এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা ফিরোজ শাহ তুঘলক -এর জীবন, সিংহাসন লাভ, সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
মধ্যযুগীয় ভারতের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। তিনি ছিলেন মহম্মদ বিন তুঘলকের পরে তুঘলক বংশের তৃতীয় শাসক।
তিনি তার 1351 থেকে 1388 সাল পর্যন্ত শাসনকালে দিল্লি সালতানাতে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে যা আমরা নিচে আলোচনা করবো।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের সিংহাসন লাভ
সিন্ধুদেশের বিদ্রোহ দমন করিতে যাইয়া ১৩৫১ খ্রীষ্টাব্দে মহম্মদ বিন্ তুঘলকের অকস্মাৎ মৃত্যু হয়; তখন সমবেত আমীরগণের দ্বারা মনোনীত কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফিরোজ তুঘলক সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং রাজপুত রমণীর গর্ভজাত সন্তান।
মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে তাঁহারই তত্ত্বাবধানে তিনি শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাইয়াছিলেন। কিন্তু মহম্মদের রাজনৈতিক আদর্শ, শাসননীতি বা ধর্মভাব তাঁহাকে বিশেষ প্রভাবান্বিত করিতে পারে নাই।
চরিত্র ও কার্যাবলী সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে অনৈক্য
সমসাময়িক মুসলমান ঐতিহাসিকগণ অবশ্য তাঁহাকে একজন আদর্শ নরপতি বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন; কিন্তু অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বিশেষ করিয়া বর্তমান ঐতিহাসিকগণ, তাঁহার রাজত্বকাল ও কার্যাবলী হইতে উপরোক্ত মন্তব্য সমর্থন করিবার মত কিছু পান নাই ।
🔥আরও পড়ুনঃ-
আভ্যন্তরীণ শাসননীতি ও সংস্কার (Administration and Reforms):
কোরাণের নীতির ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা
ফিরোজ তুঘলক নিজে ছিলেন একজন ধর্মভীরু গোঁড়া মুসলমান, এবং তিনি তাঁহার সমগ্র শাসনব্যবস্থাকে ও ইসলাম ধর্মের তথা কোরাণের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন, দিল্লীর সুলতানিকে এক ধর্মাশ্রয়ী শাসনে পরিণত করিতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন। তাঁহার শাসন পরিচালনা ও সংস্করণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টার ছাপ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়।
রাজস্ব ক্ষেত্রে সংস্কার
রাজস্বের ক্ষেত্রে ফিরোজ কয়েকটি সংস্কার সাধন করেন। তাঁহার সিংহাসনে আরোহণের সময় সাম্রাজ্যে অর্থনৈতিক সঙ্কট অত্যন্ত তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল, রাজস্বের ক্ষেত্রেও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছিল। প্রথমে অবৈধ খাজনাগুলি বাতিল করিয়া তিনি কয়েকটি ক্ষেত্রে ভূমি করের পরিমাণ হ্রাস করিয়া দিলেন।
কোরাণের নির্দেশ অনুযায়ী চারি প্রকার কর
অতঃপর কোরাণে উল্লিখিত চারি প্রকার কর স্থাপন করিলেন-
- (i) ‘খারাজ’ বা জমির ফসলের এক-দশমাংশ,
- (ii) ‘জাক বা সরকারকে দান,
- (iii) ‘জিজিয়া‘ বা অমুসলমানদের উপর ধার্য কর, এবং
- (iv) ‘থাম্স’ বা যুদ্ধে লুন্ঠিত দ্রব্যের ও খনিজ দ্রব্যের এক- পঞ্চমাংশ।
এই চারি প্রকার কর ভিন্ন সরকারী সেচ খালের সুবিধা গ্রহণ- কারীদের উপর সেচ কর বা ‘শাব’ ধার্য হইল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্যায়ভাবে কর আদায় বা উৎকোচ গ্রহণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের চেষ্টা করিলেন।
ব্যবসা-বাণিজ্যের’ উন্নতির কারণ
আভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য তিনি বহুবিধ শুল্ক ব্যবস্থা হইতে বণিকদিগকে মুক্ত করিয়া দিলেন। ফলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র অবাধ বাণিজ্য চলিবার সুবিধা হইল, শিল্পোৎপাদন হতন উৎসাহ লাভ করিল এবং জিনিষপত্রের দামও কিছুটা হ্রাসপ্রাপ্ত হইল । ইহাতে একদিকে যেমন জনসাধারণের সুখ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়, অপরদিকে তেমন সরকারী রাজস্বে আয়ও বাড়িয়া যায় ।
সেচ ব্যবস্থার ও কৃষির উন্নতিসাধন
কৃষির উন্নতিকল্পে সুলতানের আদেশে কয়েকটি সেচখাল এবং বহুসংখ্যক কূপ খনন করা হয়, কিছু পতিত জমিও উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে কৃষি ও কৃষকের উন্নতি সাধিত হয়।
সমসাময়িক ঐতিহাসিক শামস্-ই-সিরাজ আফিফ অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত ভাবে এই উন্নতির কথা উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। “The ryots grew rich; their homes were replete with grain, horses and furniture, no woman was without her ornaments”-Affif
বিচার ব্যবস্থার সংস্কার সাধন
ইলামী আইনকে অনুসরণ করিয়া সুলতান বিচার ব্যবস্থার ও সংস্কার সাধন করিলেন। দণ্ডবিধির কঠোরতা হ্রাস করিয়া নিষ্ঠুর শাস্তি সমূহ রহিত করিয়া তিনি বিচার ব্যবস্থাকে বহুল পরিমাণে উদার ও মানবোচিত করিয়া তুলিলেন।
কর্ম সংস্থানসংঘ, চিকিৎসালয় ও সরকারী সাহায্য ভাঙার স্থাপন
বেকার সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি একটি কর্মসংস্থান সংস্থা (Employment bureau) স্থাপন করিয়াছিলেন। দরিদ্রের চিকিৎসার জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় (Dar-ul- shafa) এবং তাহাদিগকে অর্থ সাহায্যের জন্য সরকারী সাহায্য ভাণ্ডার (Diwan-i Khairat) খুলিয়া দিলেন।
মুদ্রানীতি সাময়িক ক্ষেত্রে জায়গীর প্রথার পুনঃপ্রবর্তন
প্রচলিত মুদ্রানীতিকে পরিবর্তিত করিয়া তিনি ‘আধা’ ও ‘বিশ্ব’ নামে দুই প্রকার মিশ্রিত ধাতুর মুদ্রার প্রচলন করেন। ইহা পূর্বের চেয়ে অধিকতর বিজ্ঞান সম্মত হইয়াছিল।
সামরিক ক্ষেত্রে তিনি পূর্ববর্তী সুলতানদের নীতি ত্যাগ করেন। তিনি পুনরায় সামন্ত প্রথার ভিত্তিতে তাঁহার সামরিক বাহিনীকে সংগঠিত করিলেন; সৈনিক ও কর্মচারীদিগকে তিনি বেতনের পরিবর্তে জায়গীর দেবার ব্যবস্থা করিলেন।
আলাউদ্দিনের নীতি পরিবর্তিত
আলাউদ্দিন খলজী স্থাপিত স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর উপর জোর না দিয়া তিনি সামন্তদের ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সৈন্যবাহিনীর উপর বেশী নির্ভরশীল হইয়া উঠিলেন, এমন কি আলাউদ্দিন কর্তৃক প্রবর্তিত ‘হুলিয়া’ ও ‘দাগ’ ব্যবস্থাও উঠাইয়া দিলেন । এই সমস্ত ব্যবস্থার ফলে সৈন্যবাহিনী যে কিছু দুর্বল হইয়া পড়িল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই ৷
ক্রীতদাসের সংখ্যাধিক্য ও সমস্যা
সুলতান ফিরোজ শাহের আমলে দেশে ক্রীতদাসের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক মিনহাজ-উস-সিরাজের বর্ণনা হইতে জানা যায় যে সেই সময় সুলতানের প্রাসাদেই প্রায় চল্লিশ হাজার ক্রীতদাস অবস্থান করিত।
সুলতান তাহাদের তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার জন্য একটি পৃথক বিভাগ পর্যন্ত খুলিয়াছিলেন। ইহাদের ভরণপোষণের জন্য যে কেবলমাত্র অধিকতর ব্যয় হইত তাহাই নয়, তাহারা শাসন-সংক্রান্ত ব্যাপারেও নানা জটিলতা সৃষ্টি করিত।
যুদ্ধবিগ্রহ ও বৈদেশিক নীতি (War-fares and Foreign Policy):
বৈদেশিক নীতিতে দুর্বলতা
সুলতান পদ গ্রহণের পরই ফিরোজকে নানাবিধ জটিল সমস্যার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল। মহম্মদ তুঘলকের রাজত্বের শেষদিকে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে নানারূপ বিদ্রোহ সংঘটিত হইতেছিল, অনেক স্থান স্বাধীন হইয়া নূতন নূতন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাও করিয়াছিল। এই অবস্থার সম্মুখীন হইতে যাইয়া ফিরোজ শাহ তাঁহার দুর্বলতা ও অব্যবস্থিতচিত্ততার যথেষ্ট পরিচয় দেন।
দুর্বলতা বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা
মহম্মদ তুঘলকের রাজত্বকালের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করিয়া বাংলার শাসনকর্তা শাসমউদ্দিন ইলিয়াস শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
ইলিয়াশ শাহ যখন ত্রিহুত জয় করিয়া বাংলার বাহিরেও তাহার আধিপত্য বিস্তার করিতে যত্নবান হইলেন, তখন ফিরোজ শাহ ১৩৫৩ খ্রীষ্টাব্দে সসৈন্যে তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন।
ইলিয়াশ শাহ একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলে তিনি তাহা অবরোধ করেন। কিন্তু কয়েক মাস অবরোধ করিয়া থাকিবার পর বর্ষার আগমনে ভীত হইয়া তিনি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। দীর্ঘদিন তিনি আর বাংলা আক্রমণ করেন নাই।
বাংলা জয়ে সুলতানের ব্যর্থতা প্রথম অভিযান
এর পর কিছুটা আভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ গ্রহণ করিয়া সুলতান ১৩৫৯ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় বাংলা আক্রমণ করিলে ইলিয়াস শাহের পুত্র শিকন্দর শাহ এবারও একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
দীর্ঘকাল স্থলতান দুর্গটি অবরোধ করিয়াও যখন শিকন্দরকে পরাজিত করিতে পারিলেন না তখন তাঁহার সহিত সন্ধি স্থাপন করিয়া বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লইলেন ।
উড়িষ্যা জয় এবং নগরকোট দুর্গ অধিকার
বাংলা জয়ে ব্যর্থ হইলেও সুলতান তাঁহার প্রত্যাবর্তনের পথে জাজনগর (উড়িষ্যা) আক্রমণ করেন। উড়িষ্যার রাজা পলায়ন করিলে সুলতান বিনা বাধায় পুরীতে প্রবেশ করিয়া জগন্নাথের মন্দিরটি লুণ্ঠন করেন।
অবশেষে রাজা বহু উপঢৌকন দিতে স্বীকৃত হইয়া তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিলে স্থলতান দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৩৬১ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান পাঞ্জাবের অন্তর্গত নগরকোট দুর্গটি অধিকার করেন।
সিন্ধুদেশ আক্রমণ
১৩৬১-৬২ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান সিন্ধুদেশ আক্রমণ করেন। প্রথমবার তিনি ব্যর্থ হন। পরে দিল্লী হইতে অতিরিক্ত সামরিক সাহায্য আসিয়া পড়িলে সিন্ধুরাজ বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন; সিন্ধু আবার দিল্লী সুলতানের অধিকারভুক্ত হইল ।
দাক্ষিণাত্য সম্বন্ধে সুলতানের নীতি
তিনি বাহমণি, বিজয়নগর প্রভৃতি দক্ষিণ ভারতের নব-প্রতিষ্ঠিত রাজ্য- গুলিতে পুনরায় দিল্লীর আধিপত্য ফিরাইয়া আনিবার কোন চেষ্টাই করেন নাই।
তাঁহার শেষ জীবনে গুজরাটের শাসনকর্তা, এটাবার’ অধিবাসীগণ, কাটেহার প্রভৃতি বিদ্রোহী হইয়াছিল । সুলতান অবশ্য এই বিদ্রোহগুলি দমন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। নানারকম অশান্তির মধ্যে ১৩৮৮ খ্রীষ্টাঙ্গে ফিরোজ শাহের মৃত্যু হয়।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের চরিত্র ও কৃতিত্ব (Character and Estimate):
ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনৈক্য চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্বন্ধে
ফিরোজ শাহ তুঘলকের চরিত্র বিশ্লেষণ করিতে যাইয়া ঐতিহাসিকগণ একমত হইতে পারেন নাই। তাহার চরিত্র ও কার্যাবলীর সর্বাঙ্গীণ বিচার করিয়া সমসাময়িক ঐতিহাসিকয় বারণি ও আহ্নিক তাহাকে দয়াবান, নিষ্ঠাবান, প্রজাহিতৈষী এমন কি আদর্শ নরপতি বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।
তাহাদিগকে অনুসরণ করিয়া বর্তমান যুগের ঐতিহাসিক হেনরী ইলিয়ট ও এলফিনস্টোন ফিরোজকে সুলতানী আমলের ‘আকবর’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। কিন্তু স্মিথ, ঈশ্বরী প্রসাদ প্রভৃতি ঐতিহাসিকগণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁহারা ফিরোজকে ইতিহাসে এত উচ্চে স্থান দিতে প্রস্তুত নহেন।
রাজ্যের সঙ্কটজনক অবস্থার সিংহাসন আরোহণ
মহম্মদ তুঘলকের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের একটি সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে ফিরোজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। চারিদিকের বিদ্রোহ দমন করা, বিচ্ছিন্ন অংশগুলির উপর দিল্লীর আধিপত্য পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করা প্রভৃতি ছিল তাঁহার আশু কর্তব্য।
তিনি অবশ্য উড়িয়া রাজকে বশতা স্বীকার করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন, নগরকোট দুর্গ জয় করিয়াছিলেন এবং বহু কষ্টে হইলেও সিন্ধুর বিদ্রোহী শাসনকর্তাকে পরাজিত করিয়াছিলেন।
সামরিক অভিযানে ব্যর্থতা
কিন্তু দুইবার অভিযান পরিচালিত করিয়াও তিনি বাংলা অধিকার করিতে পারেন নাই, বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া দিল্লীতে ফিরিয়া আসেন। তাহাছাড়া, দক্ষিণ ভারতের বাহমণি, বিজয়নগর প্রভৃতি বিচ্ছিন্ন অংশগুলির উপর দিল্লীর আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার কোন চেষ্টাই তিনি করিতে পারেন নাই।
রাজনৈতিক অসুরদর্শিতা ও সামরিক সংগঠন
সুতরাং সমরকুশলতা বা সামরিক প্রতিভার কোন পরিচয় তিনি দিতে পারেন নাই; বরং অভিযান পরিচালিত করিতে যাইয়া তিনি অনেক ক্ষেত্রে অব্যবস্থিতচিত্তের ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়াছেন। সামরিক ক্ষেত্রে তাহার এই ব্যর্থতা তাঁহার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার স্বাভাবিক ফল হিসাবে দেখা দিয়াছিল।
সামস্ত প্রথার ভিত্তিতে সামরিক বাহিনী পুনগঠিত করিতে যাইয়া তিনি সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তিই দুর্বল করিয়া ফেলিয়া- ছিলেন। স্থায়ী সৈন্যবাহিনী উঠাইয়া দিয়া জায়গীর প্রাপ্ত সামরিক কর্মচারী- দের উপর নির্ভর করার ফলে কেন্দ্রীয় শক্তিই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল।
গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতা হিন্দুদের অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষ অর্জন
ফিরোজ শাহ্, ধর্মভীরু গোঁড়া মুসলমান ছিলেন এবং কোরাণের নির্দেশ অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করিতেন। অনেক সময়ে তাঁহার গোঁড়ামি ধর্মান্ধতায় পর্যবসিত হইয়াছিল।
নিজ ধর্ম পালনে অত্যধিক গোঁড়ামি প্রদর্শন করিতে যাইয়া তিনি হিন্দু দেব-দেবীর মন্দির ধ্বংস, হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর ধার্য প্রভৃতি করিতে দ্বিধা করেন নাই। ফলে তিনি হিন্দুদের অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষ অর্জন করিয়াছিলেন।
“Kindly to the Hindus, he yet sternly forbade public worship of idols and painting of portraits and taxed the Brahamans who had hitherto been exempt.”-Lane Poole.
