আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। 998 খ্রিস্টাব্দে 27 বছর বয়সে গজনীর মাহমুদ উত্তরাধিকারী সূত্রে সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্ব ছিল মধ্য এশিয়ায় একটি বিশাল এলাকা জুড়ে।
তিনি সিংহাসন আরোহনের সময় “সুলতান” উপাধি ধারণ করেন যার আক্ষরিক অর্থ হল কর্তৃত্ব অর্থাৎ তার ক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে। তার জীবনকালে 1000 থেকে 1027 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট 17 বার ভারত আক্রমণ করেন, যা ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান । Mahmud Ghazni First Attack in India in Bengali
ক্রমিক সংখ্যা | সাল | স্থান |
1. | 1000 খ্রিস্টাব্দ | মুলতান |
2. | 1001 খ্রিস্টাব্দ | মথুরা |
3. | 1002 খ্রিস্টাব্দ | নাগরকোট |
4. | 1003 খ্রিস্টাব্দ | থানেসর |
5. | 1004 খ্রিস্টাব্দ | কনৌজ |
6. | 1005 খ্রিস্টাব্দ | ওয়েহিন্দ |
7. | 1008 খ্রিস্টাব্দ | মুলতান (দ্বিতীয় বার) |
8. | 1011 খ্রিস্টাব্দ | কাশ্মীর |
9. | 1013 খ্রিস্টাব্দ | থানেসর (দ্বিতীয় বার) |
10. | 1014 খ্রিস্টাব্দ | পাঞ্জাব |
11. | 1015 খ্রিস্টাব্দ | থানেশ্বর (তৃতীয় বার) |
12. | 1018 খ্রিস্টাব্দ | গজনি |
13. | 1019 খ্রিস্টাব্দ | কালিঞ্জার |
14. | 1021 খ্রিস্টাব্দ | সোমনাথ |
15. | 1022 খ্রিস্টাব্দ | গুজরাট |
16. | 1023 খ্রিস্টাব্দ | পাঞ্জাব (দ্বিতীয় বার) |
17. | 1027 খ্রিস্টাব্দ | পাঞ্জাব (তৃতীয় বার) |
🔥আরও পড়ুনঃ-
সবুক্তগীনের ভারত আক্রমণ ও তাহার তাৎপর্য
আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে গজনীরাজ্য অবস্থিত ছিল। গজনীর সুলতান সবুক্তগীন কয়েকবার উত্তর-পশ্চিম ভারতস্থ শাহীবংশের হিন্দুরাজা জয়পালের রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে কাবুল ও তাহার নিকটবর্তী কতক অঞ্চল সমর্পণে বাধ্য করিয়াছিলেন।
১৯৭ খ্রীষ্টাব্দে সবুক্তগীনের মৃত্যুর ফলে তিনি ভারতে বেশীদূর অগ্রসর হইতে পারেন নাই’ সত্য, কিন্তু তিনি তাঁহার বংশধরের জন্য ভারত অভিযানের একটি ইঙ্গিত রাখিয়া গিয়াছিলেন।
সুলতান মামুদের ১৭ বার ভারত অভিযান
সবুক্তগীনের পুত্র মামুদ ১৯৭ খ্রীষ্টাব্দে গজনীর সিংহাসনে আরোহণ করিয়া কয়েক বৎসরের মধ্যেই পারস্যরাজ সামানিদ বংশের আনুগত্য অস্বীকার করিলেন এবং নিজেকে স্বাধীন সুলতান বলিয়া ঘোষণা করিলেন। অতঃপর তিনি পিতার আরব্ধকার্য সম্পন্ন করিবার জন্য ভারত অভিযানের দিকে দৃষ্টি দিলেন।
তিনি মোট কতবার ভারতবর্ষ আক্রমণ করিয়াছিলেন সে সম্বন্ধে ঐতিহাসিক- গণের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে সার হেনরী ইলিয়ট (Sir Henry Elliot)-এর মতে তিনি মোট সতের বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করিয়াছিলেন ।
অভিযান সুলতান মামুদের প্রথম
১০০০ হইতে ১০২৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে প্রায় প্রতি বৎসরই অভিযান পরিচালিত করিয়া সুলতান মামুদ সতের বার ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। প্রথমবার তিনি আক্রমণ করেন খাইবার গিরিপথের সীমান্তবর্তী কয়েকটি শহর।
জয়পায়ের বিরুদ্ধে অভিঙ্গান
ঠিক তাহার পরের বৎসরই তাঁহার দ্বিতীয় অভিযান পরিচালিত হয় শাহীবংশের রাজা জয়পালের বিরুদ্ধে। পেশোয়ারে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয়।
