পৃথিবীর ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, কখনও চিরশান্তি বজায় ছিল না; আবার যুদ্ধ-সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলেও তা নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। উত্তেজনা-সংঘর্ষের মাঝে বিরতি থাকে। মানব সভ্যতা সংঘাত-শান্তির, পতন-অভ্যুদয়ের বন্ধুর পথ ধরেই ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। কুড়ি শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের উত্তেজনা ও প্রশমন আমাদের আলোচ্য বিষয়।
দাঁতাত কী?
দাঁতাত (Detente) হল একটি ফরাসি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হল, উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবসান। বিশেষ অর্থে দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতিকে ‘দাঁতাত’ বলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে প্রায় দুই দশক ধরে রুশ-মার্কিন ঠান্ডা যুদ্ধ (Cold war) আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে জটিল ও উত্তেজক করেছিল। পৃথিবীর উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা থেকে যে প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষের জন্ম, তা এই সময় বহুমুখী অভিব্যক্তি লাভ করে।
অস্ত্র প্রতিযোগিতা, পরস্পর বিরোধী প্রচার; সামরিক জোট গঠন (NATO, Warshaw) অনুগত রাষ্ট্রসংখ্যা বৃদ্ধি, প্ররোচনা-হস্তক্ষেপ দুই শক্তির নীতি হয়ে দাঁড়ায় (Ref-The Cold war & it’s Origin D.S. Fleming)
ইতিহাসের আবর্তন চক্রের (Cyclic order) মত এই উত্তেজনাও স্থায়ী হয়নি। দুই পরাশক্তি কাছাকাছি আসে। উত্তেজনার প্রশমন ঘটে। পৃথিবী আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। এই উত্তেজনা হ্রাস প্রক্রিয়া হল দাঁতাত।
🔥আরও পড়ুনঃ-
👉 স্ট্যালিনোত্তর যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব ইউরোপে প্রভাব
বিশ্ব রাজনীতিতে দাঁতাত :
কিউবা :
David L. Larson তাঁর The Cuban crisis of 1962-63 গ্রন্থে বলেছেন, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের কিউবার সংকট এই সংঘাতময় সম্পর্কের চরম পর্যায়। ঠান্ডা যুদ্ধের চরমবিন্দু এবং দাঁতাতের সূচনা।
১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবার ক্ষমতা দখলের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাদেশীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া ঘটে, তা দমন করার জন্য মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা (CIA) কিউবায় প্রতিবিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়।
নিরাপত্তার জন্য কিউবা সোভিয়েত সাহায্যপ্রার্থী হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ শুরু করে। ভূ-রাজনৈতিক (Geo-Political) ও কৌশলগত (Strategic) গুরুত্বের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে অবরুদ্ধ করে।
শেষ পর্যন্ত জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ধ্বংস করে। ক্রুশ্চেভ ও কেনেডি কাছাকাছি আসেন।
জার্মানি :
বার্লিনকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমী জোটের চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয় (১৯৪৮, ১৯৫৮) সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধান ক্রুশ্চেভ পশ্চিমী দেশগুলিকে ছয়মাসের মধ্যে বার্লিন ত্যাগ করার নির্দেশ দিলে তারা তা অগ্রাহ্য করে এবং আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অভিযুক্ত করে।
উত্তেজনা বাড়ে। বার্লিন প্রাচীর নির্মিত হয় (২৩ আগস্ট, ১৯৬১)। সীমানা বন্ধ হয়। পরে ছাড়পত্র চালু হয় সাধারণ মানুষের যাওয়া আসার জন্য (সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩ খ্রিঃ)। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম জার্মানির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবার উত্তেজনা দেখা দেয়।
শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স মিলিত হয়ে বার্লিন চুক্তি স্বাক্ষর করে (সেপ্টেম্বর, ১৯৭১) পশ্চিম জার্মানী (FRG) ও পূর্ব জার্মানি (GDR) জাতিপুঞ্জের সদস্য হয় (১৯৭৩)। উত্তেজনা হ্রাস পায় ।
আফগানিস্থান :
আফগানিস্থানের প্রেসিডেন্ট দায়ুদকে হত্যা করে আফগান জনগণতান্ত্রিক দলের (বামপন্থী) নেতা হাফিজুল্লা আমিন ক্ষমতা দখল করেন। তারই আমন্ত্রণে সোভিয়েত সেনা আফগানিস্থানে প্রবেশ করে (ডিসেম্বর, ১৯৭৯ খ্রিঃ)।
অল্পকাল মধ্যে হাফিজুল্লা আমিনকে CIA ‘র কসাই অপবাদ দিয়ে হত্যা করে ওই দলের অন্য নেতা বারবাক কারমালকে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট করে। আফগানিস্থানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগানদের অস্ত্র সাহায্য দেয়।
সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট সরকারকে চাপ দেওয়া ও আলোচনায় বাধ্য করার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া চলে। জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে আলোচনা শুরু হয়।
শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পাকিস্তান, আফগানিস্থান জেনিভা চুক্তি স্বাক্ষর করে (১৪ই এপ্রিল, ১৯৮৮ খ্রিঃ)। স্থির হয় ১৯৮৮ খ্রিঃ, ১৫ই মে থেকে নয় মাস সময়ের মধ্যে আফগানিস্থান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করা হবে।
অন্যান্য অঞ্চল :
১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইরানের প্রেসিডেন্ট মহঃ রেজা শাহ পহ্লবী ইসলামি বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হলে মার্কিন স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। স্বার্থ রক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেনিয়া, সোমালিয়া, ওমান, কুয়েত’এ এবং কঙ্গোয় ও ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়ায় ঘাঁটি নির্মাণ করে।
এই সব অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়ন পিছিয়ে পড়ে। পরে লাতিন আমেরিকার এল, সালভাদোর, এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্ররা এল সালভাদোর-এ অস্ত্র সরবরাহ করে ও প্রশিক্ষক পাঠায়।
এই ঘটনাকে দৃষ্টাস্ত করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রেগন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এক আন্তর্জাতিক সংঘাতের সূচনা করেন। নক্ষত্র যুদ্ধ পরিকল্পনা (Star war Plan) গৃহীত হয়। পরে (১৯৮৫ খ্রিঃ) জেনিভা শিখর সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা হ্রাস করা হয়।
অস্ত্রসীমিতকরণ :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিমেরু বিশ্ব বহুকেন্দ্রিক হয়ে উঠলে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়াও ব্রিটেন, ফ্রান্স, চিন, ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠলে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা সম্বন্ধে দুই পরাশক্তি চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা তখন অস্ত্র সীমিতকরণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন’এর পরমাণু প্রসার রোধ চুক্তি (Nuclear Test Ban Treaty) (১৯৬৩ খ্রিঃ, ৫ই আগস্ট) দ্বারা সমুদ্রগর্ভে ও ভূ-পৃষ্ঠে পরমাণু পরীক্ষার উপর সীমিত নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়।
নিক্সন-ব্রেজনেভ চুক্তি দ্বারা (১৯৭২ খ্রিঃ, ২৫ মে) ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী অস্ত্র (Anti- Ballastic Missile System) কৌশলগত প্রতিরোধমূলক অস্ত্র (Strategic offensive) সীমিতকরণের সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৭৪ খ্রিঃ নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফোর্ড ও সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধান ব্রেজনেভ ঐক্যমতে পৌঁছান যে, আগামী ১০ বছর আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা হবে না। ৩০শে জুলাই, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত ইউরোপের সংহতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক ৩৫ জাতির শিখর সম্মেলনে (ফোর্ড, ব্রেজনেভ সহ) অস্ত্র সীমিতকরণের কথা আবার বলা হয় ।
এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে SALT-1, SALT-2 চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পাদিত হয়। ইউরোপে মার্কিন ক্রুজ, মাঝারি পাল্লার পার্সিং-২, এম.এক্স. ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস বা সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত NATO নেয়।
একই সঙ্গে পারমাণবিক ওয়ারহেড কমানো, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরানোর কথাও হয়। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব-ইউরোপ থেকে S.S.-4 রকেট, S.S. – 20, SS-22, SS-23 ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে বা ধ্বংস করে ফেলে।
FAQs
প্রশ্ন: দাঁতাত ও ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্যে প্রধান পার্থক্য কী?
উত্তর: দাঁতাত হল 1970 -র দশকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি এবং উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা, আর ঠান্ডা লড়াই হল 1945 থেকে 1991 সাল পর্যন্ত চলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
প্রশ্ন: দাঁতাত শব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেন?
উত্তর: ফরাসি রাষ্ট্রপতি চার্লস দ্য গল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে দাঁতাত বা Detente শব্দটি 1960-এর দশকে প্রথম ব্যবহার করেন।
উপসংহার :
বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনায় উত্তেজনার পারদ বাড়লেও অংশত জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় অংশত শক্তিধরদের আত্মসংযম, অংশত বিশ্বজনমতের চাপে পৃথিবী এখনও বড়ো ধরনের সংকটে পড়েনি।
যদিও ব্যতিক্রমি দৃষ্টান্তের অভাব নেই, শক্তিমানদের স্বার্থপরতার দৃষ্টান্তের অভাব নেই, তবুও বিশ্বের শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও অভাব নেই।
তাদের মতামত, বিশ্বকে উত্তেজনা মুক্ত করে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে সুখী, সমৃদ্ধ করবে, এটা অনুমান। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা কেবল একমেরুকরণ নয়, বহু কেন্দ্রিক হয়ে, বহুর মঙ্গলে নিয়োজিত হবে, সেই লক্ষণও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।