দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তৃতীয় বিশ্বের উত্থান। ঠান্ডা লড়াই-এর উত্তেজনা প্রসূত পরিস্থিতিতে ধনতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলি আপন আপন স্বার্থে কতকগুলি সামরিক জোটে আবদ্ধ হয়েছিল। তার মধ্যে রূপালি রেখা দেখা দিয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভবে।
তৃতীয় বিশ্বের ধারণা:
ফ্রানজ ফ্যানন (Frantz Fanon) -এর ধারণা
‘তৃতীয় বিশ্ব’ ধারণাটির জন্মদাতা আলজেরিয়ার সাহিত্যিক ফ্রানজ ফ্যানন (Frantz Fanon)। রেচেড অব দি আর্থ বইতে তিনি বলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক ও পাশ্চাত্য বিশ্ব রাজনীতিতে যে দ্বি-মেরুকরণ শুরু করে তার বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা, ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত দেশগুলি নিয়েই তৃতীয় বিশ্ব গঠিত।
ডেভিড হরোউইজ (David Horowitz) -এর ধারণা
ডেভিড হরোউইজ ( From valta to vietnam’) অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৃতীয় বিশ্বের ধারণা ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পিত অর্থনীতির কোনোটিই গ্রহণ না করে, যারা সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারায় অর্থনৈতিক বিকাশের পথে অগ্রসর হয়েছে তারাই তৃতীয় বিশ্ব বলে অভিহিত হয়।
মাও-সে-তুং (Mao Zedong) -এর ধারণা
আবার মাও-সে-তুং-এর মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়াকে প্রথম বিশ্ব বলে অভিহিত করেছেন। কারণ উভয়ই সাম্রাজ্যবাদী এবং উভয়ের লক্ষ্য সমগ্র বিশ্বের উপর আধিপত্য বিস্তার করা।
আর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড এবং পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্ব গঠিত। এরা প্রথম বিশ্ব কর্তৃক নিপীড়িত হয় এবং তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির ওপর অত্যাচার চালায়। তাঁর মতে, এশিয়া ও আফ্রিকার সেই সমস্ত দেশ তৃতীয় বিশ্ব বলে বিবেচিত যারা কোনো ইউরোপীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন নয় বা কমিউনিস্ট সরকারের দ্বারাও পরিচালিত নয়।
যাই হোক, পাশ্চাত্য জগৎ ও সোভিয়েত রাশিয়া এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের বাইরে অবস্থিত ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সদস্যমুক্তি প্রাপ্ত এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিকে তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত বলা যায়। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে দারিদ্র্য ছিল এই দেশগুলির মানুষের নিত্যসঙ্গী। শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, বাণিজ্য, সামরিক সকল দিক দিয়েই এরা ছিল অনুন্নত।
তাই স্বাধীনতা পাওয়ার পর দেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী করে তোলা ছিল তাদের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন। তাই আপন স্বার্থেই এই সব রাষ্ট্র কোনো জোটেই যোগ না দিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের বাইরে থাকার নীতি গ্রহণ করে। জোট নিরপেক্ষ এই সব রাষ্ট্রকেই নিয়ে গড়ে উঠেছিল তৃতীয় বিশ্ব।
🔥আরও পড়ুনঃ-
তৃতীয় বিশ্বের বৈশিষ্ট্য:
সাদৃশ্য:
তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় ঃ
(১) তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরোধী। কারণ এই দেশগুলি ঔপনিবেশিক বা আধা ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল এবং দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
(২) তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কারিগরি বিদ্যা, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতিতে আজও অপেক্ষাকৃতভাবে পিছিয়ে থাকায় উন্নত পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলি বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির সাহায্যে প্রাধান্য স্থাপনের জন্য সচেষ্ট।
(৩) অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ হওয়ায় উন্নয়নের জন্য নানা দিক থেকে তারা উন্নত দেশগুলির মুখাপেক্ষী।
(৪) আধুনিকীকরণ ও দ্রুত আর্থিক বিকাশের মাধ্যমে শক্তি ও সংহতি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট।
(৫) দেশগুলি মূলত কৃষিনির্ভর এবং কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক কৃৎকৌশলের প্রসার তেমন ভাবে ঘটেনি। ক্ষুধা, অন্ধত্ব, দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী।
(৬) তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
বৈসাদৃশ্য:
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে কিছু পার্থক্যও লক্ষ করা যায়। যেমন –
(ক) কিছু দেশ আয়তনে বড়ো আর কিছু দেশ আয়তনে ছোটো।
(খ) কিছু দেশ অপেক্ষাকৃত ধনী আবার কিছু দেশ দরিদ্র।
(গ) কোনো কোনো দেশ ধর্মনিরপেক্ষ আবার কোনো কোনো দেশ ধর্মভিত্তিক।
(ঘ) কোনো কোনো দেশ পুঁজিবাদী, কোনো দেশ সমাজতন্ত্রী আবার কোনো কোনো দেশ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী।
(ঙ) এখানকার দেশগুলিতে রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, দায়িত্বশীল সরকার, সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো সবই আছে।
(চ) কতকগুলি দেশ যেমন পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, নাইজেরিয়া প্রভৃতি পুঁজিবাদী মার্কিন জোটের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে ভিয়েতনাম, কিউবা, নিকারাগুয়া প্রভৃতি সমাজতন্ত্রী শিবিরের প্রতি অনুগত। আবার ভারত, শ্রীলংঙ্কা প্রভৃতি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পক্ষে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তৃতীয় বিশ্বের প্রভাব:
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তৃতীয় বিশ্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তৃতীয় বিশ্বের উত্থানে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরিবর্তন ও ব্যাপ্তি এসেছে নানাভাবে।
(১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ফলে অনেক নতুন দেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করে বিশ্ব রাজনীতিকে জটিল ও বৈচিত্র্যময় করে তুলতে সাহায্য করেছে।
(২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়া তৃতীয় বিশ্বকে অবজ্ঞা করতে পারেনি। উভয় রাষ্ট্রই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সাহায্য পাওয়ার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং নানাভাবে ওই দেশগুলিকে সাহায্য করতে থাকে।
(৩) তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল বলে দেশগুলি নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন, জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা ও দাবি উত্থাপন করে।
(৪) যখন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন এক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তখন থেকেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি একত্রিত হয়ে বর্ণবৈষম্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের প্রতিবাদ করে আসছে।
(৫) তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি অনেক আন্তর্জাতিক বিবাদে সক্রিয় ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। সেই সঙ্গে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মাধ্যমে নিজেদের বহু সমস্যার সমাধান করেছে। এ প্রসঙ্গে কোরিয়ার যুদ্ধ, কিউবা সংকট, ইন্দোচিন সমস্যার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সুতরাং বলা যায়, বর্তমান বিশ্বেও তৃতীয় বিশ্ব এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী।
উপসংহার:
বর্তমানে অনেক তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। মূলত তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মাথাপিছু কম জিডিপি, অত্যধিক কৃষির উপর নির্ভরতা, দারিদ্র্যতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে শ্রেণী বদ্ধ করা হয়েছিল।
এই সমস্ত দেশ গুলির উন্নয়নের জন্য এবং শান্তি রক্ষাত্রে বিদেশী সাহায্যের উপর অত্যাধিক নির্ভরশীলতা দেখতে পাওয়া যায়।