জোসেফ স্ট্যালিন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে অবিসংবাদী কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন ছিল সেই অপ্রতিহত ক্ষমতা, কমিউনিস্ট দুনিয়ায়ও ছিল একইরকম প্রভাব প্রতিপত্তি। বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তরকালে স্ট্যালিনের প্রভাব ভীতিপ্রদ ছিল। যার ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের আবহাওয়া তৈরি হয়। পৃথিবী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। আমরা তা আলোচনা করব।
স্ট্যালিনোত্তর যুগে বিশ্বরাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা
পূর্ব ইউরোপ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে (পোল্যান্ড, যুগোস্লোভিয়া, হাঙ্গেরী, চেকোশ্লোভাকিয়া প্রভৃতি) কমিউনিস্ট সরকার গড়ে উঠলে নিরাপত্তা ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্য ওয়ারশ জোট গঠিত হয়। পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্ট্যালিনোত্তর যুগে ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধান হলে বি-স্ট্যালিনকরণ নীতি গৃহীত হয়। সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে পোল্যান্ডে গণ বিক্ষোভ শুরু হয়। অগ্রনি ছিল শ্রমিকেরা। পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট দলের নেতা বোলেস্লাভ বেইরুত মারা গেলে একদা স্ট্যালিন জমানায় কারারুদ্ধ পোলিশ জাতীয়তাবাদী নেতা গোমুলকা নতুন সরকার গঠন করেন। ক্রুশ্চেভের সঙ্গে আলোচনায় স্থির হয়; পোল্যান্ডের স্বাধীনতা স্বীকার করা হবে, সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করা হবে, পোল্যান্ড ওয়ারশ জোটে থাকবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে (১৯৫৬) খ্রিঃ।
এরপর হাঙ্গেরিতেও একই কারণে বিদ্রোহ হয়। সোভিয়েত প্রভুত্বে হাঙ্গেরির জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী রাকোসীর সরকারের অ-কমিউনিস্ট সমর্থকরা স্বাধীনতার দাবি জানায়। গণবিক্ষোভ শুরু হয়। রাকোসি ক্ষমতাচ্যূত হন। ইমরে নেগি নতুন সরকার গঠন করেন। ক্রুশ্চেভের সঙ্গে এক আলোচনায় হাঙ্গেরীর স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় এবং সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার স্বীকৃত হয়। কিন্তু হাঙ্গেরি ওয়ারশ জোট ত্যাগের কথা ঘোষণা করলে সোভিয়েত সেনা নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। ইমরে নেগিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সোভিয়েত পন্থী কাদারের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়।
যুগোস্লোভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটোর সঙ্গে স্ট্যালিনের তিক্ততার জন্য কমিনফর্ম (Cominform) থেকে যুগোস্লোভিয়াকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল। কিন্তু ক্রুশ্চেভ আবার দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।
এভাবে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া প্রভৃতি দেশে স্ট্যালিনোত্তর কালে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজ নিজ পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রের পথে এগোতে থাকে। সংকট ঘনীভূত হয়। পরে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে।
এশিয়া
এশিয়ার বৃহত্তম কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চিনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যালিনোত্তর যুগে সুসম্পর্ক কিছুটা গড়ে ওঠে। ক্রুশ্চেভ পিকিং সফরে যান। চিন ও মস্কো সফরে প্রতিনিধি পাঠায়। সীমান্ত বিরোধের বিষয়ে আলোচনা হয়। যদিও তা ফসপ্রসূ হয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন : মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলির মধ্যে বিশেষত মিশর, সিরিয়া, ইরাক-এর সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে কারিগরি ও অস্ত্র সাহায্য করে এবং আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে অগ্রনি ভূমিকা নেয়।
নির্জোট আন্দোলনেও ক্রুশ্চেভ সহানুভূতি দেখান। কাশ্মীর, প্রশ্নে ভারতের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাক যুদ্ধে তাসখন্ড চুক্তি সম্পাদন করে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাক যুদ্ধে ভারতকে নানাভাবে সাহায্য করেন।
একদা ফরাসি উপনিবেশ ইন্দোচীন বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ফ্রান্স আবার ঔপনিবেশিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সাহায্য করে। তবুও ফ্রান্স পরাজিত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামের নো-দিন-দিয়েন সরকারকে সাহায্য করে। মার্কিন সৈন্য প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভিয়েতনামকে নানাভাবে সাহায্য করে। শেষ পর্যন্ত ভিয়েতনাম জয়ী হয়।
কঙ্গো
আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গো রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার সময় (১৯৬০ খ্রিঃ) গৃহযুদ্ধের কবলে পড়লে সোভিয়েত ইউনিয়ন লুমুম্বা গোষ্ঠীকে সাহায্য করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিরোধী গোষ্ঠীকে সমর্থন করে। শেষ পর্যন্ত মার্কিন সমর্থিত গোষ্ঠী জয়লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন কঙ্গোয় পিছু হঠে।
কিউবা সংকট
লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতেও সাম্যবাদী প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সমর্থিত বাতিস্তাকে দেশত্যাগী করে বামপন্থী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধ ঘোষণা করে।
কাস্ত্রো মার্কিন মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয়করণ করলে বাতিস্তা সমর্থকদের সামরিক সাহায্য দিয়ে মার্কিন যুক্ত -রাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ শুরু করে। শেষ পর্যন্ত. জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় সমস্যাটি মিটে যায়।
অস্ত্র সীমিতকরণ
NATO-র প্রত্যুত্তরে Warshaw জোট গঠন, বার্লিন সংকট দুই মহাশক্তির অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করেছিল কিন্তু ব্রিটেন, ফ্রান্স, চিন পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠায় অস্ত্র প্রসারের বিপজ্জনক দিক সম্বন্ধে দুই দেশই সতর্ক হয়। শক্তি সাম্য সম্বন্ধে তাদের চিন্তিত করে।
ক্রুশ্চেভ পারমাণবিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে ভোগ্য পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধিতে আগ্রহী ছিলেন। ফলে অস্ত্র সীমিতকরণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তি সম্পাদিত হয়। ব্যয়বহুল দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র S.S-20, S.S-24 এবং মার্কিন M.X. ক্ষেপণাস্ত্র বাতিল করা হয়। নিউট্রন বোমা নিষিদ্ধ হয়।
SALT-1, SALT-2 চুক্তি সম্পাদিত হয়। এছাড়া পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা ও গবেষণা নিষিদ্ধকরণের জন্য N. P.T (Nuclear Non-Proliferation Treaty), P.T. B.T (Partial Test Ban Treaty) আরও পরে C.T.B.T (Comprehensive Test Ban Treaty) সম্পাদিত হয়। বিশ্বশান্তি রক্ষা যে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল কথা, এই চুক্তিগুলির মাধ্যমে তা প্রচারিত হয়।
উপসংহার
এভাবে স্ট্যালিনোত্তর যুগে সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনও আগ্রাসী, কখনও উদার, বিশ্বশান্তির অন্যতম বানীবাহক, নিপীড়িত নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠীর মুক্তি দাতা, বিশ্বে সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতারূপে প্রশংসা ও সমালোচনার যোগ্য এক ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধের নতুন আর্থিক ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হল। সমাজতন্ত্র তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারল না।