দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে সাফল্য লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত অক্ষশক্তি (জার্মানি, ইটালি ও জাপান) মিত্রশক্তির (ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) কাছে পরাজিত হয়েছিল। অক্ষশক্তির এই পরাজয়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল :
(১) দুই শিবিরের মধ্যে যুদ্ধের লক্ষ্যগত পার্থক্য:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তির মধ্যে যুদ্ধের লক্ষ্যগত মৌলিক পার্থক্য ছিল। অক্ষশক্তির যুদ্ধাভিযানের পেছনে ছিল আগ্রাসী মনোভাব ।
আর মিত্রশক্তির লক্ষ্য ছিল বিশ্বে গণতন্ত্র, শাস্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ধনতন্ত্রী ও সাম্রাজ্যবাদী হলেও বিশ্বজনমত ছিল তাদের পক্ষে। কারণ তারা গণতন্ত্রের পক্ষে ছিল। নাৎসী জার্মানীর হাতে ইউরোপের পতন ঘটলেও ব্রিটেন অজেয় ছিল।
‘ব্রিটেন যুদ্ধ’ অসমাপ্ত রেখে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলে কমিউনিষ্ট ও অকমিউনিস্ট গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি ফ্যাসী বিরোধী জোট গঠন করে। সেই জোটশক্তির মোকাবিলা করা অক্ষশক্তির পক্ষে সম্ভব ছিল না।
(২) অক্ষশক্তির স্বদেশে জনপ্রিয়তা হ্রাস:
অক্ষশক্তির স্বৈরাচারী শাসকেরা নিজেদের দেশেই জনসমর্থন লাভ করতে পারেনি। অনর্থক যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকট, নিরাপত্তাহীনতা, সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছিল।
জার্মানিতে কয়েকবার নাৎসি শাসন উৎখাতের চেষ্টা করা হয়। হিটলারকে তাঁর স্বদেশেই বারবার মৃত্যুর মুখে পড়তে হয়েছিল। ইতালিতে মুসোলিনির বিরুদ্ধে জনমত এত প্রবল হয়েছিল যে তাঁকে পদচ্যুত ও বন্দি করা হয়। পরে এক গণ আদালতে অগ্নিকুণ্ডের ওপর পা বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়।
(৩) অক্ষশক্তির দুর্বলতা:
মিত্রশক্তির তুলনায় অক্ষশক্তির সম্পদের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত স্বপ্ন। অক্ষশক্তির মধ্যে জার্মানি কিছুটা শক্তি শালী ছিল। কিন্তু তার অপর দুই সহযোগী জাপান ও ইতালির আর্থিক অকথা ছিল খুবই দুর্বল।
যুদ্ধের সিংহ ভাগই জার্মানিকে বহন করতে হয়েছিল। অপরদিকে মিত্রশক্তির প্রত্যেকে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শক্তি সম্পদে ভরপুর ছিল। তাই মিত্রশক্তিবর্গের যৌথ শক্তি সম্পদের বিরুদ্ধে মূলত জার্মানির একক শক্তি সম্পদের দ্বারা লড়াই করে অক্ষশক্তির জয়ের কোনো আশাই ছিল না।
অক্ষশক্তি ভুক্ত জার্মানি, ইতালি ও জাপানের ভৌগোলিক আয়তন ছিল কম। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে শত্রুর আক্রমণ মোকাবিলার জন্য পিছিয়ে এসে পুনরাক্রমণ করার মত উপযুক্ত ভূখণ্ড অক্ষশক্তিভুক্ত দেশগুলির ছিল না। তাই নৌ-বিমান-স্থলবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হয় নি।
🔥আরও পড়ুনঃ-
(৪) অক্ষশক্তির মধ্যে আন্তরিকতার অভাব:
অক্ষশক্তির মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল। যুদ্ধের প্রথম দিকে ইতালি বা জাপান যুদ্ধে কেউই যোগ দেয়নি। মুসোলিনি যুদ্ধে যোগ দেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় সাড়ে আট মাস পর।
হিটলার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু মুসোলিনী এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। মুসোলিনী অর্থ সংকট ও আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের অভাবের কারণে যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেছিলেন।
জাপানের ইউরোপের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই জার্মানি বিভিন্ন রণাঙ্গনে সহযোগীদের কাছ থেকে তখন বিশেষ সাহায্য পায়নি। অক্ষশক্তির মধ্যে আন্তরিকতার অভাব জার্মানির পরাজয়ের অন্যতম একটি কারণ।
(৫) ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যর্থতা:
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যর্থতা জার্মানির পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। ফ্রান্স জয় করার পর হিটলার ইংল্যান্ড জয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু নৌশক্তিতে অপ্রতিরোধ্য ইংল্যান্ডকে পরাজিত করতে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করা হিটলারের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তাই হিটলার বিমান আক্রমনের দ্বারা ইংল্যান্ডকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। হাজার হাজার জার্মান বিমান ১৪ ঘন্টা বোমাবর্ষণ করেও ব্রিটেনকে বিধ্বস্ত করতে পারেনি।
উপরন্তু ইংল্যান্ড পাল্টা বিমান আক্রমণ করে জার্মানির বহু শিল্প ও নগর ধ্বংস করে দেয় এবং বহু জার্মান বিমানকে ভূপাতিত করে দেয়। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হিটলারের ব্যর্থতা তার পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
(৬) রুশ অভিযানের ব্যর্থতা:
রাশিয়া অভিযান ছিল হিটলারের চরম ভুল। ১২৯ বছর পূর্বে নেপোলিয়ান রাশিয়া অভিযান করে যে ভুল করেছিলেন, হিটলারও রাশিয়া আক্রমণ করে সেই ভুল করেছিলেন।
আর এই ভুলের মাশুল জার্মানির পতনকে ত্বরান্বিত করে। হিটলার দ্রুতগতিতে রুশ অভিযান শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পোড়া মাটি নীতি অনুসরণ করে, গেরিলা রণকৌশল ও স্থানে স্থানে প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টি করে রুশ বাহিনী হিটলারের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়।
সেনাপতিদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে তিনি মহা ভুল করেছিলেন। তাই সর্বশক্তি নিয়োগ করেও তিনি এই অভিযানে ব্যর্থ হন। আর এই ব্যর্থতা তার পতনকে ত্বরান্বিত করে।
(৭) যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের ব্যাপারে অক্ষশক্তির কৌশলগত ত্রুটি:
যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের ব্যাপারেও অক্ষশক্তির কিছু কৌশলগত ত্রুটি ছিল— যেমন
(ক) অস্ত্রের উৎকর্ষ বিচারে জার্মানির পকেট ব্যাটেলশিপ, সাবমেরিন, হ্যারিকেন বিমান, ক্ষেপনাস্ত্র (ডটার অব রাইন), ট্যাংক অতি উন্নত ছিল কিন্তু সংখ্যা ও গুণমানে ইঙ্গ-মার্কিন নৌ-বিমানবহর ও ট্যাংক শ্রেষ্ঠ ও সমুন্নত ছিল। আর পরমাণু বোমা তৈরিতে জার্মানির অসম্পূর্ণতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্য অক্ষশক্তির ব্যর্থতা সূচিত করে।
(খ) মিত্রপক্ষের নৌ-শক্তি ধ্বংস করার জন্য এডমিরাল ডোনিজ একটি Naval Air Force গঠনের প্রস্তাব দিলে হিটলার তা অগ্রাহ্য করেন।
(গ) হিটলারের আরও একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল জেট রকেট তৈরির ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ভি (V) রকেট তৈরির ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। তাই তিনি ১৯৪৪ এবং ১৯৪৫-এর বিধ্বংসী বোমারু বিমান আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেন নি।
(৮) হিটলারের চরিত্র:
হিটলারের ব্যক্তিগত চরিত্রও জার্মানির পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। হিটলার ছিলেন উদ্ধত, স্বৈরাচারী, খামখেয়ালি, সন্দেহপ্রবণ প্রকৃতির মানুষ। অভিজ্ঞ সেনানায়ক ও পদস্থ কর্মচারীদের তিনি যোগ্য মর্যাদা দিতেন না।
রোমেল, হিমলার, গোয়েরিং প্রমুখ তাঁর একান্ত আনুগত সেনাধ্যক্ষরাও তাঁর দুর্ব্যবহার থেকে রেহাই পাননি। ফলে প্রশাসন ও সেনাদলের আস্থা তিনি অর্জন করতে ব্যর্থ হন। সমগ্র জার্মান জাতি তাঁর একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসনে ক্ষুব্ধ ছিল।
তাই যুদ্ধে নাৎসি বাহিনী পরাজিত হতে থাকলে দেশের অভ্যন্তরে নাৎসি শাসনের প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ পেতে থাকে। এতে জার্মান বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। এই অবস্থায় জার্মানির পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।