সাম্রাজ্যের উত্থান এবং পতন ইতিহাসে একটি চির সত্য ঘটনা, আজ এই লেখার মাধ্যমে আমরা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে আঞ্চলিক শক্তির উত্থানের বিষয়ে আলোকপাত করবো।
সম্রাট আকবরের উদার রাজপুত নীতি ও ধর্মীয় নীতির কারণে হিন্দু রাজাদের সঙ্গে সম্প্রীতির বার্তাবরণ সৃষ্টি হয়ে ছিল তার বংশধর ঔরঙ্গজেবের হিন্দু বিদ্বেষী কঠোর নীতির ফলে হিন্দু রাজারা ধীরে ধীরে শাসক বিরোধী হয়ে ওঠে এবং স্বাধীন হবার জন্য চেষ্ঠা করতে থাকে।
ধীরে ধীরে আঞ্চলিক শাসকরা বিদ্রোহী ও শক্তিগুলি হয়ে ওঠে। আঞ্চলিক দলগুলি তেমন ভাবে সফল না হলেও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনে এদের ভূমিকাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যাবে না।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে আঞ্চলিক শক্তির উত্থান
বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শক্তি ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। সামরিক শক্তির ক্ষেত্রেও দুর্বলতা একইভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। এইরূপ পরিস্থিতিতে মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সুবাদার বা প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক নেতাগণ স্বাধীন বা প্রায় স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করতে অগ্রসর হন।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে আগত বৈদেশিক আক্রমণকারীদের ভারত আক্রমণ মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলে চরম কুঠারাঘাত করে। তাঁদের এই আক্রমণ স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করে এবং সাফল্যকে সুনিশ্চিত করে।
স্বাধীন রাষ্ট্র | শাসক |
মারাঠা সাম্রাজ্য | শিবাজী, সম্ভাজি, রাজারাম |
শিখ সাম্রাজ্য | মহারাজা রঞ্জিত সিং |
অবধ রাজ্য | নবাব সাদাত আলী খান, নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ |
সুবাহ বাংলা | মুর্শিদকুলি খান, আলীবর্দী খান, সিরাজ উদ-দৌলা |
হায়দ্রাবাদ রাজ্য | আসাফ জাহ প্রথম, নিজাম উল-মুলক |
মহীশূর রাজ্য | হায়দার আলী, টিপু সুলতান |
রাজস্থান রাজ্য | মহারানা প্রতাপ, রানা সাঙ্গা, রাজা মান সিং প্রমুখ সহ বিভিন্ন রাজপুত শাসক। |
ট্রাভাঙ্কোর রাজ্য | মার্থান্ডা ভার্মা, বলরামা ভার্মা, স্বাথি থিরুনাল প্রমুখ। |
গুজরাট সালতানাত | মুজাফফর শাহ প্রথম, আহমদ শাহ প্রথম, কুতুবউদ্দিন আহমদ শাহ দ্বিতীয় প্রমুখ। |
🔥আরও পড়ুনঃ-
মুর্শিদকুলি খাঁ ও বাংলা সুবা
১৭০৫ খ্রীষ্টাব্দে বাদশাহ ঔরঙ্গজেব মুর্শিদকুলি খাঁ নামে রাজস্ব বিভাগের এক বিচক্ষণ কর্মচারীকে বাংলা সুবার দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেন। ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার সুবাদার পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি নামে সুবাদার হলেও কার্যতঃ স্বাধীন শাসকের মত রাজত্ব করতে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বাংলার স্বাধীন নবাবীর প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি বাংলায় এক দৃঢ় শাসন নীতির প্রবর্তন করেন। তিনি স্থানীয় জমিদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাজত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি সাধন করে সরকারের আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধি করেন। তিনি মুর্শিদাবাদ শহরের পত্তন করেন ও সারা বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন।
তিনি ইংরেজ বণিক সংস্থা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কার্যকলাপের ওপর কঠোর দৃষ্টি রাখেন। মুঘল বাদশাহের প্রতি মৌখিকভাবে আনুগত্য প্রকাশ এবং তাঁকে নিয়মিতভাবে কর প্রদान করলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর শাসনকালেই বাংলা স্বাধীন হয়ে যায়। এইভাবে বাংলায় স্বাধীন নবাবীর পত্তন ঘটে।
সুজাউদ্দিন ও সরফরাজ খাঁ
মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন ১৭২৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার নবাব পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর বাংলার মসনদে আরোহশ করেন তাঁর পুত্র সরফরাজ খাঁ। ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে সরফরাজ খাঁকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে বিহারের শাসনকর্তা আলীবর্দী খাঁ বাংলার মসনদে আরোহণ করেন।
আলিবর্দী খাঁ
আলীবর্দী খাঁ ১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার নবাব ছিলেন। তিনি নানা গুণের অধিকারী ছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্র ও শাসনকার্যে যথেষ্ট নৈপুণ্য দেখান। তাঁর শাসন নীতি কঠোর হলেও ন্যায় ও নিরপেক্ষতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী এবং অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক কোম্পানীগুলি তাঁর আদেশ-নির্দেশগুলি অমান্য করতে সাহসী হতো না।
তাঁর শাসনকালের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল বাংলার ওপর বারবার মারাঠা আক্রমণ। মারাঠা আক্রমণের বিভীষিকা থেকে বাংলাকে রক্ষা করবার অন্য কোন উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত তিনি ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দে তাদের সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদন করেন।
ঐ চুক্তির শর্ত হিসাবে তিনি মারাঠাদের হাতে বাংলা সুবার অন্তর্গত ওড়িষ্যার অধিকাংশ অর্পণ করেন ও বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা চৌথ দিতে স্বীকৃত হন।
সিরাজদ্দৌলা
১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে আলীবর্দী খাঁর মৃত্যু হয়। বাংলার নবাব এবার হলেন আলীবর্দী খাঁরই প্রিয় দৌহিত্র সিরাজদ্দৌলা। সিরাজদ্দৌলা বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত থাকেন মাত্র এক বছরের কিছু বেশী সময়।
১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে পলাশীর প্রান্তরে সিরাজ মীরজাফর প্রমুখ সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে ক্লাইভের পরিচালনাধীন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সৈনাবাহিনীর নিকট পরাজিত হন।
পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ে বাংলার স্বাধীন নবাবীর অবসান হয়। বাংলার ওপর ইংরেজ অধিপত্য বিস্তার সমগ্র ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করে দেয়।
স্বাধীন অযোয্যা রাজ্যের সুত্রপাত
মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির যুগে বাংলার মতই সাম্রাজ্যের অপর এক সুবা অযোধ্যা স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। মূল অযোধ্যা বলে পরিচিত ভূখণ্ড পূর্বে বারাণসী এবং পশ্চিমে এলাহাবাদ ও কানপুরের নিকটবর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। ১৭২৪ খ্রীষ্টাদে অযোধ্যায় সিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত সুবাদার সাদী (১৭২৪-৩১ ) স্বাধীন নবাবীর প্রবর্তন করেন।
বিদেশী আক্রমণকারী নাদির শাহের আক্রমণের হাত থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করবার জন্যে তিনি মুঘল বাদশাহের পক্ষে কর্ণালের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কর্ণালের যুদ্ধে মুঘল বাহিনীর চরম পরাজয় ঘটে এবং সাদৎ সহ বহু পদস্থ ব্যক্তি বন্দী হন। বন্দী অবস্থায় অমর্যাদার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য মৃত্যুর পর তাঁর প্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা সফদর তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।
সা জং (১৭৩৯-৫৪ খ্রীঃ) অযোধ্যার নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। সফদর জং-এর পুত্র সুজাউদ দৌলা (১৭৫৪-৭৫ খ্রীঃ) ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং সমগ্র ভারতবর্ষের ওপর ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টার সঙ্গে অযোধ্যার ভাগ্যকে জড়িত করে ফেলেন।
১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসী কুশাসনের অভিযোগে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে পদচ্যুত করে অযোধ্যাকে ব্রিটিশ সম্রাজ্যভুক্ত করেন, ফলে স্বাধীন অযোধ্যা রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে ।
হায়দ্রাবাদের নিজাম রাজ্য
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে দাক্ষিণাত্যে এক স্বাধীন মুসলমান রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। হায়দ্রাবাদের নিজাম বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন চিন কিলিচ বাঁ। তিনি বাদশাহ্ ঔরঙ্গজেবের অধীনে দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাদশাহ বাহাদুর শাহ ১৭১৩ খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে অযোধ্যার সুবাদার নিযুক্ত করেন।
বাদশাহ্ ফাররুখসিয়ার তাঁকে ‘খান খানান’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং নিজাম-উল-মূলক্ ফতে জং’ উপাধি দিয়ে দাক্ষিণাত্যে সুবাদার হিসেবে পাঠান। বাদশাহের ওপর সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রভাব পরিপূর্ণভাবে বিস্তৃত হলে সাময়িকভাবে চিন কিলিচ খাঁর ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে।
সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের পতনের পর ১৭২০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি পুনরায় দাক্ষিণাত্যে সুবাদার পদে নিযুক্ত হন। মুঘল বাদশাহ্ মহম্মদ শাহ্ নিজামকে ‘আসফ ঝা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। পুরুষানুক্রমে নিজামের উত্তরাধিকারীরা এই উপাধির গর্ব করতে থাকেন। চিন কিলিচ খাঁ-ই ‘নিজাম-উল-মূলক’ নামে খ্যাতি অর্জন করেন।
নিজাম-উল্ মূল্ক অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে অবস্থিত তাঁর রাজ্য শাসন করেছিলেন। প্রতিবেশী মারাঠা রাজ্যের আক্রমণের হাত থেকে নিজ রাজ্যকে রক্ষা করবার জন্যে তিনি কখনও কূট-কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেন, কখনও-বা সম্মুখ যুদ্ধে অবর্তীর্ণ হন।
তিনি উত্তর ভারতস্থিত মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রয়াসী হন। তিনি নাদির শাহের বিরুদ্ধে মুঘল বাদশাহের সহযোগী হিসেবে কর্ণাল-এর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। নাদির শাহ্ বাদশাহকে নিজামের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে পরামর্শ দেন (“Nadir shah cautioned the Emperor against the Nizam whom he found to be full of cunning and self-interested and more ambitious than becomes a subject.”)।
নাদির শাহের ভারত ত্যাগ করার পর নিজাম দাক্ষিণাত্যে নিজ ক্ষমতা অধিকতর সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর সময় দাক্ষিণাত্যের মুঘল সাম্রাজ্যের নামেমাত্র শাসন থাকলেও ঐ রাজ্যটি বস্তুতঃ স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়।
তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন পর্যন্ত ইউরোপীয় বণিকগণ দাক্ষিণাত্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে সাহসী হয় নি। নিজাম-উল-মূল্ক নানা গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি সুশাসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সমৃদ্ধির পথ প্রস্তুত করে প্রজাসাধারণের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেন।
রোহিলখণ্ড ও বুন্দেলখণ্ড
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরবর্তী সময়কালে রুহেলা এবং বঙ্গাস পাঠানগণ যথাক্রমে রোহিলখণ্ড এবং বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে দুটি পাঠান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। রোহিলখণ্ড রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দায়ুদ খাঁ-এবং তাঁর পুত্র আলী মহম্মদ খাঁ।
এই রাজ্য উত্তরে কুমায়ুন পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে গঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বুন্দেলখণ্ড রাজ্যটি ফররুখাবাদ, এলাহাবাদ এবং বুন্দেলখণ্ড নিয়ে গঠিত হয়েছিল।
রাজপুত, শিখ ও মারাঠাগণ
বাদশাহ্ ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে হিন্দুদের মধ্যে রাজপুত, শিখ, জাঠ, মারাঠা প্রভৃতি শক্তি মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। ঔরঙ্গজেবের জীবদ্দশাতেই রাজপুতগণ নিজেদের ধর্ম ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। তাঁর ধর্মান্ধতাই রাজপুতদের এরূপ অস্থিরতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাঁর মৃত্যুর পর বাদশাহ্ প্রথম বাহাদুর শাহ্ মেবার, মারোয়াড়, অম্বর প্রভৃতি অগ্রগণ্য রাজপুত রাজ্যগুলিকে কখনও যুদ্ধে পরাজিত করে, কখনও বা অন্য উপায়ে তুষ্ট করে শান্ত রাখতে সচেষ্ট হন। সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় যখন সাম্রাজ্যের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং মহম্মদ শাহ্ যখন মুঘল বাদশাহ্ তখনও রাজপুতগণ বহুলাংশে মুঘল শাসনের পক্ষপাতী ছিলেন।
সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা নিজ নিজ প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। শিখদের ক্ষেত্রে ঘটনার গতি এক বিশেষ রূপ নিয়েছিল। ১৭০৮ খ্রীষ্টাব্দে আততায়ীর হাতে শিখদের দশম তথা শেষ গুরু গোবিন্দ সিং-এর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর বান্দার নেতৃত্বে শিখদের প্রাধান্য শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিস্তৃত হয়।
১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দে বান্দাকে হত্যা করার পর মুঘল বাদশাহের ধারণা হয় যে শিখ শক্তির মেরুদণ্ড চিরকালের জন্যে ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু গুরু গোবিন্দ সিং-এর শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ শিখ জাতিকে পদদলিত করা সম্ভবপর হয় নি।
নাদির শাহ্ এবং আবদালীর আক্রমণকালে কয়েকবার পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও শিখগণ পাঞ্জাবে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকে এবং বৈদেশিক আক্রমণের ফলে কেন্দ্রীয় শক্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে শিখগণ পাঞ্জাবের বৃহৎ অঞ্চলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।
দিল্লী, আগ্রা, মথুরা প্রভৃতি অঞ্চলে জাঠগণ ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সুরজমলের নেতৃত্বে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। সুরজমল মাত্র সাত বৎসর রাজত্ব করেন। ঐ সময়কালে জাঠ রাজ্যের যথেষ্ট প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে জাঠ রাজ্যের গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে।
মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মারাঠাগণ সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী ও কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হয়। পেশোয়াদের নেতৃত্বে মালব এবং গুজরাট থেকে মুঘল কর্তৃত্ব অপসারিত হয়। রাজপুতনার ওপর মারাঠারা প্রভাব বিস্তার করে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ফলে ভারতে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা পূর্ণ করতে মারাঠারা অগ্রসর হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মারাঠাগণ প্রকৃতপক্ষে উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যের মুঘল শক্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে।
কিন্তু ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে আফগানিস্তানের অধিপতি আহম্মদ শাহ্ আবদালীর হাতে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে তাদের পরাজয় ভারতের ইতিহাসকে নতুন পথে প্রবাহিত করে। বাংলাকে শক্তির কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে ইংরেজগণ ভারতে প্রাধান্য বিস্তারে অগ্রসর হয়।
মারাঠাগণ অবশ্য ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইংরেজ শক্তিকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। ইংরেজরাই শেষ পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপন করে। একদা ভারতব্যাপী বিস্তৃত এবং চরম শক্তিশালী মুঘল সাম্রাজ্য এইভাবে শেষ পরিণতি লাভ করে।
উপসংহার
উপরে আলোচ্য আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রশ্নের উত্তর আসাকরি আপনাদের ভালো লেগেছে। আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থান সম্পর্কে আমার দেওয়া তর্থ্য ব্যাতিত আপনার কোনো তর্থ্য জানা থাকলে আমনারা আমাদের কমেন্ট বক্সতে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।
আপনাদের একটি কমেন্ট আমাদেরকে সঠিক তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আরো উৎসাহিত করে। আমরা সর্বদা চাইবো আপনাদেরকে সঠিক তথ্য দিয়ে আপনার জ্ঞানভান্ডারকে আরো মজবুত করতে। প্রয়োজনে আপনার বন্ধুদের কাছে আমাদের এই আর্টিকেলটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ রইলো।
FAQs আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন: মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট কে?
উত্তর: দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ।
প্রশ্ন: মুঘল আমলে সোনার মুদ্রা কি নামে পরিচিত ছিল?
উত্তর: মুঘল আমলে সোনার মুদ্রাকে মোহর বলা হত।
প্রশ্ন: স্বাধীন অযোধ্যা রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?
উত্তর: 1722 সালে সাদাত আলী খান বা সাদাত খান বুরহান-উল-মুলক ছিলেন স্বাধীন অযোধ্যা রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তার রাজত্ব কাল ছিল 1722 থেকে 1739 সাল পর্যন্ত।
প্রশ্ন: হায়দ্রাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?
উত্তর: 1724 সালে নিজাম-উল-মুলক আসাফ জাহ বা মীর কামার-উদ-দিন খান সিদ্দিকী ছিলেন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
প্রশ্ন: বাংলায় মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?
উত্তর: জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বাংলা সহ ভারতের বেশ কিছু অংশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠান করেন।