কীভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটে ?

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
Rate this post

বলশেভিক বিপ্লবের পরই প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিবিপ্লব ঘটানোর জন্য পশ্চিমী শক্তি জোটের যে তৎপরতা দেখা যায়, বস্তুত তখন থেকেই উত্তেজনার শুরু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিস্থিতির চাপে ব্রাত্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে সঙ্গে নিয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

যুদ্ধোত্তর কালে আবার বিভেদ, দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। দুই পক্ষই শক্তিধর হয়ে উঠলে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরমে উঠলে পৃথিবী ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। বিভিন্ন কারণে, ঘটনায় এই ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটে। আমরা তা আলোচনা করব।

বহুকেন্দ্রিকতা:

দ্বিতীয় বিশ্বযুধের পর প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ফুলটন বক্তৃতা এবং স্ট্যালিনের আত্মরক্ষণ নীতি (Self-containment) বা বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পট্সডাম সম্মেলনে মার্কিন-সোভিয়েত মতভেদ দুই শিবিরে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই শিবিরই অনুগত রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বিধ্বস্তু ইউরোপের পুনর্গঠনের জন্য মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে বিপুল আর্থিক সাহায্য দান করে নিজ প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে। তুরস্ক, গ্রিসকে সাম্যবাদী আতঙ্ক থেকে রক্ষা করার অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য দেয়।

তার পর উত্তর আতলান্তিক চুক্তি সংস্থা (NATO) জোট গঠন করে। কিন্তু ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গল — NATO ত্যাগ করে স্বাধীন বিদেশনীতি অনুসরণের কথা ঘোষণা করে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।

অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের একাধিপত্য মানতে অস্বীকার করে যুগোশ্লোভিয়া। চিনে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলে, চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে শোধনবাদী আখ্যা দেয় (ক্রুশ্চেভের সময়)। পরে ‘সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী বলে নিন্দাবাদ করে।

বিশ্বে সাম্যবাদের প্রসারে নিজ নিজ অবস্থানে দুইপক্ষই অনড় থাকে। ক্রুশ্চেভের সময় কমিনফর্ম (Communist Information Bureau) ভেঙে দিয়ে নিজ নিজ পদ্ধতি অনুযায়ী দেশগুলিকে সমাজতন্ত্রের পথে চলার স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়। এককেন্দ্রিকতার বদলে বহুকেন্দ্রিকতা স্বীকার করা হয়। এই বহুকেন্দ্রিকতার ফলে দুই পরাশক্তির কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে যায়।

বহুকেন্দ্রিকতা কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা দেয়নি, অস্ত্র উৎপাদনেও তা দেখা দেয়। এযাবৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু শক্তির অধিকারী ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, চিন, ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা, পরে ভারত, পাকিস্তানও পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠলে পঞ্চশক্তিদের আধিপত্যে প্রশ্ন চিহ্ন ওঠে।

ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তারা অস্ত্র সীমিতকরণের জন্য পারস্পরিক আলোচনা শুরু করে। পরমাণু প্রসার রোধ চুক্তি (Nuclear Test Ban treaty) দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, (Nuclear Non- Proliferation Treaty, Partial Test Ban Treaty, SALT, Comprehensive Test Ban Treaty)- এ ধরনের বহু চুক্তি সম্পাদিত হয়। দুই পরাশক্তি-এর ফলে কাছাকাছি আসে। উত্তেজনা কমে। ঠান্ডা যুদ্ধ অবসানের পথে চলে।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 কী কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংহতি বিনষ্ট হয়?

সোভিয়েত-চিন বিরোধ:

ক্রুশ্চেভের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সোভিয়েত-চিন বিরোধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ক্রুশ্চেভ পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতি (Peaceful co-existence) অনুযায়ী চলার কথা ঘোষণা করলে চিন তার প্রতিবাদ জানায় ।

মাও জে-দং এর নেতৃত্বে চিন এই সময় যথেষ্ট উন্নতি করে। বিশ্বশক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চিন উদ্যোগী হয়। দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ায় চিনের আধিপত্য বিস্তারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। সম্ভবত এই কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়ে।

অন্য দিকে চিন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নেতা হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্বকে কেবল অস্বীকার করল না এবং আলবেনিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সমর্থনে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ভাঙন সৃষ্টি করে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কার চিনের মনোভাব দুই বৃহৎ শক্তির কাছেই আশংঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

উভয়ের আশংঙ্কা ছিল, একপক্ষ চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুললে বিশ্বশান্তির ভারসাম্য নিজ অনুকূলে নিয়ে আসবে। তাই সমস্বার্থের কারণে উত্তেজনা প্রশমনে দুই পরাশক্তিই আলোচনা শুরু করে। ঠান্ডা যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা কমতে থাকে।

আর্থিক সংকট:

কেবল রাজনৈতিক বা পরমাণু অস্ত্রের প্রসার রোধেই নয়-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও দুই বৃহৎ শক্তি সমস্বার্থ অনুভব করে। দুই দেশের কাছেই ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ একটি ব্যয়বহুল বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সমরাস্ত্র নির্মাণ, গবেষণা, সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ, বজায় রাখা, অনুগত রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক অনুদান, অস্ত্র সাহায্য, বিপুল সামরিক ব্যয়ভার, দুই দেশের বাজেট ঘাটতি জাতীয় অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে তা প্রকট ভাবে দেখা দেয়। (Abel AganBezian – The challenge : Economics of Perestroika-1989).

অন্যদিকে ইউরোপীয় সাধারণ বাজার (ECM) ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠী (EEC) ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পশ্চিম জার্মানির আর্থিক প্রবৃদ্ধি হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যায়। পশ্চিম জার্মানি, কানাডা ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করে।

যুগোস্লোভিয়াও পুঁজিবাদী দেশগুলির সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। জাপানের চরম উন্নতি ঘটে। এভাবে দুই পরাশক্তির আর্থিক সংকট ও অপরাপর অনুগত রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি দুই শক্তিকে সংঘর্ষের মনোভাব কমাতে সাহায্য করে। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান আসন্ন হয়ে ওঠে।

নির্জোট আন্দোলনের ভূমিকা:

ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের, যুগোস্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, পূব নয়, পশ্চিম নয় –


নতুন একটি পথ আবিষ্কার করেন, যা নির্জোট বা জোট নিরপেক্ষ নামে পরিচিত। আফ্রো-এশিয়ার সদ্য স্বাধীন দেশগুলি ঠান্ডা যুদ্ধের আবর্তের বাইরে থেকে নিজেদের উন্নয়ন, স্থিতিশীলতার জন্য কাজ করেন। ক্রমে তাদের সমর্থক সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং আন্দোলনে পরিণত হয়। তারা বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের এটাও একটা কারণ।

হেলসিংকি সম্মেলন:

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে জুলাই হেলসিংকি (ফিনল্যান্ডের রাজধানী) সম্মেলনে ৩৫ টি জাতির প্রতিনিধিরা সমবেত হন। সেখানে ইউরোপের সংহতি ও নিরাপত্তা বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা হয়। সম্মেলনে সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফোর্ডও উপস্থিত ছিলেন, গৃহীত সনদে অভিন্ন ইউরোপ গঠন এবং অস্ত্র সীমিতকরণের কথা ছিল, যা ঠান্ডা যুদ্ধের তীব্রতা কমায় ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সংকট :

সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধান মিখাইল গর্বাচভ যে, গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকা নীতি চালু করেন, তার ফলে বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র স্বাধীন হয়ে যায়। কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে গর্বাচভ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে এক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি করে (৩১শে জুলাই, ১৯৯১খ্রিঃ) রাসায়নিক, পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংসের ব্যবস্থা করেন। সেই সঙ্গে পৃথিবী থেকে ঠান্ডা যুদ্ধেরও অবসান ঘোষণা করেন।

উপসংহার:

ইতিমধ্যে আফগানিস্থান থেকে রুশ বাহিনী ফিরে এসে ছিল, দুই জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, উপসাগরীয় যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন নীরব থেকে ছিল। একদা বিশ্ব ঘটনাবলীর অন্যতম নিয়ন্তা ইতিহাসে পরিণত হয়। পৃথিবী ঠান্ডা যুদ্ধ মুক্ত হয়।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

3 thoughts on “কীভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটে ?”

  1. link:Wow Thanks for this content i find it hard to come across good ideas out there when it comes to this material appreciate for the publish website

    Reply

Leave a Comment