মাসুদ যুদ্ধে জয়ী হইয়া জয়পালকে বন্দী করেন। প্রচুর ধনদৌলতের বিনিময়ে জয়পাল মুক্ত হইলেন বটে, কিন্তু এ অপমান সহ করিতে না পারিয়া তিনি পুত্র আনন্দপালের হস্তে রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া জল চিতাগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দিলেন।
পঞ্চম অভিধান আনন্দপালের বিরুদ্ধে
ইহার পরবর্তী দুইটি অভিযানে তিনি ‘ভীর’ ও ‘মুলতান’ জয় করিয়া ১০০৮ ইষ্টাব্দে শাহীবংশের রাজা আনন্দপালের বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্রসর হইলেন।
আনন্দপালের প্রচেষ্টায় উজ্জয়িনী, গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর, কনৌজ, দিল্লী ও আজমীঢ়-এর রাজগণ ঐক্যবদ্ধ হইলেন। তাঁহাদের সম্মিলিত বাহিনীর সহিত পেশোয়ার ও উপ-এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে সুলতান মামুদের তুমুল যুদ্ধ বাধিল। কিন্তু দৈবদুর্বিপাকে এ যুদ্ধে তাঁহাদের পরাজয় হইল ।
আনন্দপালের পরাজয় কাংড়া দুর্গ লুন্ঠিত
অতঃপর সুলতান মামুদ নগরকোট বা কাংড়া দুর্গ অধিকার করিলেন এবং অভাবনীয় পরিমাণ ধনদৌলত হস্তগত করিয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিলেন। এই ধনদৌলত হস্তগত হওয়ার কলে মামুদ আরও শক্তিশালী হইয়া উঠিলেন এবং ধনদৌলত লুণ্ঠনের জন্য তিনি আরও আগ্রহশীল হইয়া উঠিলেন।
থানেশ্বর জয় (১০১৮) কনৌজ ও মথুরার বিরুদ্ধে অভিযান
তাহার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য অভিযান থানেশ্বর আক্রমণ এবং ইহা ছিল তাহার দশম অভিযান। থানেশ্বর জয় করিয়া তিনি সেখানকার মন্দিরস্থ বিগ্রহ- গুপি চূর্ণ-বিচূর্ণ করিলেন এবং যাবতীয় ধনরত্ন লুণ্ঠন করিয়া দেশে প্রত্যাবর্তন করিলেন। ১০১৮ খ্রীষ্টাকে তাঁহার দ্বাদশ অভিযান পরিচালিত হইয়াছিল কনৌজ ও মথুরার বিরুদ্ধে।
মথুরার মন্দির ধ্বংস ও লুণ্ঠন
কনৌজের রাজা রাজ্যপাল পলায়ন করিয়া নিজের জীবন বাচাইলেন, আর সুলতান মামুদ সমস্ত দুর্গ জয় করিয়া, মন্দির বাস করিয়া অগাধ ধনরত্নাদিসহ দেশে প্রত্যাবর্তন করিলেন।
হিন্দু শিল্প ও স্থাপত্যের বিশ্বয়কর নিদর্শন মথুরার মন্দিরটি এই সময়ে ধ্বংস ও ভষ্মীভূত করা হয়। অতঃপর পর পর কয়েকটি অভিযানে সুলতান মামুদ গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর প্রভৃতি জয় করিয়া প্রকৃত পরিমাণ ধনসম্পত্তি লাভ করিলেন।
সোমনাথের মন্দির লুণ্ঠন
সুলতান মামুদ ১০২৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার ষোড়শ অভিযান পরিচালিত করিলেন কাথিয়াবাড়-এর সোমনাথের মন্দিরের অভিমুখে। চতুর্দিক হইতে বহুসংখ্যক রাজপুত রাজা ও যোদ্ধাগণ এই মন্দির রক্ষার্থে অগ্রসর হইয়াছিলেন ; কিন্তু এক ভীষণ যুদ্ধের পর মামুদ জয়লাভ করিলেন।
তাঁহার আদেশে মন্দিরের বিগ্রহগুলি ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইল । এই মন্দির হইতে দুই কোটি স্বর্ণমুদ্রা এবং প্রভূত পরিমাণ অলঙ্কারাদি ও মণিমুক্তা সহ তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
১০২৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার সর্বশেষ অভিযান পরিচালিত হইয়াছিল জাঠদের শাস্তি দিবার জন্য। ইহার তিন বৎসর পর ১০৩০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয় ।
সুলতান মাহমুদ কে ছিলেন?
গজনভিদ সাম্রাজ্যের একজন বিশিষ্ট শাসক ছিলেন সুলতান মাহমুদ, যিনি গজনীর মাহমুদ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি তার রাজত্বকালে 998 থেকে 1030 সাল পর্যন্ত একাধিকবার ভারতীয় উপমহাদেশে সামরিক অভিযান চালান। তিনি ভারতের একাধিক মন্দির লুণ্ঠন করে প্রচুর ধন সম্পদ নিয়ে যান।
মামুদের অভিযানের প্রকৃতি (Nature of Mahmud’s Campaigns):
স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা তাঁহার পরিকল্পনার বহির্ভূত
সুলতান মামুদের ভারত অভিযানগুলির পশ্চাতে সাম্রাজ্য বিস্তারের কোন উদ্দেশ্য ছিল বলিয়া মনে হয় না। পাঞ্জাবের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য সামরিক প্রয়োজনে তাঁহাকে উহা নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করিতে হইয়াছিল; কিন্তু অন্য কোন স্থান সম্বন্ধে তাঁহার সেরূপ কোন প্রচেষ্টাই পরিলক্ষিত হয় না ।
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে দুর্ধর্ষ রাজপুত জাতিকে সম্পূর্ণভাবে পদানত করিয়া তাহাদের রাজ্যগুলি গজনীর শাসনাধীনে রাখা তাঁহার সামরিক শক্তির বহির্ভূত ছিল। কারণ মধ্য এশিয়ায় তাঁহার বিশাল বিস্তৃত সাম্রাজ্যের প্রতি তাঁহাকে সর্বদাই দৃষ্টি রাখিতে হইত।
ধর্ম প্রচার বা বিজয়- গৌরবের প্রশ্ন
ধর্ম প্রচার মামুদের উদ্দেশ্য ছিল না; কারণ তাঁহার অভিযানগুলির সাফল্য লাভের পরও তিনি কোথায়ও হিন্দুদিগকে ধর্মান্তরিত করিবার চেষ্টা করেন নাই। বিজয় গৌরব অর্জন তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল বলা যায় না; কারণ বিজয়ীর উদারতা তাঁহার ব্যবহারে কোথাও পরিলক্ষিত হয় নাই ।
পৌত্তলিকতার হত্যা, মন্দির ধ্বংস ও ধনরত্ন লুণ্ঠন
ডক্টর স্মিথ বলিয়াছেন যে সুলতান মামুদ সেই যুগের ধর্মান্ধ ও দুর্ধর্ষ তুর্কী মুসলমানদের নেতৃত্ব করিয়াছিলেন মাত্র । পৌত্তলিকদের হত্যা, তাহাদের মন্দির ও বিগ্রহাদি ধ্বংস এবং সর্বোপরি ধনরত্ন লুণ্ঠন তাঁহার অভিযানগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল। প্রতিটি অভিযানে তিনি এই উদ্দেশ্য কার্যকরী করিয়াছেন।
মামুদের সাফল্যের কারণ (Causes of Mahmud’s Success):
মামুদ অত্যন্ত নৃশংসভাবে ভারতবর্ষে একের পর এক তাঁহার অভিযান চালাইয়া সাফল্য লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার এই সমস্ত সাফল্যের পশ্চাতে কয়েকটি কারণ ছিল।
সমরকুশলী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিন্তু ধর্মান্ধ
(ক) প্রথমতঃ, তিনি ছিলেন অসাধারণ সমর কুশলী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ধর্মান্ধ এবং ঐ একই চরিত্রের তুর্কী মুসলমানদের নেতৃত্ব করিয়া তিনি দুর্দমনীয় এবং দুর্ধর্ষ হইয়া উঠিয়াছিলেন।
রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও ঐক্যের অভাব
(খ) দ্বিতীয়তঃ, ভারতে একটি সার্বভৌম রাজশক্তির অভাব এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ মামুদের সাফল্যের পথ পরিষ্কার করিয়া দিয়াছিল। মধ্য এশিয়ার তুর্কীরা দৈহিক শক্তিতে বলশালী এবং কষ্টসহিষ্ণু ছিল, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ শক্তি দ্বারা তাহাদের অনায়াসে পরাজিত করা যাইত। ভারতে সেই একতার অভাব ছিল।
বুদ্ধকৌশল
(গ) যুদ্ধ কৌশলেও ভারতীয়গণের তুলনায় তুর্কীরা ছিল শ্রেষ্ঠ। হিন্দুগণের চিরাচরিত হস্তীবাহিনী ও পদাতিক সৈন্য মামুদের অশ্বারোহী বাহিনীর সম্মুখে টিকিতে পারে নাই । এই সমস্ত কারণে একের পর এক যুদ্ধে তাহাদের পরাজয় বরণ করিতে হইয়াছে ।
