ভারতের হিন্দু রাজাদের মধ্যে শিবাজি ছিলেন অন্যতম, এই আর্টিকেলতে শিবাজীর চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করবো। মহান যোদ্ধা হিন্দু রাজা শিবাজি, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ নামেও পরিচিত। তার চরিত্র ও কৃতিত্ব দেখে এখন পর্যন্ত অনেকে অনুপ্রাণিত হয়। ভারতের একজন জাতীয় নায়ক হিসাবে তাকে সম্মান করা হয়।
শিবাজি মহারাজ 17 শতকে পশ্চিম ভারতে মারাঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠান করেন। তার দ্বারা মারাঠা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সব ধর্মের প্রতি ধর্মীয় সহনশীলতা রেখে হিন্দু রাজ্য গঠন তিনি অঙ্গীকার বদ্ধ হয়েছিলেন। নিচে শিবাজীর উল্লেখযোগ্য চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা করা হল।
শিবাজীর চরিত্র ও কৃতিত্ব । Achievements of Shivaji in Bengali
ছত্রপতি শিবাজী ভারতের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এবং রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে অন্যতম একজন জননায়ক হিসাবে পরিচিত। শিবাজীর চরিত্র এবং কৃতিত্ব ভারতীয়দের মনে ও প্রানে স্থান দখল করে আছে । এখানে শিবাজী চরিত্র এবং কৃতিত্বের কিছু মূল দিক আলোচনা করবো:
সামরিক প্রতিভা:
শিবাজি তার অভিনব সামরিক কৌশলের জন্য তিনি বিখ্যাত। তিনি মারাঠা নৌবাহিনী নামে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনীর গঠন করেন এবং দক্ষ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন, এছাড়া তার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী মারাঠা সাম্রাজ্য রক্ষায় এবং বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তিনি যুদ্ধের জন্য গেরিলা নামে একটি বাহিনী নির্মাণ করেন। তার উদ্ভাবনী দুর্গ এবং দক্ষ নৌ বাহিনীর কৌশলকে চ্যালেঞ্জ করতে অনেক বড় এবং শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত।
প্রশাসনিক সংস্কার:
শিবাজি একটি ন্যায় ও দক্ষ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বেশ কিছু প্রশাসনিক সংস্কার করেন। তিনি অষ্ট প্রধান (আটজন মন্ত্রী) নামে একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন।
যারা অর্থ, পররাষ্ট্র বিষয়ক এবং ন্যায়বিচারের মতো শাসনের বিভিন্ন দিকগুলির সম্পর্কে শিবাজীকে পরামর্শ দিতেন। তিনি তার প্রজাকল্যাণে রাজস্ব সংস্কার এবং বিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার উপর জোর দেন।
নৌ শক্তি:
শিবাজি তার সাম্রাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলগুলিকে সুরক্ষিত করার জন্য একটি শক্তিশালী নৌবাহিনীর গুরুত্বকে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ এবং উপকূলীয় দুর্গের নির্মাণের মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী তৈরি করেছিলেন।
তার নৌবাহিনী যে কেবল বিদেশী আক্রমণ থেকে তার অঞ্চলগুলিকে রক্ষা করেনি বরং কোঙ্কন এবং গোয়া উপকূলরেখা বরাবর তার প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
দুর্গ এবং স্থাপত্য:
শিবাজি একজন চতুর ও দক্ষ দুর্গ নির্মাতা ছিলেন। তিনি তার রাজ্য জুড়ে অসংখ্য দুর্গ তৈরি করেছিলেন, শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কৌশলগতভাবে দুর্গ গুলির অবস্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ । তাঁর শাসনামলে নির্মিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দুর্গের মধ্যে রয়েছে রায়গড়, প্রতাপগড় এবং সিন্ধুদুর্গ।
হিন্দুধর্ম এবং ধর্মীয় সহনশীলতার প্রচার:
শিবাজি একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু ছিলেন এবং তিনি সক্রিয়ভাবে হিন্দু ধর্মের পালন এবং প্রচার করতেন। তাহলেও তিনি একজন ধর্মীয় সহনশীলতার মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যের মধ্যে সমস্ত ধর্মের লোকদের উপাসনার স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন। তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয়কে তার প্রধান প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত করেন ।
মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ:
শিবাজি মুঘল সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণবাদী নীতি, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণকে তীব্রভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন। তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযান চালান এবং সফলভাবে তার অঞ্চল রক্ষা করেন।
অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সাথে তার কৌশলগত জোট এবং বিভিন্ন মারাঠা গোষ্ঠীকে একত্রিত করার ক্ষমতা মুঘলদের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বহুমুখী প্রতিভা অধ্যবসায় ও উদ্ভাবনী শক্তি
শিবাজী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সামান্য একজন জায়গীরদারের অবহেলিত পুত্র হইয়াও তিনি এক স্বাধীন হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন—ইহাতেই তাঁহার ক্ষমতা ও চারিত্রিক গুণাবলীর পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁহার ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ; তিনি ছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রমী, অধ্যবসায় ছিল তাঁহার অন্যতম গুণ। তাঁহার উদ্ভাবনী শক্তি ছিল অসাধারণ।
🔥আরও পড়ুনঃ-
উচ্চ আদর্শ, বাস্তবতা ও রাজনৈতিক দুরদর্শিতা
উচ্চ আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন থাকিতেন। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সহিত কূটকৌশলের সমন্বয় সাধন করিতে তিনি কোন সময় ভুল করিতেন না।
ধর্মপরায়ণ ও পরধর্ম সহিষ্ণু মানবতা বোধ
তিনি ছিলেন ধর্মপরায়ণ, কিন্তু পরধর্মসহিষ্ণু। যুদ্ধের সময়ে কোন মসজিদ তিনি ধ্বংস করেন নাই, কোন ধর্মগ্রন্থের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন নাই ৷ অযথা হত্যা বা অত্যাচার করা তাঁহার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। স্ত্রীজাতিকে রক্ষা করা তিনি তাঁহার অন্যতম কর্তব্য বলিয়া মনে করিতেন। “No blind fanatic, no mere brigand can found a State.” –Sir Judu Nath Sarkar.
তাঁহার সবচেয়ে বড় সমালোচক কাফী খাঁ-কেও শিবাজীর এই সমস্ত গুণাবলী স্বীকার করিতে হইয়াছে। “But he made it a rule that whenever his followers went plundering, they should do no harm to mosques, the Book of God, or woman of any one.
Whenever a copy of sacred Koran came into his hands he treated it with respect and gave it to some of his Mussalman followers.”- Khafi Khan. মানবতার দিক দিয়া তাই শিবাজী সমকালীন রাজন্যবর্গের বহু উর্ধে ছিলেন।
তাঁহার কৃতিত্ব স্বাধীন হিন্দুরাজ্য স্থাপন
চরিত্রের এই সমস্ত গুণাবলীর জন্যই তিনি জীবনে অভূতপূর্ব কৃতিত্ব অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। শতধা বিভক্ত ও বিক্ষিপ্ত মারাঠা জাতিকে তিনি জাতিয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিলেন; তাহাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আনিয়া মারাঠাগণকে এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করিয়াছিলেন। চতুর্দিকের বিরুদ্ধ শক্তি সমূহের বিরুদ্ধে অবিরত সংগ্রাম চালাইয়া তিনি একটি নূতন স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন।
সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থার প্রবর্তক সামরিক সংগঠক
কেবলমাত্র সামরিক শক্তির জোরে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করিয়াই তিনি ক্ষান্ত হন নাই। তিনি তাঁহার রাজ্যে একটি সুন্দর সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করিয়াছিলেন। রাষ্ট্রশাসন ব্যাপারে তিনি তাঁহার সৃজনী শক্তির পরিচয় দিয়া গিয়াছেন; ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতার ভিত্তিতে শাসন পরিচালনা করিয়া তিনি প্রজাসাধারণের শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করিয়াছিলেন।
তাঁহার শাসনব্যবস্থা, বিচারপদ্ধতি প্রভৃতি আধুনিক ঐতিহাসিক মাত্রেরই প্রশংসা অর্জন করিয়াছে। ‘Shivaji was not only the maker of the Maratha nation but also the greatest constructive genius of medieval India.”-Dr. Sarkar সামরিক সংগঠক হিমাবেও তিনি যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়া গিয়াছেন তাহাও ইতিহাসে বিরল।
শাসনব্যবস্থার ত্রুটি শিবাজীর অমরত্ব
এ কথা সত্য যে তাঁহার শাসনব্যবস্থা ছিল একনায়কতন্ত্র এবং সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ; বহু যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকিবার ফলে তিনি সাম্রাজ্যের সংহতি যথেষ্ট পরিমাণে স্থাপন করিয়া যাইতে পারেন নাই। একথাও সত্য যে তাঁহার রাজ্যে ক্রমে গোঁড়া হিন্দু সম্প্রদায়েরই প্রভুত্ব স্থাপিত হইয়াছিল।
কিন্তু তথাপি ইহা অনস্বীকার্য যে শিবাজী তাঁহার জীবনে যে কৃতিত্ব ও সাফল্য দেখাইয়াছেন তাহাতে ইতিহাসে তিনি অমর হইয়া আছেন। “Shivaji’s claim to a high rank in the page of history must be admitted”. -Grant Duff.
উপসংহার
মারাঠা শক্তির উত্থানে শিবাজীর চরিত্র ও কৃতিত্ব জন্য তাকে ভারতীয় ইতিহাসে একটি সম্মানিত মহান ব্যক্তিত্ব করে তোলে। তার উত্থান, সামরিক দক্ষতা, সুশাসন ব্যাবস্থা, সাংস্কৃতিক সংস্কার, স্থাপত্যশৈলী, নৌ বাহিনী এবং ধর্মীয় সহনশীলতাময় তার বহুমুখী ব্যাক্তিত্বের জন্য আজ তিনি পূজিত হন। প্রবল বিরোধিতার মুখেও তার হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ভারতীয় ইতিহাসে একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলে।
তার প্রতিষ্ঠিত মারাঠা সাম্রাজ্য, ভারতে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছিল, যা আগামী শতাব্দীর জন্য দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে প্রভাবিত করে। শিবাজী মহারাজের চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে আপনাদের আর অন্য কোনো তথ্য জানা থাকলে আপনারা আমাদের কম্যান্ড বাক্সতে জানাতে পারেন।
FAQs শিবাজীর চরিত্র ও কৃতিত্ব
প্রশ্ন: শিবাজী কে ছত্রপতি উপাধি দেন কে?
উত্তর: দৌহিত্র মহারাণী তারাবাই শিবাজীকে ছত্রপতি উপাধি দেন।
প্রশ্ন: শিবাজীর রাজ্যের রাজধানী কোথায় ছিল?
উত্তর: শিবাজীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মারাঠা রাজ্যের রাজধানী ছিল রাজগড়।
প্রশ্ন: শিবাজীর ঘোড়ার নাম কি?
উত্তর: চেতক ছিল শিবাজি মহারাজের ঘোড়ার নাম।
প্রশ্ন: শিবাজীর রাজ্যাভিষেক কবে হয়েছিল?
উত্তর: ১৬৭৪ সালে শিবাজীর রাজ্যাভিষেক হয়েছিল।
প্রশ্ন: শিবাজীর গুরু কে ছিলেন?
উত্তর: রামদাস শিবাজীর গুরু ছিলেন।
প্রশ্ন: শিবাজীর রাজ্যাভিষেক কবে কোথায় হয়?
উত্তর: রায়গড় দুর্গে (বর্তমানে মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলায় অবস্থিত) 6 জুন 1674 সালে 44 বছর বয়েসে শিবাজি মহারাজের রাজ্যাভিষেক হয়।
প্রশ্ন: শিবাজীর তরবারির ওজন কত?
উত্তর: শিবাজীর তরবারির ওজন ছিল ১ কেজি ১১০ গ্রাম।