আজ আমরা এই নিবন্ধে সমসাময়িক রাজতন্ত্রগুলির মধ্যে গৌরবের শিখরে থাকা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি অন্বেষণ করব।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য , চাণক্য ও অশোকের প্রচেষ্টায় মৌর্য সাম্রাজ্য বিশাল রূপ পরিগ্রহ করলেও খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ অব্দে অশোকের মৃত্যুর পর খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ অব্দের মধ্যে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে দশম সম্রাট বৃহদ্রথকে তার সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন।
তবে কোনো একটি বিশেষ কারণের জন্য মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটেনি , পতনের পিছনে অসংখ্য কারন রয়েছে আর এই অসংখ্য কারনের জন্য মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ গুলি নিম্নে আলোচনা করা হলো-
(১) ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়া:-
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের বিভিন্ন কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি কারণ হলো ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়া। সম্রাট অশোকের নীতি ব্রাহ্মণদের মনে তীব্র বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, অশোক সহিষ্ণুতা নীতি অবলম্বন করলেও ব্রাহ্মণদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রাণী হত্যা ও মহিলাদের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান বন্ধ করেছিলেন।
বলিদান প্রথা ও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান থেকে ব্রাহ্মণরা যে দক্ষিণা ও উপঢৌকন পেতেন সেই আয় যথেষ্ট কমে গিয়েছিল ফলে ব্রাহ্মণরা খুব রুষ্ট হয়েছিলেন।
ব্রাহ্মণরা এমন একটি রাজনীতির আশা করেছিলেন, যে রাজনীতি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে এবং বিভিন্ন সুবিধা ও অধিকার ভোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করবে না। মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্রাট অশোক এই সবকিছু উপেক্ষা করেছিলেন তাই ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল।
(২) সাম্রাজ্যের বিশালতা:-
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের বিভিন্ন কারণের মধ্যে যেমন ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়ার একটি কারণ ঠিক তেমনি সাম্রাজ্যের বিশলতা আরো একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
সে যুগে দ্রুত গমনাগমন ব্যবস্থার অভাব ও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের অসুবিধার ফলে কেন্দ্রীয় রাজশক্তির পক্ষে সর্বত্র আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। ফলে সাম্রাজ্যের বিশালতা তেমন ভাবে হয়নি।
(৩) প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অত্যাচার:-
অশোকের শিলালিপি থেকে জানতে পারা যায় যে , অশোক শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে রাজকর্মচারীদের উপর নির্ভর করায় এবং তাদের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল থাকায় প্রদেশগুলিতে প্রাদেশিক শাসকেরা জনসাধারণের উপর অত্যাচার চালাতো।
জনসাধারণের উপর অত্যাচার চালালে অশোকের মৃত্যুর পর এই অত্যাচার চরমে পৌঁছলে চতুর্দিকে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী প্রাদেশিক শাসকেরা সাম্রাজ্যের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করে দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
(৪) অশোকের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা:-
অশোকের পরবর্তী সম্রাটগণ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা সমাধানে সক্ষম ছিলেন না। রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় যে , জলোকি কাশ্মীরের স্বাধীনতা ঘোষণা করে কনৌজ পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেন।
তারানাথ রচিত গ্রন্থ অনুসারে বীরসেন গান্ধারে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সুতরাং , অশোকের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা ও পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ।
(৫) অশোকের অহিংস নীতি:-
অশোক সিংহাসনে বসার বারো বছর পরে কলিঙ্গ যুদ্ধে অসংখ্য জীবনহানির ঘটনায় অশোক মর্মাহত হন এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে অহিংস নীতি প্রচারে মনোনিবেশ করেন।
কলিঙ্গের যুদ্ধের সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে এই ধারণা করা হয়, মৌর্য্য সম্রাট অশোকের কোন ভাই কলিঙ্গ রাজ্যে আশ্রয় নেন। তার প্রতিশোধ নেবার জন্য অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৫ অব্দে দয়া নদীর নিকটবর্তী ধৌলি পাহাড়ের কাছে মৌর্য্য ও কলিঙ্গ বাহিনীর মধ্যে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। দু’দলের প্রচুর হতাহতের মাধ্যমে অশোক কলিঙ্গ জয় করতে সক্ষম হন।
এই যুদ্ধে কলিঙ্গ বাহিনীর ১,০০,০০০ সেনা ও মৌর্য বাহিনীর ১০,০০০ সেনা নিহত হয় ও অসংখ্য নর-নারী আহত হয়।
যুদ্ধের বীভত্সতা সম্রাট অশোককে বিষাদগ্রস্থ করে তোলে এবং তিনি যুদ্ধের পথত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে এবং অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনের নীতি গ্রহণ করেন।
(৬) অর্থনৈতিক অবক্ষয়:-
যদিও সমগ্র উপত্যকায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রাধান্য ছিল ; কিন্তু সাম্রাজ্যের সর্বত্র অর্থনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থায় প্রকার ভেদও ছিল যথেষ্ট।
এর ফলে অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়ে গোটা মৌর্য সাম্রাজ্যের ওপর এক চরম অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনে। ফলে সাম্রাজ্যের সুস্থিরতা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
(৭) আনুগত্যহীনতা:-
সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর মৌর্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজশক্তি দুর্বলতা দেখা যায় ফলে সম্রাটের অধীনে থাকা উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের সম্রাটের প্রতি আনুগত্য হীনতা প্রকাশ পায়।
(৮) আঞ্চলিক বিদ্রোহ:-
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে প্রাদেশিক গোষ্ঠীর নেতারা শক্তিশালী হতে শুরু করে। রাজা দুর্বলতার সুযোগে তারা অনেক সময় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। যা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
🔥আরও পড়ুনঃ-
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশোক কতটা দায়ী ছিলেন?
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশোক কতটা দায়ী বা দায়ী নয় সেই বিষয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশোক দায়ী আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন অশোক দায়ী নয়। ডক্টর রায়চৌধুরী অশোকের দুটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন।
ডক্টর রায়চৌধুরীর মতে:-
১. অশোক রাজকর্মচারীদের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা তুলে দিয়ে কেন্দ্রে বিরোধী শক্তি পরিপুষ্ট করেছিলেন।
২. অতিরিক্ত দান , ধ্যান করে অশোক দেশের কোষাগারের ক্ষতিসাধন করেছিলেন।
আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে:-
অশোক মারা যান খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ সালে। মৌর্য সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ সালে। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশোক কোনভাবেই দায়ী ছিলেন না। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের চূড়ান্ত কারণ ছিল ঘরের শত্রু বিভীষণ।
মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বৃহদ্রথের নিজ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ বৃহদ্রথকে হত্যা করে মগধের সিংহাসন দখল করেন।এরই মধ্যে দিয়ে মৌর্য সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটে।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ছিল ভারতীয় ইতিহাসের একটি টার্নিং পয়েন্ট। এই সাম্রাজ্য ইতিহাসের প্রথম শক্তিশালী সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্রাট অশোকের ধর্মীয় নীতি এবং ব্রাহ্মণদের বিদ্বেষকে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ডক্টর হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং অন্যরা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য সম্রাট অশোকের অহিংসা নীতি কে দায়ী করেছেন। অশোকের এই অহিংসা নীতি অবলম্বন তার বিশাল সেনাবাহিনী কে প্রায় অকেজো এবং তার আমরা তার আমলারা স্বৈরাচারী করে তুলেছিল।
যদিও তত্ত্বটি সম্রাট অশোককে দায়ী করা হয়, তবে এটা বলা যেতে পারে যে, সম্রাট অশোকের অহিংসা বা ধর্মীয় বিজয়ের আদর্শ এই সম্রাজ্যের পতনের দিকে পরিচালিত করেনি, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের আরো অনেক কারণ ছিল।
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য’। ‘চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য’ যিনি গ্রিকদের কাছে সান্দ্রোকোত্তোস বা আন্দ্রাকোত্তাস নামে পরিচিত ছিলেন। তিনিই আবার মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম সম্রাট যিনি বৃহত্তর ভারতের অধিকাংশকে এক শাসনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনি ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ স্বেচ্ছা অবসর নেওয়া আগে পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ‘চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য’ অবসর নেওয়ার পর তার পুত্র বিন্দুসার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট কে ছিলেন?
মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন বৃহদ্রথ। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য , চাণক্য ও অশোকের প্রচেষ্টায় মৌর্য সাম্রাজ্য বিশাল রূপ পরিগ্রহ করলেও খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ অব্দে অশোকের মৃত্যুর পর, খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ অব্দের মধ্যে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে, দশম সম্রাট বৃহদ্রথকে তার সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন।
শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ নিজের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কর্তৃক নিহত হবার পর , মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং শুঙ্গ সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে।
উপসংহার
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। উপরে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলতে পারি মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অসংখ্য কারণ ছিল, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ যেমন-(১) ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়া (২) সাম্রাজ্যের বিশালতা (৩) প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অত্যাচার প্রভৃতি আলোচনা করা হলো।
FAQs
প্রশ্ন: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন কবে হয়?
উত্তর: আনুমানিক 185 খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হয়।
প্রশ্ন: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান কে?
উত্তর: মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ প্রধান সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ।
প্রশ্ন: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর কি হয়েছিল?
উত্তর: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর শুঙ্গ রাজবংশের সূচনা হয় ।