মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা । Muhammad Bin Tughlaq Parikalpana

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
2.3/5 - (7 votes)

আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করবো। গিয়াস-উদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র জুনা খা ১৩২৫ খ্রীষ্টাব্দে মহম্মদ-বিন-তুঘলক উপাধি ধারণ করিয়া দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ২৬ বৎসরকাল রাজত্ব করিয়া ছিলেন।

ভারতের মধ্য যুগীয় ইতিহাসে তাঁহার রাজত্ব- কাল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । কিন্তু তাঁহার কার্যাদি ব্যাখ্যা বা তাঁহার চরিত্র বিশ্লেষণ কোন ক্ষেত্রেই ঐতিহাসিকগণ সকলে একমত হইতে পারেন নাই ।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ তাঁহাকে বিভিন্নভাবে চিত্রিত করিয়াছেন ঐতিহাসিকগণের মতামতগুলি অনুধাবন করিতে হইলে প্রথমেই সুলতানের কার্যাবলীর পর্যালোচনা দরকার ৷

মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা । Muhammad Bin Tughlaq Parikalpana

এক নজরে

সিংহাসনে আরোহণ করিয়া মহম্মদ তুঘলক শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কতকগুলি সংস্কার সাধনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করিলেন এবং সেই অনুযায়ী কতকগুলি পরিকল্পনা গ্রহণ করিলেন ।

রাজস্ব সংস্কার, রাজস্ব হারের সমতা আয়-ব্যয়ের হিসাব

প্রথমে তিনি রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ে কয়েকটি সংস্কার সাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি রাজ্যের সর্বত্র একই হারে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করিলেন। রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব উপযুক্তভাবে সংরক্ষণের জন্য এবং প্রাদেশিক আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়মিত ভাবে রাজধানীতে প্রেরণের জন্য তিনি নির্দেশ দিলেন।

দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি তাহার ফলাফল

রাজ্যের আয় বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে তিনি দোয়াব অঞ্চলে করের পরিমাণ  বৃদ্ধি করিলেন। তাহা ছাড়া, দোয়াব অঞ্চলে প্রজা- বর্গের অর্থবল এবং তাহাদের বিদ্রোহাত্মক মনোভাবও তাঁহার এই কর নির্ধারণের পশ্চাতে যুক্তি হিসাবে কাজ করিয়াছিল।

ফলে দোয়াব অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হইল। প্রথম দিকে স্থুলতানের আদেশে ও রাজকর্মচারীদের উৎসাহে কৃষকদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার অনুষ্ঠিত হইল সত্য কিন্তু পরে কৃষকদের দুর্দশা দেখিয়া সুলতান প্রচুর ঋণ দান ও জলসেচের ব্যবস্থা করিলেন।

ইহার ফলে কেবলমাত্র যে কর অনাদায় রহিল তাহাই নয়, প্রচুর অর্থের অপব্যয় হইল এবং সুলতানের জনপ্রিয়তাও নষ্ট হইল ।

আমীর-ই-কোহী’চাষের জমি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা

কৃষির উন্নতিকল্পে সুলতান ‘আমীর ই-কোহী’ নামে এক নূতন কৃষি বিভাগের পত্তন করিলেন; উদ্দেশ্য হইল সরকারী ব্যয়ে পতিত জমিকে কৃষির উপযোগী করিয়া তোলা।

বহু কর্মচারী নিযুক্ত হইল, বহু অর্থ ব্যয় হইল; কিন্তু চাষের অনুপযোগী জমিগুলি এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করার ফলে এবং সুলতানের নিজস্ব তত্ত্বাবধানের অভাবে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং প্রচুর অর্থের অপচয় হয়।

দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা

১৩২৬ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান দিল্লী হইতে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। দেবগিরি ছিল তাঁহার সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং এই দেবগিরি হইতে দক্ষিণ ভারতে সুলতানি শাসন পরিচালনা করাও ছিল সহজ। অপর পক্ষে বার বার মোঙ্গল আক্রমণে দিল্লীর নিরাপত্তা অল্পতেই বিপদাপন্ন হইয়া পড়িত।

এই সমস্ত কারণে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত করিয়া সুলতান কেবল মাত্র সরকারী দপ্তর নয়, দিল্লীর সমস্ত লোককেই দেবগিরি অর্থাৎ দৌলতাবাদে যাত্রার আদেশ দিলেন। এই যাত্রার ফলে দিল্লীর অধিবাসীদের শারীরিক কষ্ট ও আর্থিক দুর্গতির অবধি রহিল না।

পরিকল্পনার ব্যর্থতা

কিন্তু সুলতানের এই পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল। কারণ দিল্লী সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে মোঙ্গল আক্রমণকারীরা আরও সাহসী হইয়া উঠিল। অপর দিকে দিল্লীর অধিবাসীগণ এই নূতন পরিবেশে নিজদিগকে খাপ খাওয়াইতে না পারিয়া ক্রমেই অসন্তুষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল ৷

অবশেষে সুলতান তাঁহার ভুল বুঝিতে পারিয়া পুনরায় সকলকে দিল্লীতে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দিলেন। তিনি যদি কেবলমাত্র সরকারী দপ্তর সমূহ স্থানান্তরের ব্যবস্থা করিতেন তাহা হইলে হয়ত তাঁহার এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হইত না ।

“Daulatabad remained a monument of misdirected energy.”-Lanepoole.

মুদ্রানীতির সংস্কার তামার নোট প্রবর্তনের পরিকল্পনা

মুদ্রানীতির সংস্কার সাধনের জন্য মহম্মদ তুঘলক কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন। প্রথমে তিনি বাজার দর অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওজনের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রবর্তন করেন। এদিকে যুদ্ধ-বিগ্রহ, মুক্তহস্তে দান ও শাসন কার্যে ব্যয় বাহুল্যের ফলে রাজকোষ প্রায় অর্থশূন্য হইয়া পড়িয়াছিল।

এই অবস্থার সম্মুখীন হইতে যাইয়া সুলতান একটি মারাত্মক পরীক্ষামূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করিলেন, তিনি চীনদেশের অনুকরণে তামার নোটের প্রবর্তন করিলেন;

মুদ্রা মূল্য হ্রাস জালনোটের আধিপত্য

কিন্তু সরকার হইতে উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন না করার ফলে দেশের অভ্যন্তরে তামার নোট ব্যাপকভাবে জাল হইতে লাগিল, ফলে মুদ্রার মূল্য একেবারে কমিয়া গেল । বিদেশী বণিকগণ ঐ মুদ্রা গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিল, ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় অচল হইয়া পড়িল।

সুতরাং সুলতান অবশেষে স্বর্ণ মুদ্রার বিনিময়ে, যাবতীয় তামার নোট উঠাইয়া লইলেন ৷ চতুর্দশ শতাব্দীতে এই ধরণের নোট চালু করার সমস্যা সুলতান প্রথমে অনুধাবন করিতে পারেন নাই ৷

উদার ধর্মনিরপেক্ষ শাসন উলেমাদের বিশেষ আধিপত্য

আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুলতান আরও কয়েকটি মৌলিক সংস্কার সাধনের চেষ্টা করিয়াছিলেন ৷ মহম্মদ তুঘলক ধর্মপরায়ণ মুসলমান ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার শাসন ছিল উদার এবং ধর্ম নিরপেক্ষ ৷

আলাউদ্দিনের ন্যায় তিনিও রাষ্ট্রনীতি হইতে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন রাখিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। এইজন্যই তিনি উলেমাদের ‘বিশেষ অধিকার’ সমূহ প্রত্যাহার করিয়া লইলেন । ফলে তাহাদের সহিত সুলতানের তীব্র মতবিরোধ উপস্থিত হয়, এবং তিনি তাহাদের বিরাগভাজন হইয়া পড়েন ।

ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে বিচার ব্যবস্থা

ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে তিনি বিচার কার্য পরিচালনার চেষ্টা করিয়াছিলেন । বিচার বিষয়ে কাজী ও উলেমাদের একচেটিয়া অধিকার তিনি নাকচ করেন; কাজী, মুফতি প্রভৃতি তথাকথিত আইনজ্ঞদের মতামত তিনি সর্বত্র গ্রহণযোগ্য বলিয়া মনে করিতেন না। এইজন্য অবশ্য তাহারা সুলতানের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হইয়া উঠিয়াছিলেন ।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉আলাউদ্দিন খলজির কৃতিত্ব ও চরিত্র

বৈদেশিক নীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ (Foreign policy and War- fares):

বৈদেশিক নীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ (খোরাসান জয়ের পরিকল্পনা)

বৈদেশিক ক্ষেত্রেও সুলতানের কয়েকটি পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছিল। সিংহাসনে আরোহণের কয়েক বৎসরের মধ্যেই সুলতান খোরাসান ও ইরাক জয় করিবার পরিকল্পনা করিলেন ।

খোরাসানের অভ্যন্তরে তখন কিছুটা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চলিতেছিল; কিন্তু খোরাসানী বিদ্রোহ হয়ত তাঁহাকে এ ব্যাপারে প্রলুব্ধ করিয়াছিল। মিশর হইতে তিনি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাইয়াছিলেন।

পরিকল্পনা পরিত্যাগের কারণ

তিনি প্রায় চারি লক্ষ সৈন্যকে এই “উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করিয়া এক বৎসর পোষণ করিলেন, অবশেষে তিনি পরিকল্পনাটি পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন ।

হয়ত শেষ পর্যন্ত মিশররাজ তাঁহার প্রতিশ্রুতিমত সাহায্য করিতে প্রস্তুত না হওয়ায় তাঁহাকে বাধ্য হইয়া অন্যদেশ জয় করিবার আশা ত্যাগ করিতে হইয়াছিল। ফলে রাজকোষের প্রচুর অর্থই ব্যয় হইল মাত্র ৷

“The coveted countries. were not acquired and his treasure was expended.”-Barani.

নগরকোট জয় এবং কারাজলে অভিযান প্রেরণ

১৩৩৭ খ্রীষ্টাব্দে পাঞ্জাবের অন্তর্গত কাংরা জেলায় অবস্থিত নগরকোট নামক পার্বত্য রাজ্যটি মহম্মদ তুঘলক জয় করেন। অতঃপর তিনি হিমালয়ের পার্বত্য রাজ্যগুলির উপর প্রভুত্ব স্থাপনকল্পে কারাজলে বা কুর্মাচল প্রদেশে এক অভিযান প্রেরণ করেন।

এই অঞ্চলের পার্বত্য জাতিসমূহ প্রায়ই সুলতানি রাজ্য আক্রমণ করিত এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নানা প্রকার অত্যাচার করিত। সুতরাং তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরিত হইয়াছিল।

চীনে অভিযান সম্পর্কে মতভেদ

যদিও পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান পরিচালনায় অনভিজ্ঞ বাহিনী আকস্মিক তুষার-পাতের ফলে বিনষ্ট হইয়া যায়, তথাপি এই অভিযানের পর পার্বত্য জাতিসমূহ বহুকাল পর্যন্ত শাস্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করিয়াছিল।

অনেক ঐতিহাসিক, ফেরিস্তাকে অনুসরণ করিয়া মনে করেন যে মহম্মদ তুঘলক চীন আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইয়া- ছিলেন। কিন্তু বারণি বা ইবন বতুতার লেখা পড়িলে বেশ বুঝা যায় যে, তিনি চীন অভিযানের কোন পরিকল্পনাই করেন নাই, পার্বত্য জাতি সমূহকে দমন করাই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল।

চীন সম্রাটের সহিত সম্ভাব (ইবন বতুতার চীনে গমন)

বরং চীন সম্রাটের সহিত তাঁহার সম্ভাবই ছিল। ১৩৪১ খ্রীষ্টাব্দে চীন সম্রাট তোঘান-তিমুর তুঘলকের রাজসভায় এক রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেন; সুলতানও প্রচুর উপঢৌকন সহ ইবন বতুতাকে দ্রুত হিসাবে চীন সম্রাটের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন ৷

মোঙ্গল আক্রমণ তাহার কারণ

মহম্মদ তুঘলকের রাজত্বকালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থায় কিছুটা দুর্বলতা দেখা দিয়াছিল। দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের কিছু- কালের মধ্যেই ১৩২৮ খ্রীষ্টাব্দে মোঙ্গল নেতা তরমাশিরীণ পাঞ্জাব, লাহোর ও মুলতান বিধ্বস্ত করিয়া দিল্লী পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন।

ফেরিস্তার বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, সুলতান প্রচুর পরিমাণ ধনরত্ন উৎকোচ দিয়া তাঁহাকে নিরস্ত করেন। অবশ্য বাদাউনী, এহিয়াৰিণ আহম্মদ প্রভৃতি ঐতিহাসিকগণ বলেন যে সুলতান যোঙ্গলদিগকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়াই ভারত ত্যাগে বাধ্য করিয়াছিলেন; তবে রাজধানী পরিবর্তন, দোয়াব বিদ্রোহ প্রভৃতি কারণে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সংরক্ষণে যে দুর্বলতা দেখা দিয়াছিল তাহা সত্য ।

সুলতানি সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন (Disintegration of the Empire):

বিভিন্ন স্থানে রাজকর্মচারী ও শাসন কর্তাদের বিদ্রোহ

দোয়াব অঞ্চলের বিদ্রোহ, দেবগিরিতে রাজধানী পরিবর্তনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা, খোরাসান জয়ের অলীক পরিকল্পনা, কুর্মাচল অভিযানে বিপর্যয়, মুদ্রানীতির ব্যর্থতা, মোঙ্গল আক্রমণ ইত্যাদি সমস্ত কিছুই দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে বিদ্রোহের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করিল ৷

গুলবর্গায় বহাউদ্দিনের বিদ্রোহ, কোন্ধানার হিন্দুরাজার বিদ্রোহ, সিন্ধু ও মুলতানের শাসনকর্তা বহারাম আইবার প্রভৃতিকে অত্যন্ত নির্মমভাবে দমন করা হইল । লাহোরের শাসনকর্তা আমীর হালাজু ও বাংলার শাসনকর্তা গিয়াস উদ্দিন উভয়েই বিদ্রোহী হইয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহারা পরাজিত ও নিহত হন।

জাঠ ও রাজপুতদের বিদ্রোহ (মীবার ও বাংলা স্বাধীন)

সুনাম ও সামানা অঞ্চলের জাঠ ও ভাতি রাজপুতগণের বিদ্রোহও দমন হয়। কিন্তু ১৩৩৫ খ্রীষ্টাব্দে মাবারের সৈয়দ জামান উদ্দিন বিদ্রোহী হইলে সুলতান তাহা দমন করিতে অসমর্থ হন এবং যাবার স্বাধীন হইয়া যায়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশও মুবারকের অধীনে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সুলতান এবার কোনরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে অক্ষম হন নাই।

স্বাধীন বাহমনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

১৩৪৭ খ্রীষ্টাব্দে দেবগিরি, বেরার, থান্দেশ, মালব প্রভৃতি অঞ্চলের বিদেশী আমীরগণ বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। সুলতান শেষ পর্যন্ত উহা দমন করিতে অক্ষম হইলে স্বাধীন বাহমনী রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

দক্ষিণ ভারতে বিজয়নগর রাজ্য

উত্তর ভারতের অসস্তোষ ও বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করিয়া দক্ষিণ ভারতের হিন্দুগণ ও হিন্দুরাজগণ হরিহরের নেতৃত্বে স্বাধীন বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন; বরঙ্গল, দ্বারসমুদ্র ও করমণ্ডল উপকূল দিল্লীর অধীনতা পাশ হইতে মুক্ত হইয়া যায় ।

মৃত্যু

চারিদিকে এই সমস্ত বিদ্রোহ ও অশান্তির মধ্যে সুলতান শেষজীবনে ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠেন। অবশেষে ১৩৬১ খ্রীষ্টাব্দে সিন্ধুদেশে বিদ্রোহ দমন করিতে যাইয়া তিনি অসুস্থ হইয়া পড়েন এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন ।

“The king was free from his people and they form the king.”-Badauni.

