আজ এই লেখার মাধ্যমে গোলাম বংশের নবম সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব আলোচনা করবো। তিনি ভারতের ইতিহাসে একজন বুদ্ধিমান বাস্তববাদী রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
তবে তার সুলতান হওয়ার যাত্রাটা অতোটা সহজ ছিলনা। তাকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে সাহস ও দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে তবে তার পদকে বরণ করেছিলেন।
নিচে আমরা সুলতান গিয়াসউদ্দিনের আমলে প্রশাসন ব্যাবস্থার সংস্কার, সুলতানের মর্যাদা পুনরুদ্ধার, বিভিন্ন আঞ্চলিক বিদ্রহ দমন ও বাংলা জয়, এবং সর্বপরি সুলতানের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে তার কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করবো।
গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব । Achievements of Balban in Bengali
গিয়াসউদ্দিন বলবন ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরোহনের পরে তার ক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট ও দৃঢ় ধারণা পোষণ করেন। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল রাজতন্ত্র কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়, এটি ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বে নির্ধারিত একটি ক্ষমতা এবং যা পূরণ করার জন্য তাকে স্বৈরশাসক হওয়াটা খুবই জরুলী।
তিনি এই সব কথাকে সম্মানের সঙ্গে মাথায় রেখে তার প্রশাসনিক কাজের সূচনা করেন। এই কারণে তিনি মদ্যপান এবং অবাঞ্ছিত ফুর্তি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে রাখেন।
তার মর্যাদা ও আত্ম সম্মানে যাতে এতটুকুও দাগ না লাগে তাই তিনি জনগণ এবং অভিজাতদের সাথে দেখা করা চিরতরে বন্ধ করেন। এছাড়া তিনি তার দরবারের রাজন্যবর্গদের জন্য আলাদা পোশাকের ব্যবস্থা করেন।
রাজন্যবর্গদের সূরা পান ছিল কোঠর ভাবে নিষিদ্ধ, আদালতের আচরণকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন এই কারণে তিনি আইন প্রণয়ন করেছিলেন যা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। তাঁর দরবারে সবথেকে বড় উৎসব ছিল নওরৌজের বাৎসরিক উৎসব যা খুব ধুমধামের সহিত পালন করা হতো।
1. | নাম | গিয়াসউদ্দিন বলবন |
2. | আসল নাম | বাহাউদ্দিন |
3. | উপাধি | বলবন, উলুঘ খান, গিয়াসউদ্দিন |
4. | জন্ম | 1200 (আনুমানিক) |
5. | রাজত্বকাল | 1266-1287 |
6. | সুলতান ছিলেন | দিল্লি সালতানাতের সুলতান |
7. | বংশ | তুর্কি দাস রাজবংশ (মামলুক) |
8. | মৃত্যু | 1287 |
9. | প্রথম ক্রীতদাস হিসাবে তাকে কেনেন | খাজা জামালউদ্দিন ( ১২৩২ খ্রিস্টাব্দে) |
10 | দ্বিতীয়বার ক্রীতদাস হিসাবে তাকে কেনেন | ইলতুৎমিশ |
গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর
- অভ্যন্তরীণ আঞ্চলিক বিদ্রোহ গুলিকে সফলভাবে দমন।
- দিল্লির সালতানাতের তার প্রশাসনকে আরো শক্তিশালী করেন।
- বিভিন্ন রকম প্রশাসনিক সংস্কার গুলিকে বাস্তবায়িত করা।
- নিজে আদালতের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা।
- মঙ্গোল আক্রমণের হাত থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা
- দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরো তম ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- সালতানাতের তার ক্ষমতা যাতে অটুট থাকে তার ব্যবস্থা করা।
🔥আরও পড়ুনঃ-
সাম্রাজ্যের সঙ্কট ও বলবনের দৃঢ়তা
বলবন প্রায় চল্লিশ বৎসর শাসনকার্য পরিচালনা করিয়াছিলেন — ১৯ বৎসর নাসিরুদ্দিনের মন্ত্রী হিসাবে এবং বাকী সময় দিল্লীর সুলতানরূপে। তিনি যে সময় শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়া- ছিলেন, তখন দিল্লীর সুলতানির অত্যন্ত সঙ্কটজনক অবস্থা ।
রাজশক্তি দুর্বল এবং উপেক্ষিত, অভিজাত শ্রেণীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, চারিদিকের বিদ্রোহ ও বৈদেশিক আক্রমণ—এই সমস্ত দিল্লীর সাম্রাজ্যের বিপদ ঘনাইয়া আনিয়াছিল।
রাজশক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা
বলবন অত্যন্ত দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার সহিত এই অবস্থার সম্মুখীন হইয়াছিলেন। ইহা অনস্বীকার্য যে তিনি রাজশক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, নানা উপায়ে প্রজাবর্গ ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে একই সঙ্গে শ্রদ্ধা ও ভীতির সৃষ্টি করিয়াছিলেন।
স্বস্থ্যতা ও বিদ্রোহ দমন মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত
সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করিয়া তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের দস্যুতা ও বিভিন্ন অংশের বিদ্রোহ দমন করিয়া আভ্যন্তরীণ শান্তি ও রাজ্যের সংহতি বজায় রাখিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। বিদেশী মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধ করিয়া রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করিয়া- ছিলেন।
রাজ্যজয় সম্বন্ধে বলবনের নীতি
তিনি অবশ্য সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করেন নাই সত্য, কিন্তু রাজ্যের তদানীন্তন অবস্থায় তাহা না করাই তাঁহার কূটনীতির পরিচয় বহন করে। দেশে রাজকীয় মর্যাদা বৃদ্ধি, অভিজাত শ্রেণীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্রোহ দমন করিয়া তুর্কী শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করাই ছিল তাঁহার প্রধান ও প্রথম কর্তব্য।
মোঙ্গল আক্রমণ হইতে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করা ছিল তাঁহার একটি প্রধান দায়িত্ব । এই সমস্ত কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করিবার পূর্বে তিনি রাজ্য জয়ের ঝুঁকি লইতে পারেন নাই ৷
সামরিক শক্তি গঠন ও প্রয়োগ
তিনি ছিলেন সামরিক শক্তিতে বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করিতেন যে একমাত্র সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করিয়াই রাজ্যের সংহতি বজায় রাখা সম্ভব। তাই তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়া সামরিক ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করিয়াছিলেন।
এ-কথা সত্য যে তিনি এই সামরিক শক্তিকে অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম ভাবে ব্যবহার করিয়াছিলেন। কিন্তু শিশু তুর্কী রাষ্ট্রকে রক্ষা করিবার জন্য হয়ত সে নির্মমতার প্রয়োজন ছিল। দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনীকে সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা তাঁহার কম কৃতিত্বের পরিচয় নয়।
শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সামরিক শাসন
শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারেও বলবনের কৃতিত্ব আছে। তিনি দস্যুবৃত্তি উৎখাত করিয়া এবং অভিজাত শ্রেণীর স্বেচ্ছাচার দমন করিয়া দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা আনয়ন করিয়াছিলেন। অবশ্য তিনি যে শাসন- ব্যবস্থা প্রবর্তন করিয়াছিলেন তাহা সামরিক শাসনব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ব্যাপারে তাঁহার বিশেষ কিছু নূতন দান ছিল না।
গুপ্তচর বাহিনী জনগণের স্বাধীনতা
তবে তিনি ইসলামীয় ‘শরিয়ৎ’ অনুসরণ করিতেন, উলেমাদিগের প্রতিপত্তি রক্ষা করিবার জন্য সর্বদা তৎপর থাকিতেন। শাসন ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে তিনি গুপ্তচর বাহিনী নিয়োগ করিয়াছিলেন।
গুপ্তচরগণের সাহায্যে তিনি দেশের সকল অংশ হইতে যাবতীয় অত্যাচার, অবিচার, ষড়যন্ত্র প্রভৃতির সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ইহাতে স্বভাবতঃই জনগণের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ব্যাহত হইয়াছিল। অবশ্য ইহা ছাড়া বলবনের উপায়ান্তর ছিল না।
বিচার ব্যবস্থা পক্ষপাতহীন
বিচার বিষয়ে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। তিনি ছিলেন ন্যায় বিচারের সমর্থক এবং যাহাতে কোন প্রকার পক্ষপাতিত্ব না ঘটিতে পারে তাহার জন্য তিনি ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন। অভিজাত সম্প্রদায়ের বিশেষ ক্ষমতাগুলির তিনি অবসান ঘটাইয়া ছিলেন এবং প্রয়োজন হইলে তিনি তাহাদেরও শাস্তি বিধান করিতে দ্বিধা করেন নাই ৷
অনুষ্ঠান প্রিয়তা চরিত্রের নিষ্কলুষতা ও উদারতা
তিনি কিছুটা অনুষ্ঠান প্রিয় ছিলেন। পারসিক আদবকায়দা গ্রহণ তাহার প্রমাণ দেয়। তবে সেগুলির রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তাই তাঁহার নিকট বেশী গুরুত্ব বহন করিত। ব্যক্তিগত চরিত্রে তিনি ছিলেন নিষ্কলুষ। তাঁহার মন ছিল উদার। তিনি মোঙ্গল আক্রমণে মধ্য এশিয়া হইতে বিতাড়িত পনেরজন রাজাকে তাঁহার রাজসভায় স্থান দিয়াছিলেন ।
গুণীর সমাদর ধর্মভীরু
গুণীর সমাদরে তিনি কথনও পরাঙ্মুথ ছিলেন না। ঐ সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, ‘ভারতের তোতাপাখী’ বলিয়া পরিচিত, আমীর খুসরভ তাঁহার সমাদর লাভ করিয়াছিলেন। ঐতিহাসিক মিনহাজ-উদ্দিন তাঁহারই সভা অলঙ্কৃত করিতেন। তিনি ছিলেন ধর্মভীরু, ভগবান-প্রদত্ত রাজক্ষমতায় বিশ্বাসী এবং সুলতান হিসাবে আত্মমর্যাদায় পূর্ণ ।
অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা
তুর্কী সাম্রাজ্যকে সংহত করিয়া এবং উহার নিরাপত্তা বিধান করিয়া বলবন উহাকে নবজীবন দান করিয়াছিলেন। শাসনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনয়ন করিয়া এবং বিচার ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতার আদর্শ স্থাপন করিয়া বলবন ভারতে মুসলমান শাসনকে দৃঢ়ভিত্তির উপর স্থাপন করিয়াছিলেন । সেইজন্যই বলবন দিল্লীর সুলতানগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন ।
উপসংহার
উপরে উল্লেখিত গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব আশাকরি আপনাদের ভাললেগেছে। প্রথম জীবনে মােঙ্গলদের হাতে বন্দী, তার পর ক্রীতদাস হিসেবে প্রথমে খাজা জামালউদ্দিন তার পরে ইলতুৎমিশের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তীকালে তার সাম্রাজ্যের শিখরে বসাটা কোনো চমৎ কারের থেকে কম ছিলনা।
তার কৃতিত্ব নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক সমালোচনা করলেও ভারতের ইতিহাসে তার অবদান অস্বীকার করা যাবেনা। বিশেষ করে তার তৈরী করা পথে পরবর্তীকালের শাসকদের এগোতে সুবিধা হয়েছিল। যেটি তার মর্যাদাকে অনেকটায় বাড়িয়ে দেয়।
FAQs গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব
প্রশ্ন: গিয়াসউদ্দিন বলবন কত খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন?
উত্তর: গিয়াসউদ্দিন বলবন ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন।
প্রশ্ন: গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রকৃত নাম কি?
উত্তর: গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রকৃত নাম বাহাউদ্দিন।
প্রশ্ন: গিয়াসউদ্দিন বলবন কি কি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
উত্তর: অভিজাত, গভর্নর এবং আঞ্চলিক প্রধানদের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং অসন্তোষ, মঙ্গোল আক্রমণের হুমকির সম্মুখীন এবং তার পরবর্তীতে কে উত্তরাধিকারি হবে তা নিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিলেন।
প্রশ্ন: সুলতান সম্পর্কে বলবনের কী ধারণা ছিল?
উত্তর: বলবন সুলতানকে ঈশ্বরের ছায়া বলে জনগণকে বিশ্বাস করিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: বলবন সুলতান হয়ে কোন কোন দুর্গ সুরক্ষিত করেন?
উত্তর: গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লির সুলতান হবার পর তিনি তার সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাকে জোরদার করেন। তিনি নতুন নতুন দুর্গ নির্মাণ করেন এছাড়া রণথম্ভোর দুর্গ, নাগরকোট দুর্গ ইত্যাদিকে সুরক্ষিত করেন।