একদা সাংবাদিক ও সৈনিক বেনিতো মুসোলিনী প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির নৈরাজ্য পরিস্থিতির সুযোগে প্রাক্তণ সৈনিক ও দেশপ্রেমী যুবকদের নিয়ে ফ্যাসিস্ত দল গঠন করে বিশ্ব সভ্যতার পথিকৃৎ হিসাবে শক্তিশালী ইতালির কথা বলেন।
আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান সীমিত সুযোগ-সুবিধা লাভ করে পররাজ্য গ্রাসে আরও উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দুই দেশেই উগ্র জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। আমরা তা আলোচনা করব।
ফ্যাসিস্ত দর্শন:
‘ফ্যাসিও’ শব্দের অর্থ দণ্ডের আটি’। প্রাচিন রোমের রাজশক্তির প্রতীক এই ফ্যাসিও থেকে মুসোলিনী দলের নাম রাখেন ‘ফ্যাসিস্ট’। এই দলের দর্শন হ’ল, বর্তমান দূরাবস্থা, বামপন্থী অরাজকতা, সংসদীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতার হাত থেকে মুক্তি।
রোমের প্রাচিন গৌরবের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র চরম, চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী—ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য বলি প্রদত্ত (Everything in the state, nothing outside the state, nothing against the state) আন্তর্জাতিক শান্তি কাপুরুষের স্বপ্ন, নারীদের কাছে যেমন মাতৃত্ব স্বাভাবিক তেমনি পুরুষদের কাছে যুদ্ধ স্বাভাবিক।
ইতালির আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ:
প্যারিসের শান্তি চুক্তি দ্বারা ইতালির প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল তার প্রতিশোধ নেওয়া, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা, উপনিবেশ বিস্তার, মর্যাদা বৃদ্ধি করা প্রভৃতি ছিল মুসোলিনীর পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য।
তিনি শাসনভার গ্রহণ করার পর ঘোষণা করেন যে, ইতালি আদপেই আত্মতৃপ্ত জাতি নয়। অন্য জাতির পক্ষে সাম্রাজ্যবাদ অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা হলেও, ইতালির পক্ষে তা বেঁচে থাকার প্রধান শর্ত (We are hungry for land because we are not prolific and intend to retain so) |
ল্যসেন ও রোম চুক্তি:
মুসোলিনীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সোমালিল্যান্ডের কিছু অংশ ও জিবুতি বন্দর দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ ইতালিকে দিলেও ইতালি যুগোস্লোভিয়ার অন্তর্গত ডালমেশিয়া ও ফিউম অঞ্চল দাবী করে ও আদায় করে (১৯২৪) ।
এই সময় গ্রিক আততায়ীর হাতে কয়েকজন ইতালিয় নাগরিক নিহত হলে ইতালি করফু দ্বীপে আক্রমণ চালায়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইতালি গ্রিসের কাছে ক্ষতিপূরণ লাভ করে।
🔥আরও পড়ুনঃ-
আফ্রিকার বিস্তারনীতি:
ইতালি এবার আবিসিনিয়া দখলে বদ্ধপরিকর হয়। অর্থনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন ধরেই ইতালি আফ্রিকার আবিসিনিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করতে আগ্রহী ছিল।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আবিসিনিয়া-সোমালিল্যান্ড সীমান্তে ওয়াল- ওয়াল গ্রামের খণ্ড যুদ্ধে কিছু ইতালিয় সৈন্য নিহত হয়। এই ঘটনার মধ্যে মুসোলিনী আবিসিনিয়া আক্রমণের অজুহাত খুঁজে পান ।
মুসোলিনী আবিসিনিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রচুর পরিমাণ অর্থ দাবি করেন।
আবিসিনিয়া ইতালির এই অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে। কিন্তু জাতিসংঘ এই সমস্যা সমাধান কল্পে ইঙ্গ- ফরাসী তত্ত্বাবধানে একটি ‘সালিশি কমিশন’ গঠন করেই কাজ শেষ করে।
১৯৩৫ খ্রিঃ ৩রা অক্টোবর ইটালি আবিসিনিয়া আক্রমণ করে। জাতিসংঘ সদস্যরাষ্ট্রদের ইতালিকে অর্থনৈতিক বয়কট করার নির্দেশ দিলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ইতালির সেনাবাহিনী আবিসিনিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা দখল করে। আবিসিনিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসি দেশত্যাগে বাধ্য হন। ইটালির রাজা আবিসিনিয়ার সম্রাট বলে ঘোষিত হন। আবিসিনিয়া, সোমালিল্যান্ড ও ইরিত্রিয়া নিয়ে ইতালির উপনিবেশ ‘পূর্ব-আফ্রিকা রাজ্য’ গঠিত হয়।
স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ:
জাতিসংঘ থেকে বেরিয়ে এসে মুসোলিনী ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ স্পেনের গৃহযুদ্ধে ‘পপুলার ফ্রন্ট’ সরকারের বিরুদ্ধে জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করে।
ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করার উদ্দেশ্য হল স্পেনে সাম্যবাদের গতিরোধ করা, স্পেনে ইতালির প্রভাব বৃদ্ধি করা এবং শত্রু ফ্রান্সকে বেষ্টন করা। এরপর জার্মানি ও ইতালি পরস্পর কাছাকাছি আসে এবং জোটবদ্ধ হয়। উভয়েরই প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
জাপানে জঙ্গিবাদের প্রকাশ:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধান্তে ভার্সাই সন্ধিতে জাপান আশানুরূপ ফল পায়নি বলে ক্ষুব্ধ হয়। উপরন্তু ওয়াশিংটন সম্মেলনের (১৯২২খ্রিঃ) সিদ্ধান্ত অনুসারে তাকে চিনের শান্টুং প্রত্যর্পণ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে জাপান তার বিস্তার নীতি মুলতুবি রাখতে বাধ্য হয়। এতে জাপানের সমরবাদীরা অসন্তুষ্ট হয়। জাইবাৎসু শিল্পগোষ্ঠির সহায়তায় জাপানে জঙ্গি সেনাবাহিনী দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। এর ফলে জাপানে জঙ্গিবাদের উদ্ভব ঘটে।
তানাকা পরিকল্পনা:
এসময় রাজনৈতিক নেতাদের নানা দুর্নীতি উদঘাটিত হয়। দলগত শাসন জনপ্রিয়তা হারায়। অন্যদিকে সৈন্যবাহিনীর প্রতি জনগণের, বিশেষ করে জাপানি শিল্পপতিদের শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়।
সেই সঙ্গে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের সাফল্য জাপানের রাজনীতিকে রীতিমতো প্রভাবিত করে। তখন উগ্র সাম্রাজ্যবাদী জেনারেল ব্যারন তানাকা জাপানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
১৯২৭ খ্রিঃ তিনি জাপানী সম্রাটের কাছে এক স্মারকপত্রে চিন ও পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধনীতির দ্বারা জাপানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনাটি ‘তানাকা পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত।
এই পরিকল্পনাটি অনুমোদিত না হলেও জঙ্গিবাদীরা জাপানের রাজনীতিকে সাম্রাজ্যবাদী পথে পরিচালিত করতে বদ্ধপরিকর ছিল।
জাপানের অবস্থা:
১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের বিরূপ প্রতিক্রিয়া জাপানেও অনুভূত হয়েছিল। জাপানের রপ্তানি বাণিজ্য শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস পায়। বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে জাপানিরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
তারা এই অবস্থার জন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে দায়ী করে। এই অবস্থায় তানাকার নির্দেশে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবসান ঘটিয়ে ‘সোয়া- কাই’ দল গঠন করেন। এই দলের শ্লোগান ছিল ‘এক দেশ এক দল’।
জাপান কর্তৃক মাঞ্চুরিয়া দখল:
জাপানের জঙ্গি মনোভাবের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ মাঞ্চুরিয়ার ওপর অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মতো জাপানেরও লোলুপ দৃষ্টি ছিল।
তাছাড়া জাপানি পণ্যের বাজার, খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্র, উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার আবাসস্থল রূপে জাপানের কাছে মাঞ্চুরিয়া ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মাঞ্জুরিয়ার অন্তর্ভুক্ত রেলপথ চিনা সেনাদল ধ্বংস করেছে—এই মিথ্যা অজুহাতে জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে।
ওয়াশিংটন চুক্তি ভঙ্গ করে ও লিগের নির্দেশ অমান্য করে জাপান মাঞ্চুরিয়া দখল করে এবং চিনের চিং বংশের সর্বশেষ প্রতিনিধি পূ – ই (Pu – Yi)- র নেতৃত্বে সেখানে এক তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
দুর্বল চিন-এর প্রতিকার চেয়ে লীগে আবেদন করে। লিগ কর্তৃক নিযুক্ত ‘লিটন কমিশন’ জাপানকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করে। এর জবাবে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জাপান লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করে।
রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি:
মাঞ্জুরিয়ায় জাপানকে সংযত করতে লীগের ব্যর্থতা জাপানের সমরবাদীদের উৎসাহিত করে। জঙ্গীবাদ জাপানে প্রবল হয়ে ওঠে।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও জাপান ‘কমিন্টার্ন-বিরোধী চুক্তি’-তে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি দ্বারা স্থির হয় যে, উভয় পক্ষই কমিউনিজমের বিরুদ্ধে পরস্পরকে সাহায্য করবে।
রাশিয়ার সঙ্গে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইতালি কমিন্টার্ন বিরোধী চুক্তিতে যোগ দিলে ইতালি-জার্মানি-জাপান এই তিন রাষ্ট্রের জোট গড়ে ওঠে, যা ইতিহাসে ‘রোম-বার্লিন- টোকিও অক্ষচুক্তি’ নামে পরিচিত।
চিনে পুনরায় জাপানি আক্রমণ:
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাপান পুনরায় চিন আক্রমণ করে। চিন জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে জাতিসংঘ সমস্ত দেশকে জাপানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে নিষেধ করে।
কিন্তু জাতিসংঘের এই নিষেধ অগ্রাহ্য করে প্রায় সমস্ত দেশ জাপানকে খুশি করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করতে থাকে। অবশ্য ব্রিটেন ও আমেরিকা জাতিসংঘের এই নির্দেশ পালন করতে থাকে।
আমেরিকা জাপানে পেট্রোলিয়াম- জাত দ্রব্যাদি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এর ফলে জাপান ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
জাপান ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর হঠাৎ মার্কিন নৌঘাঁটি পার্লহারবার আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে ঝাপ দেয়। এইভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদ জাপানকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়।