রাখিয়াছিল। জন মার্শাল ( John Marshall ) বলিয়াছেন যে সমগ্র ভারতবর্ষে কোন সময়েই এক ধরনের স্থাপত্য রীতি পরিলক্ষিত হয় নাই ; এই বিশাল দেশের এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের রীতি বিকাশ লাভ করিয়াছে।
বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পরীতির বিভিন্নতা (পারসিক ও ভারতীয় প্রভাব)
তাহা ছাড়া, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্রাটের রুচি অনুসারে একক ধরনের স্থাপত্য রীতি প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। আকবরের রাজত্ব কাল পর্যন্ত ভারতীয় স্থাপত্যে পারসিক প্রভাব যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয়; কিন্তু তাহার পর হইতেই ঐ প্রভাবের অবলুপ্তি ঘটিতে থাকে। এই সময় হইতে আলঙ্কারিক কারুকার্য ও সৌন্দর্যের প্রতি বেশী ঝোঁক দেখা যায় ।
বাবর ও হুমায়ুন
বাবর প্রথম দিকে ভারতীয় স্থাপত্য সম্বন্ধে বিশেষ উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেন না, এবং প্রাসাদাদি নির্মাণের জন্য বহির্দেশ হইতে শিল্পী আমদানির কথাও ভাবিয়াছিলেন।
পরে অবশ্য ভারতীয় শিল্পীগণের সাহায্যে পাণিপথের ‘কা বুল-বাগ,’ সম্বলের ‘জামি মসজিদ’ প্রভৃতি নির্মাণ করাইয়াছিলেন । পারসিক রীতির অনুকরণে হুমায়ুন ফতেবাদের মসজিদ, দিল্লীর ‘দিন-পানহ’ প্রভৃতি নির্মাণ করাইয়াছিলেন।
শের শাহের অবদান
ভারতের স্থাপত্য শিল্পে শের শাহের দান নেহাৎ কম ছিল না; তাঁহার নির্দেশে নির্মিত সাসারামের সমাধি সৌধে হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইস্লামীয় রীতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়াছিল।
আকবর —শিল্পরীতিতে উদারতা ফতেপুর সিক্রি
আকবরের নির্মিত স্থাপত্যের মধ্যে তাঁহার উদার মনোভাবের প্রতিফলন দেখিতে পাওয়া যায়। হুমায়ুনের সমাধি সৌধের মধ্যে পারসিক ও ভারতীয় রীতির সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়। অন্যান্য স্থাপত্যেও হিন্দু তথা ভারতীয় প্রভাব এই সময় হইতে দেখা যায়।
আকবরের আমলে নির্মিত প্রাসাদ, দুর্গ, মসজিদ ও সমাধি-সৌধগুলির মধ্যে ফতেপুর সিক্রি বিশেষভাবে ঐতিহাসিকগণের মনকে আকৃষ্ট করে। “Nothing sadder or more beautiful exist in India than the deserted city, the silent witness of a vanished dream.”-Lane Poole.
মুঘল স্থাপত্য শিল্পে শাহজাহানের অবদান (জাহাঙ্গীর শাহজাহানের শ্রেষ্ঠত্ব)
জাহাঙ্গীর স্থাপত্যপ্রীতির বিশেষ পরিচয় দেন নাই সত্য, কিন্তু নূরজাহানের পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত ‘ইতিমাদ্-উদ্-দৌলা-সমাধি-সৌধটি’, স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন।
স্থাপত্য নির্মাতা হিসাবে শাহজাহান ছিলেন মোগল সম্রাটদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মৌলিকতার দিক দিয়া তাঁহার আমলের শিল্প কৌশল পূর্বাপেক্ষা উন্নত না হইলেও, আলঙ্কারিক কারুকার্য ও চিত্রাঙ্কনের দিক দিয়া উহা ছিল অপূর্ব।
আলঙ্কারিক কারুকার্য ও চিত্রাঙ্কণ
তাঁহার আমলে নির্মিত ‘দেওয়ান-ই-আম’, ‘দেওয়ান-ই-খাস’, ‘মোতি-মসজিদ’, ‘জামি মসজিদ’ প্রভৃতি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাজমহল তাঁহার সময়ের অনবদ্য সৃষ্টি। তাঁহার আমলে শিল্প কৌশলের অপূর্ব সৃষ্টি ছিল ময়ূর সিংহাসন।
ঔরঙ্গজেবের সময়ে স্থাপত্যশিল্পের অবনতি