উলেমাদের রাষ্ট্র শাসনে প্রাধান্য রাষ্ট্ররে ভিত্তি দুর্বল
সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কোন পরিচয় বহন করে না। এই একই কারণে তিনি মহম্মদ তুঘলকের নীতিকে পরিত্যাগ করিয়া উলেমা- দিগকে আবার রাষ্ট্রশাসন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিবার সুযোগ দেন।
এই সমস্ত কার্য সমসাময়িক মুসলমান ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক প্রশংসিত হইলেও উহা রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল করিয়াছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই ।
অন্তরের প্রসারতা প্রজার মঙ্গলসাধন
কিন্তু রাজনীতিক হিসাবে জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধির কোন পরিচয় না দিলেও এ কথা সকলে একবাক্যে স্বীকার করেন যে ফিরোজ তুঘলকের অন্তরের প্রসারতা ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সৎ, আদর্শবাদী ও প্রজাকল্যাণকামী ছিলেন।
প্রজাবর্গের বৈষয়িক মঙ্গলের জন্য তিনি বহু কিছু করিয়াছিলেন; তাঁহার রাজস্বনীতি কৃষক ও কৃষিকর্মের যথেষ্ট উন্নতিসাধন করিয়াছিল। শুল্ক ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করিয়া তিনি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার সাধন করিয়াছিলেন, দেশের সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন।
সুলতানের প্রজা হিতৈষণার পরিচয়
বিচার-ব্যবস্থার কঠোরতা দূর করা, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করা, কর্মসংস্থান সংস্থা ও সরকারী সাহায্য ভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা করা’–এ সমস্তই তাঁহার মহৎ প্রাণের ও তাঁহার প্রজাহিতৈষণার পরিচয় বহন করে।
এই সমস্ত কারণেও ফিরোজ সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণের (বারণি, আফিফ, প্রভৃতি) প্রশংসা লাভ করিয়াছেন। তাহাদের অভিনয়োজি হার দিলেও ফিরোজ শাহ্, যে ধর্মভীক, দয়াপ্রবণ ও প্রজাহিতৈষী হুলতান ছিলেন সে বিষয়ে বর্তমান ঐতিহাসিকগণও একমত।
সুলতান তাঁহার স্থাপত্য শিল্পানুরাগের বহু পরিচয় রাখিয়া গিয়াছেন। ফিরোজ তুঘলক নিজেই বলিয়া গিয়াছেন, “Among the many gifts which God bestowed upon me, his humble servant, was a desire to erect public buildings so that the people might worship God in those edifices.”
শিল্পানুরাগ জনহিতকর কার্যাবলী
বহু সংখ্যক শহর ও উত্থান নির্মাণে তাঁহার যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। কিছু স্মৃতিসৌধও তিনি প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। জনহিতকর কার্যাবলীতে তিনি অনেকের চেয়ে বেশি অগ্রণী ছিলেন। মসজিদ, সরাইখানা, হাসপাতাল প্রভৃতি নির্মাণ তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা
ফিরোজ শাহ শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করিয়া গিয়াছেন। ইসলামীয় শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি সরকারী বায়ে বহু মাদ্রাসা নির্মাণ করিয়া দিয়াছিলেন। মৌর্য সম্রাট অশোকের দুইটি শিলালিপি তিনি দিল্লীতে আনাইয়া রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।
বহু মুসলমান ধর্মজ্ঞানী ও সাহিত্যসেবী তাঁহার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করিয়াছিলেন । রুমী, ঐতি- হাসিক বারণি, আফিফ, কবি তাজউদ্দিন খালিদ খাণী প্রভৃতি তাঁহাদের মধ্যে অন্যতম। সুলতানের আদেশে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ ফার্সী ভাষায় অনুদিত হইয়াছিল ।
ধর্মান্ধতা ও উদারতার ফল (সামরিক ব্যর্থতার পরিনাম)
সুতরাং ফিরোজ শাহ যে একজন প্রজাহিতৈষী, দয়াপ্রবণ এবং ধর্মভীক সুলতান ছিলেন এ বিষয়ে কোন ঐতিহাসিকই দ্বিমত নহেন। তবে একথাও সত্য যে তাঁহার ধর্মান্ধতা তাহার রাজনৈতিক দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল।
এবং তাহার ফল সাম্রাজ্যের পক্ষে শুভ হয় নাই। তিনি অনেকক্ষেত্রেই অপাত্রে দয়া ও উদারতা প্রদর্শন করিতে যাইয়া তাঁহার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয়
দিয়াছেন। “The irony of history reflects itself in the unfortunate fact that the very qualities that had contributed to the popularity of Firuz were also largely responsible for the weakness of the sultanate of Delhi.”-Dr. R. P. Tripathi.
সাম্রাজ্য পতনের সূচনা
সামরিক সংগঠনে ও অভিযানে তিনি যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছেন তাহাতে সমগ্র শাসনব্যবস্থার ভিত্তিই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল। মহম্মদ তুঘলকের আমলের শেষ দিকে দিল্লীর সুলতানিতে পতনের যে লক্ষণ দেখা দিয়াছিল তিনি তাহা রোধ করিতে পারেন নাই; বরং তাঁহার রাজত্বের শেষের দিকে সাম্রাজ্যে অব্যবস্থা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছিল এবং তাঁহার মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই সাম্রাজ্য ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া গিয়াছিল।
উপসংহার
উপরে ফিরোজ শাহ তুঘলকের সম্পর্কে আলোচনা করে আমরা বলতে পারি যে ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময়ে প্রশাসনিক সংস্কার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেখতে পাওয়া যায়। তার আমলে স্থাপত্যের নিদর্শন গুলি দুর্দান্ত দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ হিসাবে রেখেগেছে।
FAQs ফিরোজ শাহ তুঘলক
প্রশ্ন: ফিরোজ শাহ কোন সালে জৌনপুরের ভিত্তি স্থাপন করেন
উত্তর: ১৩৮৮ সালে ফিরোজ শাহ জৌনপুরের ভিত্তি স্থাপন করেন।
প্রশ্ন: ফিরোজ শাহ তুঘলক এর আত্মজীবনীর নাম কি?
উত্তর: ফুতুহাৎ-ই-ফিরোজশাহী হল ফিরোজ শাহ তুঘলক এর আত্মজীবনীর ।
প্রশ্ন: ফিরোজ শাহ তুঘলক কে সুলতানি যুগের আকবর বলা হয় কেন?
উত্তর: সম্রাট আকবরের মতো ফিরোজ শাহ তুঘলকের জনহিতকর কার্যাবলীর কারণে তাকে সুলতানি যুগের আকবর বলা হয়।
প্রশ্ন: ফিরোজ শাহ তুঘলক কতটি কর বাতিল করেছিলেন?
উত্তর: ফিরোজ শাহ তুঘলক তার শাসনকালে প্রজাদের উপর চাপ কমাতে এবং শাসন ব্যবস্থার উন্নতির প্রয়াসে 20টি কর বাতিল করেছিলেন।