সুলতানের বিফলতার কারণ ও তাঁহার দায়িত্ব (Causes of his failure and his responsibility):

দূরদর্শী পরিকল্পনা মৌলিকতা ও প্রতিভা

ইহা অনস্বীকার্য যে মহম্মদ তুঘলকের দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষমতা ছিল। কয়েকটি পরিকল্পনার মধ্যে মৌলিকতার ছাপ খুব স্পষ্ট এবং তাহার মধ্য দিয়া তাঁহার বহুমুখী প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়।

কিন্তু তবুও তিনি বহুক্ষেত্রেই বিফল হইয়াছিলেন। তাঁহার পরিকল্পনাগুলি অযৌক্তিক ছিল বলিয়া যে তিনি ব্যর্থ হইয়াছিলেন তাহা নহে, ব্যর্থতার পশ্চাতে অন্য কয়েকটি কারণ কার্য করিয়াছিল।

পরিকল্পনা কার্যকর করার ত্রুটিপূর্ণ পন্থা

প্রথমতঃ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়াছে যে পরিকল্পনাগুলি কার্যকরী করিবার জ অবলম্বিত পন্থার মধ্যে ত্রুটি ছিল। সেখানে তিনি বাস্তববুদ্ধি ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেন নাই।

কেবলমাত্র সরকারী দপ্তর স্থানান্তরের ব্যবস্থা না করিয়া দিল্লীর সমস্ত অধিবাসীকেই দেবগিরি যাত্রার নির্দেশ দেওয়ার মারাত্মক ফল তিনি পূর্বে উপলব্ধি করিতে পারেন নাই।

অসমীচীন পদক্ষেপ

খোরাসানের আভ্যন্তরীণ অবস্থা বিচারে ঐ দেশ জয় করিবার পরিকল্পনা গ্রহণ হয়ত অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে নানাদিকে শৃঙ্খলা আনয়ন যখন আশু প্রয়োজন ছিল তখন বিদেশীর সাহায্যের উপর নির্ভর করিয়া ঐ কার্যে অগ্রসর হওয়া সমীচীন হয় নাই । পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধ করিতে অনভ্যস্ত বিরাট বাহিনীকে কুর্মাচল অভিযানে প্রেরণও যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ ছিল।

যুগের ধ্যান ধারণা হইতে অগ্রবর্তী

তামার নোট প্রচলন প্রভৃতি কয়েকটি পরিকল্পনার মধ্যে তাঁহার সৃষ্টি কুশলী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সেগুলি সেই ছিল, সে যুগের ধ্যান ধারণা হইতে অগ্রবর্তী ছিল, সে যুগের বাস্তব অবস্থায় সেগুলি কার্যকরী করা সম্ভবপর ছিল না।

উলেমা মুফতিদের বিরোধিতা

উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করার প্রচেষ্টার মধ্যে তাঁহার মহত্বের পরিচয় পাওয়া যায় সত্য, কিন্তু এ বিষয়ে তাঁহাকে উলেমাদের বিরোধিতা ও বিদ্বেষ অর্জন করিতে হইয়াছিল। তাঁহার ব্যর্থতার জন্য তাহারা কম দায়ী ছিল না।

“He had brought exceptional abilities and highly cultivated mind to the task of governing the greatest Indian Empire that had so far been known, and he had failed stupendously. It was a tragedy of high intentions self-defeated with the best of intentions but no sense of proportion. Mahammad Tughluq was transcendant failure.”-Lane Poole.

রাজকর্মচরীদের সহানুভুতির অভাব

রাজকর্মচারিগণ তাঁহার সংস্কারগুলি কার্যকরী করিবার ব্যাপারে মোটেই সহযোগিতা করে নাই, বরং অনেকক্ষেত্রে যেমন দোয়াব অঞ্চলে এবং রাজস্ব ব্যাপারে, তাহাদের জন্য সুলতান ব্যর্থ হইয়াছিলেন বলা যায়।

ব্যক্তিগত চরিত্রের ত্রুটি

সুলতানের ‘ব্যক্তিগত চরিত্রের কয়েকটির দুর্বলতা ও তাঁহার ব্যর্থতার জন্য কম দায়ী ছিল না। তাঁহার ছিল না। সংস্কার কর্মের জন্য যে পরিমাণ ধৈর্যের প্রয়োজন তাহা সংস্কার কার্যে যে জনসাধারণের সহানুভূতি জাগ্রত করা প্রয়োজন সে বোধ তাঁহার ছিল না।

