আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। গজনী ও হিরাটের মধ্যবর্তী পর্বতদহুল স্থানে ছিল খুর রাজ্য অবস্থিত। ঘুর সামন্তগণ ছিলেন গজনী সাম্রাজ্যের অধীন। কিন্তু সুলতান মামুদের মৃত্যুর পর হইতে গজনী সাম্রাজ্য দুর্বল হইয়া পড়িলে ঘুর দলপতিগণ শক্তিশালী হইয়া উঠেন।
অবশেষে ঘুর বংশের গিয়াস উদ্দিন মোহম্মদ গজনী রাজ্য সম্পূর্ণরূপে দখল করেন এবং তাঁহার পাতা মুইজ-উদ্দিন মহম্মদ-বিন-নামকে গজনীর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ইনিই ইতিহাসে মহম্মদ ঘুরী নামে পরিচিত।
ভ্রাতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকিয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহম্মদ গজনীর শাসনকর্তা থাকা অবস্থাতেই ভারত অভিযানে অগ্রসর হন। উত্তর ভারত জয়ের অনেক পরে ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার ভ্রাতার মৃত্যু হইলে তিনি একসঙ্গে গজনী, সুর ও দিঙ্গীর হলতান হইয়াছিলেন।
মহম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযান (Conquest of India):
ঘটনা | সাল | সংক্ষিপ্ত বিবরণ |
প্রথম ভারত আক্রমণ | 1175 খ্রীষ্টাব্দ | সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবকে নিয়ে মুহাম্মদ ঘুরি প্রথমে ভারতের মুলতান শহর দখল করেন। এরপর তিনি লাহোর, উচ সহ পাঞ্জাবের একাধিক অঞ্চল জয় করেন। |
তরাইনের প্রথম যুদ্ধ | 1191 খ্রীষ্টাব্দ | তরাইনের যুদ্ধে আজমির ও দিল্লির চৌহান রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের মুখোমুখি হয়েছিল। প্রথম দিকে বিফল হলেও পরবর্তীকালে উত্তর ভারতের বেশ কিছু অংশ ঘুরির নিয়ন্ত্রণে আসে। |
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ | 1192 খ্রীষ্টাব্দ | ঘুরি পুনরায় আক্রমণ করেন এবং পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন। |
সাম্রাজ্য একত্রীকরণ | 1192-1206 খ্রীষ্টাব্দ | গভর্নর নিয়োগ করে ভারতে তার সাম্রাজ্যকে একত্রীকরণ করেন। যে অঞ্চলগুলি জয় করেছিলেন সেগুলি পরিচালনা করার জন্য প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। |
চান্দাওয়ারের যুদ্ধ | 1194 খ্রীষ্টাব্দ | চান্দাওয়ারের যুদ্ধে ঘুরি কনৌজের গহদাবালা রাজা জয়চন্দ্রের হারিয়ে তিনি উত্তর ভারতে তার সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত করেন। |
গুজরাট আক্রমণ | 1178-1179 খ্রীষ্টাব্দ | ঘুরি গুজরাট আক্রমণ করে আনহিলওয়ারা (আধুনিক পাটন) দুর্গ অবরোধ করে। দীর্ঘ অবরোধের পর, দুর্গটি দখল করে গুজরাটকে তার সাম্রাজ্যের অংশ করে নেন। |
মুহাম্মদ ঘুরির মৃত্যু | 1206 খ্রীষ্টাব্দ | মুহাম্মদ ঘুরি লাহোরে একজন ইসমাইলি আততায়ীর হাতে নিহত হন। তার মৃত্যু ভারতে ঘুরিদ রাজবংশের পতনকে নিশ্চিত করে। |
🔥আরও পড়ুনঃ-
ভারত অভিযান মুলতান গুজরাট ও লাহোর জয়
মহম্মদ ঘুরী ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী; ভারত বিজয় ছিল তাঁহার স্বপ্ন ৷ ১১৭৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সর্বপ্রথম ভারত অভিযানে অগ্রসর হইয়া মুলতান আক্রমণ করেন এবং উঁচু দুর্গটি দখল করেন।
তিনি গুজরাট আক্রমণ করিয়া ব্যর্থ হন। অতঃপর ১১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি পেশোয়ার অধিকার করেন এবং ভবিষ্যৎ অভিযানের ঘাঁটি হিসাবে শিরালকোটে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন । ১৯৮১ খ্রীষ্টাব্দে লাহোর ও তাঁহার করতলগত হইয়া পড়িল ।
তরাইনের দুইটি যুদ্ধ (Battles of Tarain):
পৃথ্বীরাজের সহিত সংঘর্ষ
আজমীঢ় ও দিল্লীর চৌহান বংশের রাজা ছিলেন তখন পৃথ্বীরাজ (বা রায় পিথোরা)। ১১৯১ খ্রীষ্টাব্দে মহম্মদ ঘুরী অগ্রসর হইয়া তাহার রাজ্যের অংশ ভাতিন্দা দখল করিলে, পৃথ্বীরাজ উত্তর ভারতের প্রায় সমস্ত রাজপুত্র রাজ্যের মিলিত বাহিনী লইয়া মহম্মদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। একমাত্র কনৌজের গাহ ডবাল রাজ জয়চাদ দূরে সরিয়া রহিলেন।
তরাইনের প্রথম যুদ্ধ মহম্মদ ঘুরীর পরাজয়
থানেশ্বরের নিকটে তরাইনের (বা তরাত্তরী — Taraori) যুদ্ধে মহম্মদ সম্পূর্ণ পরাজিত ও আহত হইয়া নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হইলেন। কিন্তু তিনি দমিবার পাত্র ছিলেন না।
তরাইনের দ্বিতীয় বুদ্ধ পৃথ্বীরাজ পরাজিত
পর বৎসর ১১৯২ খ্রীষ্টাব্দে মহম্মদ ঘুরী আবার এক বিশাল বাহিনী লইয়া তরাইনের প্রান্তরে উপস্থিত হইলেন। এক নূতন কৌশলে যুদ্ধ করিয়া মহম্মদ হিন্দুগণের মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করিলেন ।
পৃথ্বীরাজ বন্দী ও নিহত হইলেন। হস্তীবাহিনীর ব্যবহার, চিরাচরিত যুদ্ধনীতি পরিত্যাগ না করার ফলে এবং নিজেদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত একক অধিনায়কত্ব স্থাপন না করিতে পারার জন্মই তাহাদের এই পরাজয় বরণ করিতে হইল ।
পরাজয়ের কারণ যুদ্ধের গুরুত্ব
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ এক যুগান্তকারী ঘটনা। “The second battle of Tarain may be regarded as the decisive contest which ensured the ultimate success of the Mahammadan attack of Hindustan – Smith.
এই যুদ্ধজয়ের ফলে মুসলমান অধিকার দিল্লীর উপকণ্ঠ পর্যন্ত বিস্তৃত হইল । অতঃপর নিকটবর্তী দুর্গগুলি আত্মসমর্পণ করিল, আজমীর রাজ্য মহম্মদ কর্তৃক বিধ্বস্ত হইল। তিনি কুতুব-উদ্দিনকে বিজিত রাজ্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া দেশে প্রত্যাবর্তন করিলেন ।
মুসলমান অধিকার বিস্তার (Conquest of Northern India):
কুতুব-উদ্দিনের নূতন নূতন যুদ্ধ জয়
মহম্মদ ঘুরীর প্রত্যাবর্তনের পর নব নিযুক্ত শাসনকর্তা কুতুব-উদ্দিন মুসলমান অধিকার বিস্তার করিয়া চলিলেন। তিনি দিল্লী জয় করিলেন। ক্রমে ক্রমে মীরাট, রণথম্ভোর ও কোইল তাঁহার অধিকারে আসে। অতঃপর ১১৯৪ খ্রীষ্টাব্দে চন্দোয়ার যুদ্ধে কনৌজ রাজ জয়চন্দ্রও পরাজিত হন; ১১৯৭ খ্রীষ্টাব্দে গুজরাটের রাজধানী অনহিলবাড় এবং ১২০২ খ্রীষ্টাব্দে বুন্দেলখণ্ডের কালিঞ্জর দুর্গ লুন্ঠিত হয়।
মুসলমান অধিকার বিস্তার বিহার ও বাংলা দখল
মহম্মদ ঘুরীর অনুচর এবং কুতুব-উদ্দিনের সহকর্মী ও সেনানায়ক ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ-বিন-বখতিয়ার থালজি ১১৯৭ খ্রীষ্টাব্দে বিহার এবং আনুমানিক ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে সেনরাজ লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করিয়া বাংলা অধিকার করেন। এইরূপে মহম্মদ ঘুরীর সাম্রাজ্য পশ্চিমে সিন্ধুনদ হইতে পূর্বে গঙ্গা নদী পর্যন্ত উত্তর ভারতে বিস্তৃত হইয়া পড়িল।
মহম্মদের মৃত্যু ও সাম্রাজ্য বিভক্ত
১২০৬ খ্রীষ্টাব্দে আততায়ীর হস্তে মহম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর পর তাঁহার সাম্রাজ্য বিভক্ত হইয়া পড়ে। কুতুব-উদ্দিন দিল্লীর সুলতান হইলেন, তাঁহার ভগ্নীপতি নাসিরুদ্দিন কাবাচা পাইলেন সিন্ধু দেশ এবং তাঁহার শ্বশুর তাজউদ্দিন ইলদিজ গজনীর সিংহাসনে আরোহণ করিলেন।
মহম্মদ ঘুরীর সাফল্যের কারণ (Causes of his success):
দেশের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও ঐক্যের অভাব