ঔরঙ্গজেবের সময়ে তাঁহার ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামির ফলে শিল্পের প্রতি মোগল স্থাপত্য ও শিল্পের অবনতি ঘটে। তাঁহার পদ্ম পতনোন্মুখ মোগল সাম্রাজ্যে স্থাপত্য আর বিশেষ অনুরাগ প্রদর্শিত হয় নাই । তবে প্রাদেশিক কেন্দ্রগুলিতে বিশেষ করিয়া হায়দ্রাবাদ ও অযোধ্যায় উন্নত শিল্পরীতি আরও কিছুকাল বিকাশ লাভ করিয়াছিল।
- বাহাদুর শাহ দ্বিতীয় – বাহাদুর শাহ জাফর নামে পরিচিত।
- বাহাদুর শাহ তৃতীয় – মির্জা আবু জাফর সিরাজউদ্দিন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ জাফর নামে পরিচিত।
- মুহাম্মদ শাহ দ্বিতীয় – শাহ আলম দ্বিতীয় নামে পরিচিত।
- মুহাম্মদ শাহ তৃতীয় – রোশন আখতার বাহাদুর শাহ দ্বিতীয় নামে পরিচিত।
মুঘল যুগের চিত্রকলা:
ষোলো থেকে আঠারো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে পারস্য ও ভারতীয় শৈলীর মিশ্রণে মুঘল চিত্রকলা ভারতের শ্রেষ্ঠ চিত্রকলার মধ্যে অন্যতম। এই সময় কালে চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান। নিচে মোগলদের চিত্রকলা গুলি আলোচনা করা হল-
মুঘল চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য
স্থাপত্য শিল্পের ন্যায় চিত্র শিল্পেও একটি ক্রমবিকাশের ধারা লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রেও ভারতীয় শিল্পরীতির সহিত চৈনিক, বহলীক, ইরাণীয় ও মোঙ্গলীয় শিল্পরীতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়াছিল ।
আকবরের আমল হইতে মোগল সম্রাটগণের চিত্রশিল্পে ভারতীয় প্রভাবের প্রাধন্য স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। তাঁহার পূর্বে, বাবর ও হুমায়ুনের সময় পারসিক ও ইরাণীয় শিল্প-রীতির প্রাধান্য ছিল।
আকবরের পৃথক চিত্র শিল্প বিভাগ
সম্রাট আকবর আব্দুস সামাদের অধীনে একটি পৃথক চিত্র-শিল্প বিভাগ স্থাপন করিয়াছিলেন । সেখানে প্রথম শ্রেণীর ১৭ জন শিল্পীর মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন হিন্দু। তাঁহাদের মধ্যে তাঁরাচাদ, জগন্নাথ বাশোয়ান, সানওয়াল প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান
পিতার ন্যায় জাহাঙ্গীরও চিত্রকলার যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন; তাঁহার শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ সম্বন্ধে সার টমাস রো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন। তাহার পর হইতে মোগল চিত্রশিল্পের উন্নতি আর বিশেষ দেখা যায় নাই।
“With his (Jahangir’s) passing the soul of Mughul painting also departed; its outward form remained for a time…but its real spirit died with Jahangir.” – Parcey Brown.
শাহজাহান স্থাপত্য শিল্পের প্রতিই বেশী অনুরাগ প্রদর্শন করিয়াছিলেন, চিত্রশিল্পের প্রতি নয়। দারা শিকে চিত্রশিল্পের অনুরাগী ছিলেন; কিন্তু ঔরঙ্গজেব চিত্রশিল্পের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এই যুগে রাজপুত চিত্র শিল্পের বিকাশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সঙ্গীত শিল্প:
মোগলরা যে সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা ছিলেন তার বিবরণ ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় পাওয়া যায়। বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ তানসেনের কথা কে না শুনেছে। তিনি ছিলেন মুঘল দরবারের এক রত্ন। নিচে মুঘল সম্রাটদের সংগীত চর্চা নিয়ে আলোচনা করা হল-
দেশ বিদেশ হইতে সঙ্গীতজ্ঞগণের সমাবেশ
একমাত্র ঔরঙ্গজেব ব্যতীত মোগল সম্রাটগণ সকলেই সঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন। আকবরের সঙ্গীত-প্রীতি ও সর্বজন বিদিত। দেশ-বিদেশ হইতে সঙ্গীতজ্ঞগণ তাঁহার দরবারে আমন্ত্রিত হইতেন। তানসেন ছিলেন তাঁহার দরবারের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক।
জাহাঙ্গীর ও সঙ্গীত-প্রিয় ছিলেন; তিনি নিজে বহু হিন্দী সঙ্গীত রচনা করিয়াছিলেন। শাহজাহান নিজে সুগায়ক ছিলেন। ঔরঙ্গজেব ছিলেন সঙ্গীতের ঘোর বিরোধী; তাঁহার সময় হইতে মোগল সম্রাটগণ কর্তৃক সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা করা একরূপ বন্ধ হইয়া যায়।
শিক্ষা ও সাহিত্য:
মোগল বাদশারা শিক্ষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন ছিল তার বর্ণনা আমরা সেই সময় কার ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় পায়। নিচে মোগল বাদশাদের শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চা নিয়ে আলোচনা করা হল-
শিক্ষা ব্যবস্থা ও সরকার (‘মক্তব’, মঠ ও পণ্ডিত সমাজ)
বর্তমান যুগের মত শিক্ষাব্যবস্থায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব সে যুগে কোন দেশেই ছিল না, ভারতেও ছিল না। তবে সম্রাট ও শাসনকর্তাগণ যে এই বিষয়ে একেবারে উদাসীন ছিলেন তাহা নহে।
আবুল ফজল লিথিয়াছেন “হিন্দুস্তান তার শিক্ষায়তনের জন্য অন্য দেশের তুলনায় খুবই প্রসিদ্ধ।” প্রত্যেক মসজিদের সংলগ্ন ‘মক্তব’ থাকিত, মঠের কিংবা পণ্ডিতদের শিক্ষাদানে রাষ্ট্রের আনুকুল্য অনেক স্থানেই লাভ করা যাইত।
জাহাঙ্গীর শিক্ষা ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখাইতেন; তাঁহার সময়ে কোন ধনী ব্যক্তি উত্তরাধিকারী না রাখিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইলে তাহার সম্পত্তি ব্যবহার করা হইত শিক্ষার জন্য। গ্রন্থ সংগ্রহের দিকেও বাদশাহদের যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। আকবরের বিশাল গ্রন্থাগারের কথা সুবিদিত।
গ্রন্থাগার কেন্দ্রে ও প্রদেশে
হুমায়ুন নিজেই গ্রন্থাগারের সিঁড়ি হইতে পড়িয়া মৃত্যু বরণ করিয়াছিলেন। কেবলমাত্র দিল্লীতে নয়, জয়পুর, বিকানীর প্রভৃতি স্থানে রাজাদেরও বিরাট গ্রন্থাগার ছিল। কাশীতে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিরই নিজস্ব গ্রন্থাগার ছিল।
সাহিত্য সৃষ্টির দিক দিয়া মোগল আমল ভারতের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে । এ যুগে ফারসী ও হিন্দী ভাষায় যথেষ্ট চর্চা হইত; এই দুই ভাষার সংমিশ্রণে উর্দু ভাষা তখনও নিজস্ব রূপ গ্রহণ ‘আত্মজীবনী’ করে নাই।
সাহিত্যের উন্নতি অনুবাদ সাহিত্য (আত্মজীবনী)
এই সময়ে অনুবাদ সাহিত্য যথেষ্ট সৃষ্টি হয়। বাদশাহদের নির্দেশ অনুসারে রামায়ণ, মহাভারত, রাজতরঙ্গিনী, পঞ্চতন্ত্র প্রভৃতি সংস্কৃত ভাষার বহু বিখ্যাত রচনা ফারসী ভাষায় অনুবাদ হইয়াছিল।
এই যুগে লিখিত বাবরের ও জাহাঙ্গীরের আত্মকথাগুলি সাহিত্যের ভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ। বিভিন্ন বিদেশী ঐতিহাসিকগণ বাবরের ‘আত্মকথার’ ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন।
“If ever there was a case when the testimony of a single historical document unsupported by any other evidence, should be accepted as sufficient proof, it is the case with Babar’s memories.”-Lane Poole.
ইতিহাস-সাহিত্য
এই যুগের ইতিহাসে সাহিত্য সৃষ্টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবুল ফজলের ‘আকবর নামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরী’, নিজাম উদ্দিন আহম্মদ রচিত ‘তবকৎ-ই-আকবরী, বদাউনি রচিত ‘মুন্তথাব-উল-তোয়ারিখ’
শাহজাহানের রাজত্বকাল সম্বন্ধে আবদুল হামিদ লাহোরীর ‘বাদশাহনামা’, ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকাল সম্বন্ধে মির্জা মহম্মদ কাজিমের ‘আলমগীর নামা’ এবং কাফী খাঁর গ্রন্থ ‘মনতখাব-উল লুবাব’— এগুলি সমস্তই মোগল যুগের অমূল্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ।
সাহিত্যিকগণের পৃষ্ঠপোষকতা
সম্রাটগণ অনেকেই সাহিত্য ও সাহিত্যিকগণের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন। বহু কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিক তাঁহাদের দরবারে বিরাজ করিতেন। আবুল ফজল ও ফৈজী সে যুগের জ্ঞানী ব্যক্তিগণের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। ঘিজালী, হুসেন নাজিরী, জামাল উদ্দিন উরফি প্রভৃতি ছিলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি।
বাদশাহ গনের নিজস্ব সৃষ্টি
সম্রাট ও যুবরাজগণের অনেকে সুসাহিত্যিক ও লেখক ছিলেন। বাবর নিজে বাদশাহগণের নিজস্ব আরবি, ফারসী ও তুর্কী ভাষায় সুলেখক ও কবি ছিলেন। জাহাঙ্গীরের স্ব-রচিত ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’ একখানি উৎকৃষ্ট সাহিত্য। দারা শিকো পণ্ডিতগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ।
অন্যান্য ভাষা ও সাহিত্য:
মুঘল শাসকরা কেবল একটি ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। নিয়মিত নতুন নতুন ভাষা চর্চা এবং সাহিত্য চর্চা ছিল তাদের জীবনের একটি অঙ্গ। এই সময় অনেক সাহিত্য হিন্দি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
হিন্দি ভাষার উন্নতি সুরদাস ও তুলসীদাস
হিন্দী সাহিত্যের অগ্রগতি মোগল যুগের অন্যতম প্রধান ঘটনা। আকবরের উদার নীতিতে হিন্দী ভাষা যথেষ্ট উৎসাহ লাভ করিয়াছিল । কবীর রচিত দোহা, মহম্মদ জায়সী রচিত ‘পদ্মাভত’ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য।
মির্জা আবদুর রহিম, ভগবান দাস, বীরবল ইহারা সকলেই সুকবি ও সুসাহিত্যিক ছিলেন। সুরদাস ব্রজ ভাষায় কবিতা লিখিয়া খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন। তুলসীদাস রচিত ‘রামচরিত মানস’ হিন্দী সাহিত্যের এক অমূল্য গ্রন্থ ।
বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতি বৈষ্ণব সাহিত্য
মোগল আমলে বাংলা ভাষার যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছিল। বৈষ্ণব সাহিত্যের বিশেষ উৎকর্ষ সাধন এই যুগেই সম্ভব হয়। কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বৃন্দাবন দাস, জয়ানন্দ, ত্রিলোচন দাস প্রভৃতি সকলেই ছিলেন বৈষ্ণব সাহিত্যের রচয়িতা।
মঙ্গলকাব্য ও অন্যান্য সাহিত্য
মঙ্গল কাব্যের ব্যাপক রচনাও এ যুগেই রচিত হইয়াছিল। কাশীরাম দাস রচিত মহাভারত, মুকন্দরাম রচিত কবি কঙ্কণ চণ্ডী প্রভৃতিও এই যুগের সাহিত্য সমৃদ্ধির পরিচায়ক।
উর্দু ভাষার চর্চা
গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরে উর্দু ভাষা যথেষ্ট উৎকর্ষ লাভ করিয়াছিল; উর্দু ভাষায় অনেক সাহিত্যও সৃষ্টি হইয়াছিল। “গ্রন্থ-সাহেব”-এ সংগৃহীত শিখ গুরুদের উপদেশাবলী সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ ৷ মোগল যুগে মহারাষ্ট্রের সাধু সন্তদের বাণী মারাঠী ভাষায় সঙ্কলিত হইয়া ঐ ভাষাকেও সমৃদ্ধশালী করিয়াছিল ।
উপসংহার:
উপরে উল্লেখিত মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প আলোচনা করে এটা বলা সমীচীন হবেনা যে মোগল যুগে ভারত শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যতে স্বর্ণ যুগের সূচনা করেছিল।
সুতরাং ইহা স্পষ্ট যে এই মোগল যুগেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা পরিপূর্ণ রূপ গ্রহণের পথে অনেকখানি অগ্রসর হইয়া গিয়াছিল ।
FAQs মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প
প্রশ্ন: মোগল স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ কি?
উত্তর: মোগল স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল মমতাজের জন্য শাহজাহানের নির্মিত তাজমহল।
প্রশ্ন: সম্রাট শাহজাহান কি কি নির্মাণ করেন?
উত্তর: সম্রাট শাহজাহান তাজমহল, জামা মসজিদ, ওয়াজির খান মসজিদ এবং লাহোরের শালিমার গার্ডেন নির্মাণ করেন।
প্রশ্ন: সাদা মার্বেল মুঘল স্থাপত্য বলা হয় কোন ভবনকে?
উত্তর: সাদা মার্বেল মুঘল স্থাপত্য বলা হয় শাহজাহানের নির্মিত তাজমহল কে।
প্রশ্ন: নিশাত বাগ কে নির্মাণ করেন?
উত্তর: মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শ্যালক এবং নূরজাহানের ভাই আসিফ খান শ্রীনগরে নিশাত বাগ নির্মাণ করেন।
প্রশ্ন: মোগল যুগের দুটি বিখ্যাত বন্দরের নাম কি?
উত্তর: মোগল যুগের দুটি বিখ্যাত বন্দর হল গুজরাটে সুরাট এবং বাংলার হুগলি।