অপরের সং- পরামর্শেরও তিনি ধার ধারিতেন না। সাধারণ বিচার- বিবেচনার অভাব তাঁহার মধ্যে যথেষ্ট ছিল। তিনি প্রতি কাজেই অস্থিরতা প্রদর্শন করিতেন, বাধা পাইলেই ক্রোধান্ধ হইয়া উঠিতেন এবং যথেচ্ছ ব্যবহার করিতেন। এইরূপভাবে নিজেই তাঁহার বিফলতা ডাকিয়া আনিতেন ।

সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনে তাঁহার দায়িত্ব

বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিফলতার ফলে দিল্লী সুলতানির মর্যাদা হ্রাসপ্রাপ্ত হইয়াছিল; অর্থাভাব হেতু শাসনকার্যের দক্ষতাও বিনিষ্ট হইয়াছিল। সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে অরাজকতা ও বিদ্রোহ দেখা দেয়।

সুলতানের শেষ জীবনেই সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন শুরু হইয়া যায় এবং তাহার পতনোন্মুখতা স্পষ্ট হইয়া উঠে। দক্ষিণ ভারত স্বাধীন হইয়া যায়, বাহমণি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় এবং দূরবর্তী প্রদেশ- গুলি স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

তাঁহার সৃষ্ট অরাজকতা পতনের অন্যতম কারণ

তাঁহার রাজত্বকালে যে অব্যবস্থা ও ভাঙ্গন দেখা দেয় পরবর্তী কালে তাহা রোধ করিয়া সুলতানি শাসনের ভিত্তি দৃঢ় করা যায় নাই । এইজন্য তাঁহার সৃষ্ট অরাজকতাকেই অনেকে দিল্লীর সুলতানির পতনের অন্যতম কারণ বলিয়া মনে করেন।

“Endowed with extra ordinary intellect and industry, he lacked the essential qualities of a constructive statesman and his ill-advised measures and stern policy enforced in disregard of popular will, sealed the doom of his empire.”-An Advanced History of India.

উপসংহার

উপরে আলোচিত মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা আলোচনা করে আমরা বলতে পারি যে মহম্মদ বিন তুঘলক প্রজা কল্যানের জন্য তিনি অনেক গুলি পরিকল্পনা করলেও তার কোনো পরিকল্পনা সফল হয়নি।

দিল্লী থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করাটা ছিল মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ব্যর্থ পরিকল্পনা গুলির মধ্যে সবথেকে বড়। এর ফলে অগণিত প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক পতন দেখা দেয়। তার বুদ্ধিমত্যাহীন পরিকল্পনা প্রয়োগ এবং তা পত্যাক্ষাণ তার সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

FAQs মহম্মদ বিন তুঘলক

প্রশ্ন: মোহাম্মদ বিন তুঘলক কোথায় কি নামে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন?

উত্তর: মোহাম্মদ বিন তুঘলক দেওগীরে (মহারাষ্ট্রে) দৌলতাবাদ নামে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন।

প্রশ্ন: মুহাম্মদ বিন তুঘলক এর প্রকৃত নাম কি?

উত্তর: মুহাম্মদ বিন তুঘলক এর প্রকৃত নাম শাহজাদা ফখর মালিক।

প্রশ্ন: মুহাম্মদ বিন তুঘলক এর রাজধানী স্থানান্তরের কারণ কি ছিল?

উত্তর: দেবগিরি দক্ষিণ ভারতের কাছাকাছি হবার কারণে সুলতান সহজে দক্ষিণ ভারতেকে লক্ষ্য দিতে পারবে, এছাড়া দেবগিরি দিল্লি থাকে দূরে হবার কারণে মোঙ্গল আক্রমণের হাত থেকে রাজধানীকে রক্ষা করা সহজ হবে।

প্রশ্ন: মহম্মদ বিন তুঘলক যে মুদ্রা প্রচলন করেন তার নাম কি?

উত্তর: মহম্মদ বিন তুঘলক টোকেন নামে তামার মুদ্রা চালু করেন।

প্রশ্ন: মহম্মদ বিন তুঘলক কেন তামার মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন?

উত্তর: তামার মুদ্রা প্রচলনের অনেক গুলি কারণ থাকলেও মূলত অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বাড়িয়ে তুলতে মহম্মদ বিন তুঘলক তামার মুদ্রা প্রচলন করেন।

প্রশ্ন: দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করেন কে?

উত্তর: মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করেন।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment