আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে শেরশাহের জীবনী (শের শাহ সুরি),এবং তার ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। সুর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শের শাহ সুরির দূরদর্শী ও মেধা বোধশক্তিসম্পন্ন হবার কারণে ভারতের ইতিহাসে তিনি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছেন।
একজন অবহেলিত সন্তান থেকে অদম্য সাহস এবং কঠোর পরিশ্রমের বলে দিল্লির সিংহাসন আরোহন মোটেই সহজ ছিলনা। তিনি প্রতিটি মোড়ে তার শাসন ব্যবস্থাকে সঠিক ভাবে চালানোর জন্য প্রতিটি সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমান করেছেন। নিচে শেরশাহের জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
শেরশাহের জীবনী (শের শাহ সুরি) (Sher Shah’s Career):
নাম | শের শাহ |
প্রকৃত নাম | ফরিদ খান |
পিতা | হাসান খান সুরি |
পুত্র | ইসলাম শাহ সুরি |
কন্যা | খানজাদা মির্জা সুলতান |
বংশ | সুর বংশ |
জন্ম সাল | 1486 খ্রিষ্টাব্দ |
জন্মস্থান | সাসারাম, (ভারতের বিহার রাজ্যে) |
রাজত্ব | 1540-1545 খ্রিষ্টাব্দ |
মৃত্যু হয় | 1545 খ্রিষ্টাব্দ |
সমাধিস্থল | রোহতাসগড়, (ভারতের বিহার রাজ্যে) |
শেরশাহ কে ছিলেন?
দক্ষিণ এশিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ন শাসক হিসাবে শেরশাহ অর্থাৎ শের খান বেশি পরিচিত। এছাড়া তিনি উত্তর ভারতে সুর বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। নিচে শেরশাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হল-
জন্ম ও বাল্যজীবন
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে শের শাহের আকস্মিক আবির্ভাব ও তাঁহার অভাবণীয় সাফল্য-যেমন বিস্ময়কর তেমনি চমকপ্রদ।
শের শাহের আদি নাম ছিল ফরিদ; তিনি ১৪৭২ খ্রীষ্টাব্দে আফগান জাতির শূর উপদলের এক সামান্য জায়গীরদারের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। (শের শাহ-এর জীবনীকার অধ্যাপক কানুনগোর মতে তিনি ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।)
প্রথম জীবনে নানা বিপর্যয়
তাঁহার বাল্যজীবন মোটেই সুখের ছিল না: নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়া, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়া তাঁহার প্রথম জীবন অতিবাহিত হইয়াছিল। তাঁহার পিতা হাসান ছিলেন সাসারামের জায়গীরদার।
বিমাতার চক্রান্তে পিতৃস্নেহ হইতে বঞ্চিত হইয়া তিনি বাল্যকালেই গৃহ ত্যাগ করিতে বাধ্য হন। এই অবস্থায় জৌনপুরে একটি চাকুরী গ্রহণ করিয়া তিনি আপন শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন ।
অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও প্রতিভার পরিচয়
অসাধারণ স্মৃতিশক্তির পরিচয় দিয়া তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই আরবী বা ফার্সী ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তাঁহার তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও প্রতিভার সংবাদ পাইয়া তাঁহার পিতা তাঁহাকে আহ্বান করিলেন এবং সাসারাম ও খেয়াসপুরের শাসনকার্যের দায়িত্ব অর্পণ করিলেন ।
সাসারাম ও খোয়াস- পুরের শাসনকর্তা
দীর্ঘ এগার বৎসর (১৫১১-২২) তিনি এখানে শাসনকার্যে নিযুক্ত থাকিয়া শাসন তাঁহার ও রাজস্ব সংক্রান্ত বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন।
জীবন চরিতে (তারিখ-ই-শের শাহ) লিখিত আছে যে “এই এগার বৎসর ফরিদ অজ্ঞাতসারে নিজের হিন্দুস্থানের সাম্রাজ্য শাসনের উপযোগী শিক্ষায় ব্রতী ছিলেন।” কিন্তু বিমাতার চক্রান্তে আবার তাঁহাকে সাসারাম ত্যাগ করিতে হয় ।
বহর খার অধীনে চাকুরী শের খাঁ উপাধি লাভ
অতঃপর তিনি ভাগ্যান্বেষণে আগ্রায় চলিয়া যান। কিন্তু পিতার মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গে তিনি হইলে তিনি ফিরিয়া আসিয়া সাসারামের জায়গীরদার হন ৷ বিহারের স্বাধীন সুলতান বহুর খাঁর অধীনে চাকুরী গ্রহণ করেন ।
এইখানেই সাহসিকতার সহিত নিজহস্তে একটি ব্যাঘ্র হত্যা করিলে তিনি বহর খা কর্তৃক ‘শের খা’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং তাঁহার পুত্র জালাল খাঁর তত্ত্বাবধানের ভারপ্রাপ্ত হন ।
বাবরের অধীনে চাকুরী (বিহারের শাসনভার)
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বহর খার সহিত মতান্তর উপস্থিত হইলে তিনি ১৫৩৭ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীতে যাইয়া মোগল সম্রাট বাবরের অধীনে চাকুরী গ্রহণ করেন। এই সময়েই মোগল সামরিক ব্যবস্থা ও শাসন- ব্যবস্থার ত্রুটি সমূহ তাঁহার নজরে আসে।
বাবর অবশ্য তাঁহার কাজে সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে সাসারামের জায়গীর ফিরাইয়া দিবার ব্যবস্থা করেন। ইত্যবসরে বহর খাঁর মৃত্যু হইলে শের খাঁই নাবালক জালাল খাঁর অভিভাবক হিসাবে বিহারের শাসনভার গ্রহণ করেন।
চুণার দুর্গ লাভ হুমায়ুনের বশ্যতা স্বীকার
বিহারের শাসনকার্য পরিচালনাকালে তিনি চূর্ণার দুর্গের অধিপতির বিধবা পত্নীকে বিবাহ করিয়া চুণার দুর্গটি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হইয়া হুমায়ুন চুণার দুর্গ অবরোধ করিলেন।
শের খা মৌখিকভাবে তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিয়া তখনকার মত আত্মরক্ষা করিলেন। কিন্তু বিহারের লোহানী অভিজাত- বর্গ বাংলার সুলতান মামুদ শাহের সহিত মিলিত হইয়া তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিলেন।
সুরজগড়ের যুদ্ধে জয়লাভ (বাংলা আক্রমণ)
শের খাঁ অতি সহজেই ১৫৩৪ খ্রীষ্টাব্দে তাহাদের মিলিত বাহিনীকে স্থরগড়ের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করিলেন। এই যুদ্ধের ফলে শের খাঁ বিহারের স্বাধীন সুলতান হইয়া উঠিলেন।
ইহার পর ১৫৩৬ খ্রীষ্টাব্দে শের খা বাংলা আক্রমণ করিয়া যথেষ্ট ধন দৌলত লাভ করিলেন এবং পর বৎসর আবার আক্রমণ চালাইয়া রাজধানী গৌড় পর্যন্ত অধিকার করিলেন ।
আফগানদের সমর্থনে শক্তি বৃদ্ধি
এই সমস্ত কৃতিত্বের ফলে আফগানদের উপদলীয় বিরোধিতা বিনষ্ট হইবার পর শের খাঁ সাধারণভাবে আফগানদের আশা আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল হইয়া উঠিলেন; মোগল প্রভুত্বের অবসান ঘটাইয়া আফগান প্রাধান্য পুনঃ সংস্থাপনের নব-সম্ভাবনায় তাহারা শের খাঁর চতুষ্পার্শে সমবেত হইতে লাগিল ।
শের খাঁর বিরুদ্ধে হুমায়ুনের অভিযান
শের খাঁর ক্ষমতা অত্যাধিক বৃদ্ধি পাইতেছে উপলব্ধি করিয়া হুমায়ুন সসৈন্যে তাঁহার বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন । পথে চুণার দুর্গ দখল করিয়া তিনি বাংলায় উপস্থিত হইলেন। গৌড় তাঁহার পদানত হইল ৷
শের খাঁ সম্মুখ যুদ্ধে অগ্রসর না হইয়া পশ্চাদপসরণ করিলেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে রোটাস, বেণারস, জৌনপুর জয় করিয়া কণৌজ পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন। আগ্রা প্রত্যাবর্তনের পথ রুদ্ধ হইয়া যায় দেখিয়া হুমায়ুন বাংলা হইতে যাত্রা করিলেন।
চৌগার যুদ্ধ ও হুমায়ুনের পরাজয়
পথে চৌসা নামক স্থানে, ১৫৩৯ খ্রীষ্টাব্দে আফগান বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া শোচনীয়ভাবে পরাজিত হইলেন। শের খাঁ নিজেকে বাংলা ও বিহারের স্বাধীন সুলতান বলিয়া ঘোষণা করিয়া শের শাহ উপাধি গ্রহণ করিলেন।
কনৌজের যুদ্ধ হুমায়ুনের পলায়ন
পর বৎসর ১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দে শেষবারের মতো হুমায়ুন ও শেরশাহের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। হুমায়ুন আর একবার শের শাহের সহিত শক্তি পরীক্ষা করিতে আসিয়া কনৌজের যুদ্ধে সম্পূর্ণ পরাজিত হইলেন এবং সিংহাসন ত্যাগ করিয়া পারস্যের পথে পলায়ন করিতে বাধ্য হইলেন। দিল্লী ও আগ্রা শের শাহের পদানত হইল । অতঃপর শের শাহ রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হইলেন ।
🔥আরও পড়ুনঃ-
শের শাহের রাজ্যজয় (Sher Shah’s Conquests):
পাঞ্জাব, সিন্ধু, মুলতান, বাংলা
হুমায়ুনের ভ্রাতা কামরাণ শের শাহের সহিত সন্ধি করিয়া পাঞ্জাবের উপর তাঁহার আধিপত্য ত্যাগ করিতে স্বীকৃত হইলেন। সিন্ধুদেশ এবং মুলতানও তাঁহার সাম্রাজ্যভুক্ত হইল।
ইত্যবসরে বাংলা দেশ বিদ্রোহ করিলে তিনি তাহা দমন করিয়া বাংলা দেশকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করিয়া তাঁহার এক বিশ্বস্ত অনুচরকে বাংলার শাসনভার প্রদান করিলেন। বাংলার শাসনব্যবস্থার সামরিক প্রকৃতি পরিবর্তন করিয়া তিনি শাসনকর্তাকে ‘আমীন-ই-বাংলা’ উপাধি দান করিলেন।
মালব জয় রায়সিন দুর্গ
অতঃপর তিনি মালবের দিকে সসৈন্যে অগ্রসর হইয়া গোয়ালিয়র, সারাংপুর ও উজ্জয়িনী দখল করিলেন। মালবের রায়সিন দুর্গটি তিনি প্রতারণার সাহায্য ছাড়া দখল করিতে সমর্থ হন নাই।
রাজপুতানার বিরুদ্ধে অভিযান
অতঃপর শের শাহ রাজপুতানা অঞ্চলে আক্রমণ চালাইলেন এবং যোধপুর বা মাড়বার অবরোধ করিলেন। এখানে অতিকষ্টে কুট-কৌশলের সাহায্যে তিনি রাজা মালদেবকে পরাজিত করিলেন। অতঃপর চিতোর বিনা যুদ্ধে আত্ম- সমর্পণ করে।
আজমীর হইতে আবু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁহার অধিকারভুক্ত হয়। অবশেষে ১৫৪ 8 খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে বুন্দেলখণ্ডের বিখ্যাত কালিঞ্জর দুর্গ জয় করিতে যাইয়া এক বিস্ফোরণের ফলে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন ।
শের শাহের কৃতিত্ব (An Estimate of Sher Shah):
চরিত্রগত গুণাবলী
মধ্য- যুগীয় ইতিহাসে যে সমস্ত শাসক নানা দিক দিয়া শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করিয়া গিয়াছেন শের শাহ তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও নিরলস কর্মদক্ষতা ছিল তাঁহার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। জীবনের নানা বিপর্যয় ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও তিনি নিজেকে শিক্ষিত করিয়। তুলিয়াছেন, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করিয়া তুলিয়াছেন ।
দৃঢ়তা, অধ্যবসায় ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি
তাঁহার দৃঢ়তা, অধ্যবসায়, চাতুর্য ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি তাঁহার জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করিয়া তুলিয়াছিল, সামান্য এক জায়গীর- দার হইতে দিল্লীর সিংহাসনে উন্নীত করিয়াছিল।
সামরিক প্রতিভা
তাঁহার সামরিক প্রতিভা সর্বজনস্বীকৃত। হুমায়ুনের সহিত যুদ্ধে তিনি তাঁহার সামরিক দূরদৃষ্টি ও দক্ষতার পরিচয় দিয়াছিলেন। মালব, রাজপুতানা ও বুন্দেলখণ্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তাঁহার সামরিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
শত্রুপক্ষকে পরাজিত করিবার জন্য তিনি কূট কৌশলেরও সাহায্য গ্রহণ করিতেন। শের শাহ সাধারণতঃ বীরধর্ম আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন।
কিন্তু রায়সিন দুর্গ দখলের সময়ে তিনি যে প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা তাঁহার চরিত্রে কিছুটা কলঙ্ক লেপন করিয়াছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। রাজ আদর্শ সম্বন্ধেও তাঁহার ধারণা ছিল অতি উচ্চ।
রাজ আদর্শ স্বৈরাচারী, কিন্তু প্রজাহিতৈষী
শাসক হিসাবে তিনি স্বৈরাচারী হইলেও প্রজা সাধারণের কল্যাণ সাধনই তাঁহার মূল উদ্দেশ্য ছিল। রাজস্ব-সংস্কার, কৃষক শ্রেণীকে রক্ষা করিবার বিবিধ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ প্রভৃতি তাহার সাক্ষ্য দেয়।
প্রজামঙ্গলকামী কার্যাবলী
জনসাধারণের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তিনি বহু অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করিয়াছিলেন, তাহাদের সুখ শান্তির জন্য পুলিশ বাহিনী সুসংগঠিত করিয়াছিলেন।
ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচারের জন্য সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন করিয়াছিলেন। ঘোড়ার পিঠে ডাক বহনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করিয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করিয়াছিলেন ।
“He had more of the spirit of a legislator and guardian of his people than any prince before Akbar. -Erskine.
ধর্মে উদারতা
শের শাহ নিজে ছিলেন ধর্মপরায়ণ মুসলমান, কিন্তু তিনি শাসনকার্যে কোন সময়েই ধর্মান্ধতা প্রদর্শন করেন নাই। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল প্রজার প্রতি তিনি সমান ব্যবহার করিতেন, হিন্দু ও মুসলমান প্রজার মধ্যে সাধারণতঃ তিনি কোনরূপ বৈষম্যমূলক ব্যবহার করিতেন না; ধর্ম সম্বন্ধে তিনি ছিলেন উদার।
রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি
তিনি তাঁহার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দ্বারা বুঝিয়াছিলেন যে দেশের সমগ্র জনসাধারণের সমর্থনের ভিত্তিতেই স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপিত হইতে পারে; তাই তিনি ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করিবার জন্য চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন।
হিন্দুদের মধ্যেও যোগ্য ব্যক্তিগণকে শাসন ও বিচারের ক্ষেত্রে নিয়োগ করিতে তিনি দ্বিধা করেন নাই। “Of all the mediaeval rulers Sher Shah stands as the ideal of the new India of Hindus and Mussalmans alike.”-Qanungo.
শাসক হিসাবে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার শক্তি বৃদ্ধি
কিন্তু শাসক হিসাবেই শের শাহ, তাঁহার কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন সবচেয়ে বেশী। তিনি মাত্র পাঁচ বৎসর দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। যুদ্ধ- বিগ্রহে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি এই স্বল্প সময়ের মধ্যে শাসনক্ষেত্রে যে সংস্কার সাধন করিয়াছিলেন তাহা অভূতপূর্ব।
স্থানীয় আফগানদের দমন করিয়া তিনি কেন্দ্রীয় শাসনকে শক্তিশালী করিয়া তুলিলেন, প্রদেশগুলির শাসনব্যবস্থাকে সুনিয়ন্ত্রিত করিলেন ।
সাম্রাজ্যের সংহতি বৃদ্ধি
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে সেনানিবাস স্থাপন করিয়া, বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করিয়া তিনি সাম্রাজ্যকে সংহত করিলেন। তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র একই ধরণের রাজনীতি ও মুদ্রার প্রচলন করিলেন, রাজকর্মচারীদের স্থানান্তরের ব্যবস্থা করিলেন।
শাসনব্যবস্থার সর্বভারতীয় রূপ
এইরূপ ভাবে তিনি শাসনব্যবস্থাকে সর্বভারতীয় শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তিত করিলেন। সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত করিয়া তিনি দেশে এক নবযুগের সৃষ্টি করিলেন ।
বিদ্যানুরাগ ব্যক্তিগত জীবন
শের শাহ যে কেবলমাত্র যোদ্ধা এবং সুশাসক ছিলেন তাহাই নয়; তিনি বিদ্যানুরাগেরও পরিচয় দিয়া গিয়াছেন। আরবী ও ফারসী ভাষায় তিনি যথেষ্ট বুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন ।
শিক্ষা বিস্তার কল্পেও তিনি যথেষ্ট উৎসাহ দেখাইয়া গিয়াছেন। তাঁহার প্রকৃতির মধ্যে নিষ্ঠুরতার কোন পরিচয় পাওয়া যায় নাই, অযথা রক্তপাতের পক্ষপাতী তিনি কোন সময়েই ছিলেন না ।
আকবর ও শের শাহ
আকবরের সহিত স্বভাবতঃই তাঁহার তুলনা করা হইয়া থাকে। একথা অনস্বীকার্য যে আকবর তাঁহার শাসনকার্যের সাফল্যের জন্য শের শাহের কাছে অনেকাংশে ঋণী। শের শাহের রাজস্বনীতি, মুদ্রানীতি প্রভৃতি অবলম্বন করিয়াই আকবর তাঁহার শাসনব্যবস্থাকে আরও উন্নত করিয়াছিলেন।
অবশ্য আকবর তাঁহার নিজস্ব সংগঠনী প্রতিভা ও সৃজনী শক্তির পরিচয় দিয়াছেন বহুক্ষেত্রে। আকবরের ধর্মনীতি ছিল শের শাহের ধর্মনীতি অপেক্ষা আরও উদার।
কারণ শের শাহের সময়ে হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর অব্যাহত ছিল; কিন্তু আকবর তাহা উঠাইয়া দিয়া সর্বভারতীয় ঐক্যসাধনে আরও অগ্রসর হইতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
উপসংহার
উপরে শেরশাহের জীবনী (শের শাহ সুরি) আলোচনা করে আমরা এটা বলতে পারি যে শের শাহের রাজত্ব এবং সংস্কারগুলি ভারতীয় ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে, যা তাকে সমসাময়িক মধ্যযুগীয় ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে একজন করে তোলে। সংগ্রামী জীবন থেকে উঠে এসে রাজসিংহাসনে মুকুট ধারণের তাঁর কৃতিত্ব এবং অবদান অনস্বীকার্য।
FAQs
প্রশ্ন: শূর বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
উত্তর: শূর বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন শের শাহ শুরি।
প্রশ্ন: শের খান এর প্রকৃত নাম কি?
উত্তর: শের খান এর প্রকৃত নাম ফরিদ খান।
প্রশ্ন: শের খান নামে কে পরিচিত?
উত্তর: শের খান নামে শের শাহ শুরি বা ফরিদ খান পরিচিত।
প্রশ্ন: শের শাহের বংশের নাম কী?
উত্তর: সুরি বংশের শাসক ছিলেন শের শাহ।
প্রশ্ন: শেরশাহের প্রকৃত নাম কি?
উত্তর: শের শাহের প্রকৃত নাম ছিল ফরিদ খাঁ।
প্রশ্ন: শেরশাহের বাল্য নাম কি?
উত্তর: শেরখান ছিল সুর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শেরশাহের বাল্যনাম।
প্রশ্ন: শেরশাহের হিন্দু সেনাপতির নাম কি?
উত্তর: ব্রহ্মজিৎ গৌড় ছিলেন শেরশাহের হিন্দু সেনাপতির।