যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাঙনে জাতিসংঘের ভূমিকা

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
Rate this post

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা লক্ষ্য করে বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কগণ আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসংবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধান বা বিশ্বশান্তিকে নির্বিঘ্ন করে তোলার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ (League of nation) স্থাপন করেন। এই উদ্দেশ্যেই জাতিসংঘের চুক্তিপত্রে যৌথ নিরাপত্তার নীতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

যৌথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা অনুসারে স্থির হয় যে, শর্ত ভঙ্গ করে যুদ্ধের পথ ধরলে সেই রাষ্ট্রকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করা হবে, কোনো সদস্যরাষ্ট্র আক্রান্ত হলে যৌথভাবে আক্রমণকারীকে শাস্তি দেওয়া হবে। এই যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ছিল জাতিসংঘের অস্ত্র, যাকে মনে করা হয়েছিল বিশ্বশান্তির রক্ষাকবচ।

বলা বাহুল্য, বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে জাতিসংঘ তার দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করতে পারলেও ত্রিশের দশকে একনায়কতন্ত্রী দেশগুলির বিস্তার নীতি এবং সেই সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলির প্রতি তোষণ নীতি জাতি সংঘের যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূলে ভাঙন ধরায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় এই ব্যবস্থার সমাধি রচিত হয়।

যৌথ নিরাপত্তায় জাতিপুঞ্জের প্রাথমিক সাফল্য:

বহু আশা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত লীগের মূল কর্তব্য যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্বারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য লাভ করেছিল। প্রথমত, ইরাক-তুরস্কের সীমান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য জাতিসংঘ একটা নিরপেক্ষ সীমান্ত কমিশন নিয়োগ করে।

শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের রায় অনুসারে তুরস্ক জাতিসংঘের নির্ধারিত নতুন সীমান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়ত, বলকান অঞ্চলে গ্রিস ও বুলগেরিয়ার বিরোধে গ্রিক বাহিনী বুলগেরিয়া আক্রমণ করলে বুলগেরিয়া জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানায়।

জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে গ্রিস বুলগেরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে এবং ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। তৃতীয়ত, লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ডের মধ্যে ভিলনার ওপর দাবিকে কেন্দ্র করে যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল জাতিসংঘের উদ্যোগে তা সম্পূর্ণভাবে মীমাংসিত না হলেও উত্তেজনা যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছিল। এটাও জাতিসংঘের সাফল্য বলা যেতে পারে।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইতালি ও জাপান জাতীয়তাবাদ

যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভাঙনের সূচনা জাতিসংঘের ব্যর্থতা:

জাতিসংঘের যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রথম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় দূরপ্রাচ্যে। জাতিসংঘের অন্যতম সদস্য হয়েও ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপান মাঞ্জুরিয়া আক্রমণ করে যৌথ নিরাপত্তার ব্যবস্থার মূলে প্রথম কুঠারাঘাত করে। চিন এর বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের কাছে আবেদন করে।

জাতিসংঘ কাউন্সিল জাপানকে সেনা অপসারণের নির্দেশ দিলে জাপান তা অগ্রাহ্য করে সমগ্র মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয় এবং সেখানে জাপানি নিয়ন্ত্রণাধীনে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে (১৯৩২ খ্রিঃ)। মাঞ্জুরিয়ার নতুন নামকরণ হয় ‘মাঞ্জু কুয়ো’।

ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি জাপানের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রস্তুত ছিল না। তাই জাতিসংঘ এক তদন্ত কমিশন’ গঠন করে তার ওপর সরেজমিনে সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবনের দায়িত্ব দেয়।

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে কমিশনের রিপোর্টে জাপানকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও জাপানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়নি। এর কারণ, ব্রিটেন চিন ও জাপান দুদেশকেই অস্ত্র সরবরাহ করত।

কমিশনের রিপোর্ট অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থিত হলে জাপান লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করে। মাঞ্চুরিয়া সংকট সমাধানে লিগের ব্যর্থতা এর মর্যাদা ও গুরুত্ব বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ করে।

আবিসিনিয়া সংকটে জাতিসংঘের ব্যর্থতা:

যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভিত্তি যে কত দুর্বল তার দ্বিতীয় প্রমাণ ফ্যাসিবাদী ইতালির আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া দখল (১৯৩৫ খ্রিঃ)। উনিশ শতকেই ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়। কিন্তু সেসময় বৃহৎ শক্তিগুলির বিরোধিতায় ইতালির সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

মুসোলিনী ক্ষমতায় এসে আবিসিনিয়া জয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ইতালির সোমালিল্যান্ড ও আবিসিনিয়ার সীমান্তে অবস্থিত ‘ওয়াল-ওয়াল’ গ্রামে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ছোট্ট সংঘর্ষে কিছু ইতালিয় সৈন্য নিহত হয়।

এই ঘটনার অজুহাতে মুসোলিনী আবিসিনিয়ার কাছে ক্ষতিপূরণ ও ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করেন। আবিসিনিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসি জাতিসংঘের কাছে এর বিরুদ্ধে আবেদন করেন। জতিসংঘ আপস-মীমাংসার উদ্দেশ্যে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে একটি কমিটি গঠন করে।

কিন্তু ইতালি কোনো আপস মীমাংসায় রাজি ছিল না। তাই ইতালি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৩রা অক্টোবর আবিসিনিয়া আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘ ইতালিকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করে এবং ইতালির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক শাস্তি ঘোষণা করে।

কিন্তু অন্য রাষ্ট্রগুলি জাতিসংঘের নির্দেশ পালন করলেও ব্রিটেন ইতালিকে তেল রপ্তানি করা বন্ধ করল না। শেষ পর্যন্ত ইতালির চাপে আবিসিনিয়া ভেঙে পড়ে এবং সম্রাট হাইলে সেলাসি দেশত্যাগে বাধ্য হন। ইতালির রাজা আবিসিনিয়ার সম্রাট বলে ঘোষিত হন।

ইরিত্রিয়া, সোমালিল্যান্ড ও আবিসিনিয়া নিয়ে ‘ইতালীয় পূর্ব আফ্রিকা’ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইতালি জাতিসংঘের সদস্য পদ ত্যাগ করে। জাতিসংঘের যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত হল।

জার্মানির হাতে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমাধি:

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে হিটলার ও তার নাৎসিদলের ক্ষমতা লাভ জার্মানিকে উগ্র সাম্রাজ্যবাদী করে তোলে। হিটলার নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ত্রের সমতা দাবি করেন।

কিন্তু তার সে দাবি অগ্রাহ্য হলে তিনি নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ও জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। এরপর হিটলার ভার্সাই সন্ধি ধারাবাহিকভাবে লঙ্ঘন করতে থাকেন।

হিটলার জল-স্থল ও বিমান বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করেন, রাইন অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ করেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়া দখল করে নেন, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করে নেন।

কিন্তু এত সবের কোনোটাতেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং তারা জার্মানির প্রতি তোষণ নীতি অবলম্বন করে।

আর এর পরিণতিতে জার্মানির উগ্র সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধা ক্রমেই বেড়ে যায়। জাতিসংঘও ওই দুই বৃহৎ শক্তির উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তায় সব ক্ষেত্রে প্রায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।

শেষ পর্যন্ত ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তাদের তোষণনীতির ফল বুঝতে পেরে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমাধি রচনা করে।

উপসংহার:

যুদ্ধ রোধ করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছিল জাতিসংঘ। কিন্তু জাতিসংঘের কাঠামোগত ও সাংগঠনিক দুর্বলতার মধ্যে এর যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অসাফল্যের কারণ নিহিত ছিল।

শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা লিগের ছিল না। সর্বোপরি অনেক ক্ষেত্রেই জাতিসংঘ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ন্যায় বৃহৎ শক্তির তোষণ নীতির জন্য নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। তাই যৌথ নিরাপত্তার ব্যর্থতার জন্য জাতিসংঘই শুধুমাত্র দায়ী ছিল না।

জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন থেকে বিরত ছিল। তাই জাতিসংঘের যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্রমে ক্রমে ভেঙে পড়ে এবং পরিণতিতে পৃথিবী কাঁপিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা বেজে ওঠে।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment