দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
4.2/5 - (5 votes)

আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ অনুসন্ধান করবো। কোনো সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন হল চিরসত্য প্রকৃতির নিয়ম যার হাত থেকে আজ পর্যন্ত কেউ রক্ষা পায়নি।

কুতুবুদ্দিন আইবেকের দ্বারা 1206 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত দিল্লির সুলতান বংশ 1526 খ্রীষ্টাব্দে ইব্রাহিম লোদীর সময়ে শেষ পরিণতি পায়।

দীর্ঘ 320 বছর ধরে চলা দিল্লির সুলতান বংশ মুঘল সম্রাট বাবরের সঙ্গে চলা পানিপথের যুদ্ধে সুলতান সম্রাট ইব্রাহিম পরাজিত হন এবং দীর্ঘদিন ধরে ভারত শাসন করা সুলতান সাম্রাজ্যের পতন হয়। নিচে জেনে নেওয়া যাক সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি কি কি ছিল?

সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

এক নজরে

দীর্ঘ তিন শতাব্দীরও অধিককাল দিল্লীর সুলতানি টিকিয়া ছিল বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজত্বের শেষভাগ হইতেই ইহার পতনের সূত্রপাত হইয়াছিল; পরবর্তী সুলতান ফিরোজ শাহ এবং তাঁহার তুঘলক বংশীয় বংশধরগণ সেই পতনকে তো রোধ করিতে পারেনই নাই, বরং তাহাদের কার্যকলাপ সে পতনকে আরও দ্রুত করিয়া দিয়াছিল।

সৈয়দ ও লোদী- বংশীয় সুলতানগণের পক্ষে সেই পতন প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না, তাঁহাদের সে ক্ষমতাও ছিল না । এত দীর্ঘস্থায়ী এত বড় একটি সাম্রাজ্যের পতন কোন একটি কারণে সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয় । দিল্লীর তুর্কী-আফগান সাম্রাজ্যের পতনের পশ্চাতেও বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করিয়াছিল।

জনসাধারণ হইতে বিচ্ছিন্ন

সর্বপ্রথমেই ইহা উল্লেখ করিতে হয় যে দিল্লীর সুলতানির সহিত দেশের জনসাধারণের কোন যোগসূত্র ছিল না। সে যোগসূত্র স্থাপন করিয়া সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার কোন চেষ্টা ও বেশির ভাগ সুলতানের দেখা যায় নাই, সে উপলব্ধিও তাঁহাদের ছিল না। দেশবাসী হইতে বিচ্ছিন্ন রাজশক্তির স্থায়িত্ব কোন সময়েই দীর্ঘ হয় না।

পরধর্ম সম্বন্ধে অনুদার নীতি 

দ্বিতীয়তঃ, শাসক ও শাসিতের এই ব্যবধান বেশির ভাগ সুলতানগণের অনুসৃত নীতির ফলেই বৃদ্ধি পাইয়াছিল। দেশবাসীর বিরাট অংশ ছিল হিন্দু; তাহাদের সম্বন্ধে এবং তাহাদের ধর্ম সম্বন্ধে সুলতানগণের অনুদার নীতি তাহাদিগকে সব সময়েই বিদ্রোহী করিয়া তুলিত।

হিন্দুদের বিরোধিতা এবং অসহযোগিতা

রাজপুতদের যুদ্ধবিগ্রহ, বিজয়নগরের প্রতিষ্ঠা, হিন্দু জমিদারগণের বিরোধিতা—এ সমস্তই সুলতানি শক্তিকে বিশেষভাবে দুর্বল করিয়াছিল। এই ধর্মান্ধতা এবং রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ।

কেবলমাত্র সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল

তৃতীয়তঃ, দেশবাসীয় সমর্থন হইতে বঞ্চিত সুলতানি শক্তি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হইয়া উঠিয়াছিল তাঁহাদের সামরিক শক্তির উপর। দুর্বল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সুলতানগণের একনায়কত্ব এবং স্বৈরাচারী শাসন সামরিক শক্তিকেই একমাত্র আশ্রয় করিয়া টিকিয়াছিল।

কিন্তু ইহাতে কোন সাম্রাজ্যই দীর্ঘস্থায়ী হয় না; অল্পকালের মধ্যেই সামরিক শক্তিতে ঘুণ ধরিয়া যায় এবং তাহার পতন অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠে ।

জায়গীরদারী সামস্ত প্রথার কুফল

চতুর্থতঃ, সুলতানি সামরিক শক্তি আবার প্রতিষ্ঠিত ছিল জায়গীরদারী এবং সামন্ত-প্রথার উপর। বিশেষ করিয়া ফিরোজ শাহ কর্তৃক সামন্ত প্রথা পুনঃপ্রবর্তনের ফলে কেন্দ্রীয় সামরিক শক্তিই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল । কোন কারণে সুলতান দুর্বল হইলেই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলি বিদ্রোহন্মুখ হইয়া উঠিত এবং সাম্রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট করিত।

অভিজাত শ্রেণীর নৈতিক অধঃপতন

পঞ্চমতঃ, অভিজাত শ্রেণীই ছিল স্থূলতানি সাম্রাজ্যের স্তম্ভ স্বরূপ। তাহারাই ছিল জায়গীরদার, রাজকর্মচারী এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তা । চতুর্দশ শতাব্দী হইতেই তাহাদের নৈতিক অবনতি খুবই স্পষ্ট হইয়া দেখা দেয়; ফলে সমগ্র শাসনব্যবস্থাই দুর্নীতিগ্রস্ত হইয়া উঠে।

ক্রীতদাসের সংখ্যাধিক্য

ষষ্ঠতঃ, ক্রীতদাসের সংখ্যাধিক্য সাম্রাজ্যের স্বার্থ ও নিরাপত্তা নানা দিক দিয়া বিঘ্নিত করিয়া তুলিয়াছিল, সমস্ত আবহাওয়াকে বিষাক্ত করিয়া তুলিয়াছিল। এইরূপ দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্বল শাসনব্যবস্থা যে কোন আঘাতেই ভাঙ্গিয়া পড়িবে ইহাই স্বাভাবিক ।

সেই আঘাত আসিল তৈমুর ও বাবরের আক্রমণের মধ্য দিয়া শেষ দিকের সুলতানগণ ও সুলতানি শাসনব্যবস্থা সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার ক্ষমতা রাখিত না।

তৈরলঙ্গের ভারত আক্রমণ

১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্য এশিয়ায় তৈমুর লঙ্গ তাঁহার বিরাট বাহিনী লইয়া দিল্লীর সুলতানির উপর চরম আঘাত হানিল । তাহার অবাধ হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠনের ফলে সমগ্র সাম্রাজ্যে অব্যবস্থা দেখা দিল।

কেন্দ্রীয় শক্তি একেবারে দুর্বল হইয়া পড়িল, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিগণ বিভিন্ন দিকে প্রাধান্য বিস্তার করিতে লাগিল । এই আঘাতের পর সুলতানি শক্তি আর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইতে পারে নাই।

বাবরের আক্রমণ

ইহার ২৮ বৎসর পর লোদী বংশের শেষ সুলতান ইব্রামিহ লোদী পাণিপথের প্রান্তরে বাবরের বাহিনীকে প্রতিরোধ করিতে পারিল না, সুলতানি রাজত্বেরও পরিসমাপ্তি হইয়া গেল।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 ফিরোজ শাহ তুঘলক

তৈমুর লঙ্গের ভারত আক্রমণ ফলাফল (Invasion of Timur and its effects):

ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা

১৩৮৮ খ্রীষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর দিল্লীর সুলতান পদ লইয়া তুঘলক বংশধরগণের মধ্যে এক অশুভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিয়াছিল। সেই অবসরে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ একের পর এক স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া যখন সুলতানি শক্তিকে দুর্বল করিয়া ফেলিতেছিল, তখনই আসিল বহির্দেশ হইতে তৈমুরলঙ্গের আক্রমণ। এই আক্রমণ সুলতানি সাম্রাজ্যের উপর চরম আঘাতের কাজ করিল ।

তৈমুরলঙ্গ তাঁহার ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্য

১৩৬৯ খ্রীষ্টাব্দে সমরখন্দের সিংহাসনে আরোহণ করিয়া তৈমুর চিঙ্গিজ খার সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনের জন্য সচেষ্ট হইয়া উঠিলেন। পারস্য, আফগানিস্তান, মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি দেশ জয় করিয়া তিনি ভারতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের কোন উদ্দেশ্য তাঁহার ছিল বলিয়া মনে হয় না।

মূল উদ্দ্যে লুণ্ঠন

ভারতের পৌত্তলিকতার বিনাশ সাধনই তাঁহার প্রধান উদ্দেশ্য বলিয়া তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করিয়াছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধনরত্ন লুণ্ঠনের সুযোগ গ্রহণই তাঁহার এই অভিযান পরিচালনা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল।

তাঁহার বিশাল দুধর্ষ সেনাবাহিনী ১৩১৮ খ্রীষ্টাব্দে একে একে সিন্ধু ও তাহার উপনদীগুলি অতিক্রম করিয়া এবং পথিপার্শ্বস্থ শহরগুলি লুণ্ঠন করিয়া দিল্লীর উপকণ্ঠে উপস্থিত হইল। সুলতান নাসিরুদ্দিন মহম্মদ ও তাঁহার মন্ত্রী মল্লু ইকবাল তাহাকে বাধা দিবার যে সামান্য চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহা ব্যর্থ হইল।

দিল্লী জয় নারকীয় হত্যাকাণ্ড

দিল্লীতে প্রবেশের মুখে একলক্ষ হিন্দু বন্দীকে হত্যা করিয়া এবং শহরের অভ্যন্তরে যথেচ্ছাচার হত্যাকাণ্ড চালাইয়া তৈমুর এক পৈশাচিক ও নারকীয় কাণ্ডের অনুষ্ঠান করিলেন। আরও কয়েকটি শহরে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালাইয়া সমগ্র ভূমিখণ্ডকে প্রায় শ্মশানে পরিণত করিয়া ১৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দে তৈমুর ভারত ত্যাগ করিলেন।

“He left India after inflicting on India more misery than had ever been inflicted by any conqueror in a single invasion.” -Cambridge History of India.

ফলাফল দিল্লীর সুলতানির পতন ত্বরান্বিত

তৈমুরের এই ভারত আক্রমণের ফল হইয়াছিল সুদূর প্রসারী। সুলতানি সাম্রাজ্যের রাজধানী একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হইল, সমগ্র উত্তর ভারতে এক অরাজকতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিল। ফলে প্রদেশগুলি একে একে স্বাধীন হইয়া গেল।

ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাটামো ধ্বসিয়া পড়িল। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হইল, চারিদিকে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। “Those of the inhabitants who were left, died (of famine and pestilence), while for two whole months not a bird moved wings in Delhi.”-Badauni.

ইহার অব্যম্ভাবী ফল স্বরূপ দিল্লীর সুলতানির পতন ত্বরান্বিত হইয়া উঠিল ৷

পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যে চরম আঘাত

এই অবস্থা হইতে পরবর্তী সৈয়দ ও লোদী বংশীয় সুলতানগণ সাম্রাজ্যকে আর পুনর্জীবিত করিতে পারিল না। একথা সত্য যে সুলতানি সাম্রাজ্য পূর্ব হইতেই ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হইতেছিল; তৈমুরের আক্রমণ সেই পতনকে ত্বরান্বিত করিয়া দিল মাত্ৰ ৷

উপসংহার

উপরে উল্লেখিত দিল্লি সালতানাতের পতনের কারণ অন্নেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো, এই পতনের পিছনে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক, বহিরাগত আক্রমণ, আঞ্চলিক শক্তির উত্থান এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দায়ী ছিল। এই কারণগুলি সম্মিলিতভাবে সুলতানি শাসকদের কর্তৃত্ব এবং স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ণ করতে সফল হয়। তাই, এর শেষ পরিণতি হয় সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন এবং ভারত জুড়ে স্বাধীন আঞ্চলিক রাজ্য গুলির উত্থান।

FAQs

প্রশ্ন: কোন সুলতান দীর্ঘতম শাসন করেন?

উত্তর: মুহাম্মদ বিন তুঘলক 1325 সাল থেকে 1351 সাল পর্যন্ত প্রায় 26 বছর শাসন করেন।

প্রশ্ন: দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে কেন?

উত্তর: 1526 সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের দ্বারা ইব্রাহিম লোদির পরাজয় ও হত্যা, সুলতানি সাম্রাজ্যের অবসান ঘটায়।

প্রশ্ন: সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের দুটি কারণ?

উত্তর: দিল্লি সালতানাতের পতনের প্রধান কারণ গুলি হল – বহিরাগত আক্রমণ এবং দুর্বল উত্তরাধিকার ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।

প্রশ্ন: দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কে দায়ী ছিলেন?

উত্তর: দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের জন্য শুধুমাত্র একটি ব্যক্তি বা ঘটনাকে দায়ী করা যায়না। সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের জন্য বরং একাধিক কারণ বর্তমান যেমন তৈমুরের ভারত আক্রমণ, আঞ্চলিক শক্তির উত্থান, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দুর্বল উত্তরাধিকার ইত্যাদির মতো ঘটনা দায়ি।

প্রশ্ন: দিল্লির শেষ সুলতান কে ছিলেন?

উত্তর: দিল্লির শেষ সুলতান ছিলেন ইব্রাহিম লোদি। তিনি 1517 থেকে 1526 সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের দ্বারা পানিপথের প্রথম যুদ্ধে নিহত হলে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন হয়।

প্রশ্ন: দিল্লির সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠাতা কে?

উত্তর: মুহম্মদ ঘোরির একজন সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবক 1206 সালে দিল্লিতে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠাতান করেন।

প্রশ্ন: ইলবারি তুর্কি বংশের প্রথম ও শেষ সুলতান কে ছিলেন?

উত্তর: ইলবারি তুর্কি বংশের প্রথম সুলতান ছিলেন কুতুবুদ্দিন আইবক (১২০৬ -১২১০) এবং শেষ সুলতান ছিলেন মুইজউদ্দিন কায়কোবাদ (১২৮৭-১২৯০)।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment