প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের জনগণ আশা করেছিল যে, জাতিসংঘ যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিশ্বের শান্তি অব্যাহত রাখতে রাখতে সমর্থ হবে। কিন্তু জাতিসংঘের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির দু’দশকের মধ্যেই ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা বেজে উঠেছিল এবং ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে জাপানের আত্মসমর্পণের পর এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পিছনেও কয়েকটি কারণকে দায়ী করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ
(১) ভার্সাই সন্ধির ত্রুটি:
অনেকের মতে, ভার্সাই সন্ধির শর্তাবলির ত্রুটির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি সমর্থনযোগ্য ছিল না।
জার্মানিকে অবদমিত করার জন্য ভার্সাই সন্ধিতে এমন কতকগুলি শর্ত আরোপিত হয়েছিল যা প্রতিশোধমূলক ছিল এবং আত্মমর্যাদা সম্পন্ন কোনো জাতির পক্ষেই তা সহ্য করা সম্ভব ছিল না।
(ক) ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি মাত্র একবার জার্মান প্রতিনিধিদের দেখতে দেওয়া হয়েছিল। জার্মানি এর কিছু অংশ পরিবর্তন করতে বলে। কিন্তু বিজয়ী শক্তিবর্গ তা না করে যুদ্ধের হুমকি দেখিয়ে জার্মানির ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই সন্ধির শর্তগুলি তার ওপর চাপিয়ে দেয়। তাই এই সন্ধিকে অনেকে ‘জবরদস্তিমূলক সন্ধি’ (Peace Diktat) বলে অভিহিত করেন। এই সন্ধি পালনে জার্মানি অস্বীকার করে।
(খ) সামরিক ক্ষেত্রে দুর্বল করে রাখার জন্য জার্মানির ন্যায় বৃহৎ রাষ্ট্রকে বেলজিয়ামের ন্যায় ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অপেক্ষা কম সৈন্য রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। জার্মানিকে নিরস্ত্রীকৃত করা হলেও ইউরোপের অন্যান্য দেশকে নিরস্ত্রীকৃত করা হল না।
(গ) জার্মানির সব উপনিবেশগুলি অধিগ্রহণ করা হলেও অন্যান্য দেশের উপনিবেশগুলির ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়নি।
(ঘ) এক অভাবনীয় পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা জার্মানির ওপর চাপিয়ে দিয়ে জার্মানিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিরকালের মতো পঙ্গু ও দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এইসব কারণে ভার্সাই সন্ধি জার্মান জাতির কাছে প্রথম থেকেই অপমান, অন্যায় ও অবিচারের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। তাই জার্মানি এই সন্ধি ভঙ্গ করে প্রতিশোধ গ্রহণে সচেষ্ট হয়।আর এরই ফলে আন্তর্জাতিক অশান্তির ঘূর্ণি-বাতাস সৃষ্টি করে। জার্মানির নাৎসীদল ক্ষমতায় এলে ভার্সাই সন্ধি ভঙ্গের কাজে অগ্রসর হয়। এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ পরিষ্কার হয়।
(২) সীমান্ত সমস্যা:
ভার্সাই সন্ধি রচনার সময় জার্মান-পোল সীমান্ত ও জার্মান-চেক সীমান্তের ক্ষেত্রে অনাবশ্যক জটিলতার সৃষ্টি করা হয়েছিল। স্থানীয় সমস্যা সম্পর্কে তদন্ত কমিশনের রিপোর্টগুলি ভালো করে না পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সীমান্ত গঠনের ক্ষেত্রে বহু গোলযোগের সূত্রপাত ঘটে।
জার্মান অধ্যুষিত সুদেতান জেলা চেকোশ্লোভাকিয়ার অন্তর্গত করা না হলে হয়তো মিউনিক চুক্তি হত না। আবার জার্মানির পশ্চিম-প্রাশিয়া ও পোজেনকে পোল্যান্ডের হাতে ফিরিয়ে না দিলে জার্মানির সঙ্গে পোল্যান্ডের বিরোধ দেখা দিত না।
(৩) রাজনৈতিক মানচিত্রে দুর্বলতা:
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের শান্তি চুক্তির দ্বারা জার্মানির প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে ক্ষুদ্র ও দুর্বল করে গড়া হয়েছিল। আবার রাশিয়া, জার্মানি ও অস্ট্রিয়া—এই তিনটি সাম্রাজ্যকে ভেঙে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল।
এদের না ছিল প্রাকৃতিক সীমারেখা, না ছিল আত্মরক্ষার শক্তি। ফলে জার্মানি ও রাশিয়া উভয়ের পক্ষেই এই দেশগুলিকে গ্রাস করা সহজ হয়।
(8) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (The Second World War) গ্রন্থে সাইরিল ফলস বলেছেন, ‘জার্মানির প্রতিহিংসা চরিতার্থতার জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছিল।” এই প্রতিহিংসা গ্রহণের ক্ষেত্রে জার্মানির জাতীয় সমাজতন্ত্রীরা (National Socialist বা Nazi) সর্বাগ্রে ছিল।
তাদের লক্ষ্য ছিল, টিউটন জাতি অধ্যুষিত অঞ্চল সমবায়ে বাসভূমি (Living Room) ও তৃতীয় রাইখ গড়ে তোলা, ইউরোপের প্রধান শিল্পগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা, ইউক্রেনের মতো কৃষি অঞ্চলকে উপনিবেশে পরিণত করা, স্লাভ জাতিকে কৃষি শ্রমিকে পরিণত করা, ইহুদি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা, জার্মানির অস্ত্র সজ্জা প্রভৃতি।
(৫) ঔপনিবেশিক তথা অর্থনৈতিক কারণও প্রবল ছিল। শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, রপ্তানী পণ্যের জন্য বাজার এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য উপনিবেশ বিস্তার প্রয়োজনীয় ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইংল্যান্ডের দখলে ছিল পৃথিবীর ১/৪ অংশ। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, হল্যান্ডেরও উপনিবেশ ছিল কিন্তু অক্ষশক্তিভুক্ত জার্মানি, ইতালি, জাপানের তেমন উপনিবেশ ছিল না।
শিল্প, কারখানার জন্য অতি প্রয়োজনীয় ২৫টি কাঁচামালের ও খনিজ দ্রব্যের মধ্যে ১৮টি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে যোগান দেওয়া হত, যেখানে জার্মানির মাত্র ৪টি উপাদান ছিল।
ইতালির সামান্য লোহা, পেট্রোলিয়াম ছিল কিন্তু কয়লা ছিল না। আর জাপানের পেট্রোলিয়াম, কয়লা, লোহা কিছুই ছিল না। এমনকি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাসস্থানের উপযুক্ত জমিও ছিল না।
🔥আরও পড়ুনঃ-
(৬) জার্মানি, ইতালি প্রভৃতি ফ্যাসীবাদী শক্তিগুলির প্রতি ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের তোষণনীতি (Policy of appeacement) যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল।
৩০-এর দশকে অর্থনৈতিক মন্দায় পুঁজিবাদি দেশগুলির সংকট হয়েছিল, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নে পরিকল্পিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল। ফলে ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স শঙ্কিত হয়ে ওঠে।
তাদের কাছে ফ্যাসীবাদ অপেক্ষা সাম্যবাদ আতঙ্কের কারণ ছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ভেবেছিল, জার্মানি ও ইতালির যুক্তিযুক্ত দাবিগুলি মেনে নিলে তারা সন্তুষ্ট হবে—যুদ্ধের সম্ভাবনা দূর হবে।
ভবিষ্যতে রাশিয়াকে দমন করার জন্য জার্মানির অস্ত্রসজ্জা, লোকার্নো চুক্তিভঙ্গ, অস্ট্রিয়া দখলকে পরোক্ষ সমর্থন জানানো হয়। আবিসিনীয়া আক্রমণের দায়ে অভিযুক্ত ইতালির উপর আরোপিত জাতিসংঘের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ইংল্যান্ড পালন করেনি।
মিউনিখ চুক্তি’তে চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতানল্যান্ডের জার্মানির অন্তর্ভুক্তি স্বীকৃত হয়। ফলে ফ্যাসিবাদি শক্তি উৎসাহিত হয়ে ওঠে।
(৭) কাইজার দ্বিতীয় ইউলিয়ামের দেশত্যাগের পর ফ্রেডারিখ ইবার্টের নেতৃত্বে জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নব প্রতিষ্ঠিত প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রতি কোনো দুর্বলতা না দেখিয়ে বিজয়ী শক্তিবর্গ চরম সময়সীমা ধার্য করে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করে।
এর ফলে নতুন সরকারের সামরিক, আর্থিক শক্তি ও জনমানসে ভাবমুর্তি নষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধ অপরাধীদের হস্তান্তরের বিজয়ী পক্ষের দাবী যেভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রাহ্য করেছিল, সেইরকম দৃঢ়তা ভার্সাই সন্ধির আপত্তিকর ধারার সংশোধনে নতুন সরকার দেখায়নি।
এছাড়া খাদ্যাভাব, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব দূরিকরণে নতুন সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যদিও ভাইমার প্রজাতন্ত্র ‘পৃথিবীর লিখিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান’ প্রণয়ন করেছিল।
জনগণকে সার্বজনীন ভোটাধিকার দান করেছিল, তথাপি দুর্বলতার জন্য রাজতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদিরা ব্যর্থ অভ্যুত্থানে সচেষ্ট হয়। ভাইমার প্রজাতন্ত্রের দুর্বলতার জন্য একনায়কতন্ত্রের উত্থানের পথ প্রশস্থ হয় ।
(৮) জাতিসংঘের দুর্বলতা:
বিশ্বশান্তির জন্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ কাঠামোগত ও সাংবিধানিক কারণে অনেক সমস্যার সমাধানে অক্ষম হয়।
যেমন যুগোস্লোভিয়ার ফিউম ‘এর উপর ইতালির দাবী এবং গ্রিসের কফু দ্বীপের উপর আক্রমণ (১৯২৪ খ্রিঃ), চিনের মাঞ্চুরিয়ার উপর জাপানের আক্রমণ ও দখলদারী (১৯৩১ খ্রিঃ), জার্মানির নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ত্যাগ (১৯৩২-৩৯ খ্রিঃ), ইতালির আবিসিনীয়া আক্রমণ ও দখল (১৯৩৫ খ্রিঃ),
রাইন অঞ্চলে জার্মানির সেনা সমাবেশ (১৯৩৬ খ্রিঃ), স্পেনের প্রজাতন্ত্র উচ্ছেদ (১৯৩৯ খ্রিঃ) জার্মানির অস্ট্রিয়া দখল (১৯৩৮ খ্রিঃ) জার্মানির চেকোস্লোভাকিয়া দখল (১৯৩৯ খ্রিঃ), সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিনল্যান্ড দখল (১৯৩৯ খ্রিঃ) প্রভৃতি। এর ফলে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হয়। যুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যায়।
(৯) শক্তি জোট গঠন:
অতৃপ্ত ইতালি, শত্রু ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের প্রতিদ্বন্দ্বি জার্মানির সঙ্গে ‘রোম-বার্লিন-অক্ষ’ চুক্তি স্বাক্ষর করে (১৯৩৬ খ্রিঃ)। সোভিয়েত জাপান সীমান্ত সংঘর্ষের সূত্রে জাপান জার্মানির সঙ্গে ‘এন্টি কমিন্টার্ন চুক্তি’ স্বাক্ষর করে (১৯৩৬ খ্রিঃ)।
পরে ইতালিও এই চুক্তি স্বাক্ষর করলে ‘রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষ’-জোট গড়ে ওঠে (ডিসেম্বর, ১৯৩৬ খ্রিঃ)। এর প্রত্যুত্তরে পোল্যান্ডের নিরাপত্তার প্রশ্নে ‘পোল্যান্ড-ইংল্যান্ড-ফ্রান্স’ জোট গড়ে ওঠে (৩০ মার্চ, ১৯৩৯ খ্রিঃ)।
(১০) হিটলার পোল্যান্ডের কাছে ডানজিগ বন্দরের জন্য সংযোগ রক্ষাকারী ভূখণ্ড (Corridor) দাবী করলে পোল্যান্ড তা অগ্রাহ্য করে।
তখন হিটলার সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনের সঙ্গে পারস্পরিক অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করে (২৩ আগস্ট, ১৯৩৯) – পোল্যান্ড আক্রমণ করলে (১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ খ্রিঃ) পূর্বচুক্তি অনুযায়ী ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে (৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ খ্রিঃ)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।