(ক) মহম্মদ ঘুরী যখন ভারতবর্ষে মুসলমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইয়া অভিযানের পর অভিযান চালাইতেছিলেন, ভারতবর্ষের তখন সার্বভৌম শক্তির অস্তিত্ব ছিল না; সমগ্র উত্তর ভারত কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষু রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ইহা মহম্মদের ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার পথ পরিষ্কার করিয়া রাখিয়া- ছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে একক- অধিনায়কত্বের অভাব
(খ) বৈদেশিক আক্রমণের সম্মুখেও এইসকল রাজগণ নিজেদের বিবাদ বিসম্বাদ ভুলিতে পারিতেন না; জয়চাদের কার্যকলাপ মহম্মদের যথেষ্ট সহায়ক ছিল।
(গ) তাঁহাদের মিলিত বাহিনীর মধ্যেও তাঁহারা একক অধিনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন নাই। (ঘ) হস্তীবাহিনীর ব্যবহার এবং চিরাচরিত যুদ্ধনীতি ও তাঁহাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। এই সমস্ত কারণেই মহম্মদ ঘুরীর সাফল্য সুনিশ্চিত হইয়াছিল ।
কৃতিত্ব ও চরিত্র (Achievements and Character):
বিশাল সাম্রাজ্য গঠন
মহম্মদ ঘুরীর কৃতিত্ব ইতিহাসে তাঁহার স্থান সুনিশ্চিত করিয়াছে। গজনীর শাসক হিসাবে তাঁহার জীবন শুরু করিয়া তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
তিনি অসাধারণ রাজ- নৈতিক ও সামরিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করিয়া তাঁহার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও কুটনৈতিক প্রতিভা ঐতিহাসিকগণের প্রশংসা অর্জন করিয়াছে। ধনলোভ তাঁহার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতে পারে নাই।
সাম্রাজ্য স্থাপনের উদ্দেশ্য সাফল্য
ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল এবং প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদীর মত তিনি অধ্যবসায়ের সহিত দৃঢ়পদক্ষেপে অগ্রসর হইয়া কৃতকার্য হইয়াছিলেন। ভারতে মুসলমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন করিয়াছিলেন।
বিদ্যোৎসাহিতা ও সাহিত্যানুরাগ ধর্মান্ধতা
সমরবিজয়ী ও রাজনীতিজ্ঞ মহম্মদ ঘুরী বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগীও ছিলেন। তবে ভারত আক্রমণের সময় তাঁহার ধর্মান্ধতার পরিচয় কিছু পাওয়া গিয়াছে। আজমীঢ়ের হিন্দু মন্দিরগুলি ধ্বংস করিয়া সেই স্থানে মসজিদ নির্মাণ তাঁর ধর্মান্ধতার পরিচয়ই বহন করে।
উপসংহার
উপরে উল্লেখিত মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযান থেকে মুহাম্মদ ঘুরী সম্পর্কে এটা বলা যায় যে তিনি ছিলেন অসীম ধৈর্যবান ও অদম্য সাহসী। তার উন্নত যুদ্ধ কৌশল, ভারতের একাধিক রাজ্যকে জয় করতে সাহায্য করেছিল। তাই তিনি ভারতের ইতিহাসে একজন কৌশলী কূটনৈতিক মুসলিম সম্রাট হিসাবে স্থান দখল করে আছে।
FAQs মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযান
প্রশ্ন: মোহাম্মদ ঘড়ি কত খ্রিস্টাব্দে মারা যান?
উত্তর: মোহাম্মদ ঘড়ি 1206 খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
প্রশ্ন: মুহাম্মদ ঘুরীর আসল নাম কি?
উত্তর: মুহাম্মদ ঘুরীর আসল নাম শিহাব আদ-দীন।
প্রশ্ন: মহম্মদ ঘুরির অনুচর কারা ছিলেন?
উত্তর: কুতুবউদ্দিন আইবক মহম্মদ ঘুরির অনুচর ছিলেন।
প্রশ্ন: মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের সময় বাংলার রাজধানী কি ছিল?
উত্তর: মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের সময় বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়।
প্রশ্ন: মহম্মদ ঘুরির সেনাপতি কে ছিলেন?
উত্তর: কুতুবউদ্দিন আইবক ছিলেন মহম্মদ ঘুরির সেনাপতি।
প্রশ্ন: মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের সময় বাংলায় কার রাজত্ব ছিল?
উত্তর: মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের সময় বাংলার শাসক ছিলেন লক্ষ্মণ সেন।