মামুদের চরিত্র ও ক্বতিত্ব (Character and Estimate):
বুদ্ধিমান ও ধর্মভীরু ন্যায়পরায়ণ ও সুবিচার
ভারতবর্ষে সুলতান মামুদের কার্যকলাপ এবং তাঁহার রাজসভায় কবি, সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকগণের রচনা হইতে তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়।
তাঁহার সভাকবিদের রচনা হইতে জানা যায় যে তিনি বুদ্ধিমান ও ধর্ম-ভীরু ছিলেন এবং সাধারণতঃ ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের পক্ষপাতী ছিলেন। তবে মাঝে মাঝে স্বার্থসিদ্ধির জন্য নীচতার আশ্রয় গ্রহণ করিতেও তিনি কুন্ঠিত হইতেন না; তাঁহার ধর্মপরায়ণতা মাঝে মাঝে ধর্মান্ধতায় পর্যবসিত হইত।
ধর্মান্ধ ও অর্থলোলুপ
সব সময়ে তাঁহার মেজাজের ঠিক থাকিত না; প্রয়োজনবোধে তিনি বন্ধুদের প্রতিও অবিশ্বস্ত হইয়া উঠিতেন। তিনি ছিলেন অর্থলোলুপ। গজনীর রাজসভার ঐতিহাসিক ইবন-উল-আথির মামুদের অর্থ-লোলুপতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন।
সামরিক প্রতিষ্ঠা
ভারত অভিযানগুলির মধ্যে তাহার অনেক দৃষ্টান্ত রহিয়াছে। তবে তিনি যে একজন বিচক্ষণ ও অনন্যসাধারণ সমর কূশলী সেনানায়ক ছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। অনেকেই তাঁহার সামরিক প্রতিভার প্রশংসা করিয়াছেন ।
সাম্রাজ্য বিস্তারকারী ও শাসক হিসাবে কৃতিত্ব
সুলতান মামুদের কৃতিত্বের কথা আলোচনা করিতে যাইয়া অনেকে তাঁহার সামরিক সাফল্য এবং ক্ষুদ্র গজনী রাজ্যকে একটি বিরাট সাম্রাজ্যে পরিণত করার কথা উল্লেখ করিয়াছেন।
তাঁহার বিশাল সাম্রাজ্যে তিনি আভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করিতেও সমর্থ হইয়াছিলেন; ইহা তাঁহার শাসন দক্ষতার নিদর্শন । কিন্তু প্রচলিত শাসন পদ্ধতিকে উন্নত করিবার মত কোন মৌলিক প্রতিভার পরিচয় তিনি দিতে পারেন নাই ।
কবি ও সাহিত্যানুরাগী শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক
তিনি নিজে নিরক্ষর হইয়াও কবি ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। ‘শাহ নামা’ রচয়িতা ফিরদৌসী, ঐতিহাসিক উত্তী, দার্শনিক ফারাবী, কবি আনসারী প্রভৃতি তাঁহার রাজসভা অলংকৃত করিতেন ।
অলবিরুণীও কিছুকাল তাঁহার রাজসভায় ছিলেন ।তিনি গজনীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন । একটি যাদুঘর ও একটি গ্রন্থাগার স্থাপনও তাঁহার ক্বতিত্ব । সুতরাং এ কথা বলা যায় যে তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ৷
শিল্পানুরাগ সর্বত্র স্বার্থপরতা ও সঙ্কীর্ণতা
শিল্প সৃষ্টিতেও তাঁহার অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। গজনী নগরীতে সুন্দর সুন্দর গৃহাদি নির্মাণে ও তাহার সৌন্দর্য বর্ধনে তিনি মুক্ত হস্তে দান করিয়াছিলেন। কিন্তু একথার যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে তাঁহার সাহিত্যানুরাগ ও শিল্পানুরাগ অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল ; সমস্ত কিছুর অন্তরালে তাঁহার আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিই ছিল প্রধান ।
ভারত ইতিহাসে তাঁহার স্থান পরধর্মদ্বেষী ও লুণ্ঠনকারী হিসাবে
কিন্তু ভারত ইতিহাসে সুলতান মামুদ কোন কৃতিত্বই রাখিয়া যাইতে পারেন নাই। ভারতীয়দের নিকট তিনি অর্থলোলুপ ও দেব দেবীর মন্দির লুণ্ঠনকারী হিসাবে পরিচয় রাখিয়া গিয়াছেন।
ইসলাম ধর্মের কোন মহান আদর্শও তিনি এখানে রাখিয়া যাইতে পারেন নাই। ভারতীয় ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করিয়া নিজদেশে শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দেখাইলেও ভারতীয়গণের নিকট তিনি একজন লুণ্ঠনকারী ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না।
মামুদের ভারত-অভিযানের ফলাফল (Results):
কয়েকটি স্থায়ী ফল গাঞ্জাবের কিছু অংশের উপর আধিপত্য
সুলতান মামুদ প্রধানতঃ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যেই ভারতে অভিযানগুলি পরিচালিত করিয়াছিলেন, সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য নহে। সুতরাং ভারতবর্ষে তখন হইতেই মুসলমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও সেই অভিযানগুলির কয়েকটি স্থায়ী ফল দেখা গিয়াছিল।
ভারতীয়দের মনে ভয়ের সঞ্চার অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল
সামরিক প্রয়োজনে মামুদ পাঞ্জাবের কিছু অংশের উপর তাঁহার নিজ আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন। সুলতান মামুদের যথেচ্ছাচার লুণ্ঠনের ফলে একদিকে যেমন মুসলমান আক্রমণকারীদের সম্বন্ধে ভারতবাসীদের মনে ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল, অপরদিকে তেমনি তাহাদের অর্থ- নৈতিক ভিত্তিও দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল।
ভারতের সামরিক শক্তি বিধ্বস্ত, ইসলাম সম্বন্ধে ঘৃণা সৃষ্টি
সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার অভিযানগুলির ফলে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির সামরিক শক্তিও কিছুটা বিধ্বস্ত হইয়া গিয়াছিল । এইজন্য পরবর্তী মুসলমান আক্রমণগুলিতে প্রতিরোধ করিবার শক্তি হ্রাস পাইয়াছিল।
সর্বশেষে মামুদ তাঁহার কার্যাবলী দ্বারা ভারতবর্ষে ইসলাম সম্বন্ধে যে ঘৃণার ভাব সৃষ্টি করিয়াছিলেন তাহারই জন্য ভবিষ্যতে ভারতবর্ষে মুসলমান ধর্ম প্রবর্তনে অনেক বাধার সৃষ্টি হইয়াছিল।
উপরসংহার
11 শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ভারতের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্পদ আহরণ এবং ইসলাম ধর্মকে প্রচার করা। তাই তিনি একের পর এক মোট ১৭ বার ভারত আক্রমণ করে ভারতবর্ষের মন্দির, প্রাসাদ এবং শহর লুটপাট করে।
সোনা, রুপা, মূল্যবান পাথর এবং অন্যান্য মূল্যবান ধন-সম্পদ লুট করে তিনি প্রচুর ধন-সম্পদের সঞ্চয় করে ছিলেন। তার সময়কালে বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করা হয় আর স্থানীয় জনগণকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয় ।
FAQs সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান
প্রশ্ন: সুলতান মাহমুদ কত সালে ভারত আক্রমণ করে?
উত্তর: সুলতান মাহমুদ প্রথম 1000 খ্রিস্টাব্দে ভারত আক্রমণ করে।
প্রশ্ন: মাহমুদের ভারত আক্রমণের কারণ কি ছিল?
উত্তর: মাহমুদের ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ধন সম্পদ লুটপাট করা।
প্রশ্ন: সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষের শেষ অভিযান পরিচালনা করেন কত খ্রিস্টাব্দে?
উত্তর: সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষের শেষ অভিযান পরিচালনা করেন 1026-1027 খ্রিস্টাব্দে (সারহিন্দের যুদ্ধ)।
প্রশ্ন: সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষের শেষ অভিযান করেন কত খ্রিস্টাব্দে?
উত্তর: 1027 খিষ্টাব্দ ছিল সুলতান মাহমুদের ভারতবর্ষে শেষ অভিযান।
প্রশ্ন: সুলতান মাহমুদ কত সালে সোমনাথ মন্দির অভিযান করেন
উত্তর: সুলতান মাহমুদ 1027 সালে সোমনাথ মন্দির অভিযান করেন, যেটি ছিল ভারতবর্ষে তার শেষ অভিযান।