বিশ্ব ইতিহাসে বার্লিন একটি প্রধানতম ‘ঝটিকা কেন্দ্র’ ছিল। (Storming Centre)। জার্মানির পরাজয়ের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে; আবার জার্মানিকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধোত্তর বিশ্বের সংকট শুরু হয়।
বস্তুতপক্ষে যুদ্ধ শেষ হবার আগেই ইয়াল্টা সম্মেলনে (১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারি) ক্ষতিপূরণ ও বেসামরিকীকরণের প্রশ্নে ভালিনের সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন মতভেদ দেখা দেয় এবং বিষয়টা শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতই থেকে যায়।
অবশেষে পটসডাম সম্মেলনে (১৯৪৫, আগস্ট) জার্মানিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে চারটি অধিকৃত অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়া হয়।
অকথানগত কারণে পশ্চিমি অধিকৃত বার্লিন শহরের একশো মাইল ভূখণ্ড সোভিয়েত অধিকৃত পূর্ব জার্মানির মধ্যস্থানে পড়ে। খাল ও সড়ক পথে এই অংশের সঙ্গে পশ্চিম জার্মানির যোগসূত্র ছিল। এই বার্লিনকে কেন্দ্র করে সংকট সৃষ্টি হয়।
জার্মানিতে রাশিয়া ও আমেরিকার পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি :
জার্মানির ভবিষ্যৎ প্রশ্নে রাশিয়া ও পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গ পরস্পর বিরোধী মনোভাব গ্রহণ করে। সোভিয়েত রাশিয়া জার্মানিতে একটা কেন্দ্রীভূত সরকার গঠন করতে চেয়েছিল। কারণ, তার লক্ষ্য ছিল জার্মানির সম্পদ আহরণ করে সোভিয়েত অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা।
অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল জার্মানিতে একটা গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। রাশিয়া তার দখলিকৃত অঞ্চলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করতে মনস্থির করে।
তাই ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের শুরু থেকেই রাশিয়া পূর্ব জার্মানি থেকে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে উৎখাত করতে থাকে।
সেখানে সোশ্যালিস্ট দলকে কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে যুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টি’ (Socialist Unity Party)। অতি স্বাভাবিক কারণে পূর্ব জার্মানি সোভিয়েত রাশিয়ার দখলে এসে নতুন করে সম্পদ আহরণের পরিবর্তে আর্থিক নিষ্ক্রমণের কোপে পড়েছিল।
🔥আরও পড়ুনঃ-
পশ্চিম জার্মানির সমৃদ্ধি :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব প্রভৃতি ছিল জার্মানির নিত্যদিনের সঙ্গী। এরূপ অবস্থায় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের মধ্যে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অধিকৃত তিনটি অঞ্চল একসঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি ‘ত্রিপাক্ষিক এলাকা’ (Trizonia) সৃষ্টি করে।
মার্শাল পরিকল্পনা অনুযায়ী নবগঠিত অঞ্চলে আর্থিক উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নতুন ব্যাংক ব্যবস্থা এবং নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এর ফলে মুদ্রামানে স্থিতিশীলতা আসে। শিল্প উৎপাদন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া :
অপরদিকে জার্মান সম্পদ লুণ্ঠন করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সোভিয়েত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চলছিল। তার ফলে পূর্ব জার্মানি দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছিল।
পশ্চিম জার্মানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই ক্রমান্বয়ে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হচ্ছিল এবং পশ্চিমি রাষ্ট্রগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার শুরু করে।
১৯৪৮-এর ২০শে জুন পশ্চিম জার্মানিতে নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে রাশিয়া আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ পশ্চিমাঞ্চলের স্থিতিশীল মুদ্রা ব্যবস্থার সঙ্গে পূর্বজার্মানির সোভিয়েত-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মুদ্রা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে এবং এর ফলে ভেঙে পড়বে পূর্ব জার্মানির অর্থনীতি।
সোভিয়েত রাশিয়ার বার্লিন অবরোধ :
এরূপ পরিস্থিতিতে পশ্চিমি রাষ্ট্রগোষ্ঠীর ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সোভিয়েত রাশিয়া বার্লিন শহরকে পশ্চিম জার্মানি থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ১৯৪৮-এর ২৪শে জুলাই বার্লিন অবরোধ করে।
বার্লিন ছিল সম্পূর্ণভাবে সোভিয়েত রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জার্মানির অন্তর্ভুক্ত। অথচ বার্লিন শহরটিও ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে চারটি অধিকৃত এলাকায় বিভক্ত হয়েছিল।
পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গের অধিকৃত বার্লিনের সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিল না। পশ্চিম জার্মানি থেকে পূর্ব বা পশ্চিম বার্লিনে আসতে হলে সোভিয়েত রাশিয়া অধিকৃত অঞ্চলের ওপর দিয়ে সড়কপথে বা রেলপথে আসতে হত।
সোভিয়েত রাশিয়া পশ্চিম বার্লিনের সঙ্গে পশ্চিম জার্মানির সড়কপথ, রেলপথ, খাল ইত্যাদির দ্বারা যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল তা ছিন্ন করে দেয়।
সোভিয়েত রাশিয়ার বার্লিন অবরোধের উদ্দেশ্যই ছিল পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গের ওপর এইভাবে চাপ সৃষ্টি করে বার্লিনের ওপর তাদের আধিপত্য ত্যাগ করতে বাধ্য করা এবং পশ্চিম জার্মানিতে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিকল্পনাকে বানচাল করে দেওয়া।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো মতেই সোভিয়েত চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি ছিল না। তাই পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গ পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য প্রতিদিন আকাশপথে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পশ্চিম বার্লিনে পাঠাতে থাকে।
এই ঘটনা “Berlin Airlifi” নামে খ্যাত। সোভিয়েত রাশিয়ার এই সরবরাহ বন্ধ করতে সাহস হয়নি। ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার বার্লিন অবরোধ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। ফলে ১৯৪৯-এর ১২ই মে প্রায় দশমাস পর সোভিয়েত রাশিয়া বার্লিন অবরোধ প্রত্যাহার করে নিল ।
পরস্পর বিরোধী সামরিক জোট ও দ্বিতীয় বার্লিন সংকট :
এইভাবে প্রথম বার্লিন সংকটের অবসান হলেও বার্লিন সমস্যার সমাধান হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহায়তায় পশ্চিম জার্মানি দ্রুত অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ওঠে। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম জার্মানিকে ন্যাটোর (NATO) সদস্য করা হয়।
এর প্রত্যুত্তরে রাশিয়া গড়ে তোলে ওয়ারশ চুক্তি (Warsaw Pact) এবং পূর্ব জার্মানিকে ওয়ারশ জোটের সদস্য করা হয়। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি পরস্পর বিরোধী শক্তিজোটের সদস্য হওয়ায় দ্বিতীয় বার্লিন সংকট-এর উদ্ভব হয়।
সোভিয়েত রাশিয়া জার্মানির ঐক্য সমর্থন করেছিল। পূর্ব জার্মানি ১৯৫৭-র জুলাই মাসে পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানিকে নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দেয়। রাশিয়ার ওই প্রস্তাবে সমর্থন ছিল।
কিন্তু পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গ প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৫৮-য় রাশিয়া বার্লিনকে একটি ‘মুক্ত নগর’ ঘোষণা করার প্রস্তাব দেয়। আমেরিকা এই প্রস্তাবে কর্ণপাত করেনি। উপরন্তু প্রয়োজনে সশস্ত্র সংঘর্ষের হুমকি দেয়।
নভেম্বর মাসে রাশিয়া পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গকে ৬ মাসের মধ্যে বার্লিন ত্যাগের জন্য চরমপত্র দেয়। সংকট এড়াতে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির বিদেশ মন্ত্রীদের এক সম্মেলন জেনেভায় আহৃত হয়।
এই সম্মেলনেও সমস্যার সমাধান হল না। এ সময় পূর্ব জার্মানি থেকে সাম্যবাদ বিরোধী অনেকে পশ্চিম বার্লিনে আশ্রয় নিতে থাকে।
পশ্চিমি রাষ্ট্রজোট এদের উৎসাহ দিত। তাই ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব জার্মানির সেনাবাহিনী পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে প্রাচীর গড়ে তোলে। এই ভাবে একই নগরীর মধ্যে দুর্ভেদ্য কৃত্রিম ব্যবধান তৈরি হয়।
শেষ পর্যন্ত ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে গণরোষের আঘাতে বার্লিন প্রাচীর চূর্ণ হয়। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৩রা অক্টোবর নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়।