জোসেফ স্ট্যালিন, লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান হল (১৯২৪ খ্রিঃ)। তারপর হত্যাকাণ্ড, গ্রেপ্তার, নির্বাসন দণ্ড প্রভৃতির মাধ্যমে বিরোধী বা প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করে ব্যক্তিগত সর্বময় কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে এক সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর (১৯৫৩ খ্রিঃ) ওই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। আমরা তা আলোচনা করব।
ডি-স্ট্যালিনাইজেশন:
স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ও দলীয় প্রধানের পদ করায়ত্ত করেন। কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম সম্মেলনে (১৯৫৬ খ্রিঃ) ক্রুশ্চেভ দীর্ঘ ভাষণে স্ট্যালিন নীতির সমালোচনা করে তা বর্জন করার কথা ঘোষণা করেন। তারপর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির স্ট্যালিন পন্থী নেতা ম্যালেনকভ, মলোটভ, কাপানোভিচ কে জাতীয় রাজনীতি থেকে বিদায় করা হয়। অনেক নেতার মৃত্যু হয়।
বার্নস্টাইন, কাউটাস্কি যাঁরা একদিন তাত্ত্বিক, কট্টরপন্থী, স্ট্যালিনের সমর্থক বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নীতি বদল করেন। মার্কসবাদের পরিবর্তিত ব্যাখ্যা দেন, সরলীকরণ করেন।
স্ট্যালিনের পথ সম্পূর্ণ বর্জন করা হয়।
রাজনীতিতে ব্যক্তির বদলে গণতন্ত্র, এককেন্দ্রিকতার বদলে বহু কেন্দ্রিকতার নীতি গৃহীত হয়। এজন্য কমিনফর্ম বাতিল করা হয়। বিরোধী মতাবলম্বী যারা কারারুদ্ধ ছিলেন, তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়।
এছাড়া শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান (Peaceful co-existence) শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা, শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন—এই নীতি দ্বারা পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে সুসম্পর্ক, জোট-নিরপেক্ষ নীতিতে সমর্থন, আফ্রো-এশিয়ার সদ্য স্বাধীন দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। ক্ষেপণাস্ত্র আবিষ্কার, মহাকাশ অভিযান, আর্থিক উন্নয়ন শুরু হয়। ভোগ্য পণ্যের অধিক উৎপাদন শুরু হয়। যদিও বিশ্ব রাজনীতিতে সোভিয়েত প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। ওয়ারশ জোট গঠিত হয় (১৯৫৫)। কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ, কঙ্গো, এঙ্গোলায় সাহায্য দান করা হয়, মধ্য প্রাচ্যেও সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধি করা হয়।
🔥আরও পড়ুনঃ-
👉 স্ট্যালিনোত্তর যুগে বিশ্বরাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা কী ছিল ?
পূর্ব ইউরোপ:
সোভিয়েত ইউনিয়নের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের মতো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতেও স্ট্যালিনোত্তর যুগে পরিবর্তনের প্রভাব দেখা যায়। কমিউনিস্ট শাসনে বহু মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমেছিল। এই জমে থাকা ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিস্তালিনকরণ অনুসৃত হলে, তার প্রভাবে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চোকোস্লোভাকিয়ায় গণবিদ্রোহ দেখা দেয়।
পোল্যান্ড:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির বিরুদ্ধে অভিযানের সময় পোল্যান্ড দখল করে এক তাঁবেদার সরকার গঠন করেছিল। পোল্যান্ডের কলকারখানাগুলিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজ স্বার্থে ব্যবহার করত। শ্রমিক, সাধারণ মানুষের অবস্থা দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল না। দৈনন্দিন জীবন, রাষ্ট্র, শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা সব কিছুই কমিউনিস্ট দলের নিয়ন্ত্রিত ছিল।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে শিল্প নগরী ‘পোজেন’এ শিল্প-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ শুরু হয়। সোভিয়েতপন্থী নেতা বোলেস্লাভ বেইরুত মারা গেলে পোলরা আরও উল্লসিত হয়। বিক্ষুব্ধ জনগন পোল্যান্ডের স্বাধীনতা দাবি করে, সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার দাবি করে। স্ট্যালিন বিরোধিতা থেকে বিক্ষোভ ক্রমশঃ সোভিয়েত বিরোধিতায় পরিণত হয়। সোভিয়েত বাহিনী তখন দমন নীতির আশ্রয় নেয়। বিদ্রোহ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ইতিমধ্যে স্ট্যালিন জমানায় কারারুদ্ধ জাতীয়তাবাদী নেতা গোমুলকার-এর নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছিল। ক্রুশ্চেভ তাঁর সঙ্গে আপস রফা করেন। স্থির হয়, পলিট ব্যুরো ভেঙে দেওয়া হবে, ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বীকার করা হবে, সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে, পোল্যান্ড ওয়ারশ জোটভুক্ত থাকবে, পোল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে।
হাঙ্গেরি:
পোল্যান্ডের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাঙ্গেরিকেও সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে। স্ট্যালিনের অনুগত রাকোসি’র নেতৃত্বে এখানে এক কমিউনিস্ট,অ-কমনিউস্ট মিলিত সরকার গড়ে ওঠে। এই সরকার ছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশের মতো হাঙ্গেরিতে জনজীবনের সমস্ত কিছু কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত হত। বিভিন্ন জাতি অধ্যুষিত হাঙ্গেরিতে কমিউনিস্টদের ভিত্তিমূল দৃঢ় না হওয়ায় জনগণের স্বাভাবিক আনুগত্য কখনও সরকার লাভ করে নি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন স্ট্যালিন জমানা শেষ হওয়ার পর বি-স্তালিনকরণের সূত্রে জনসমর্থনের জোয়ারে সোভিয়েত কনিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে রাকোসিকে পদচ্যুত করে ইমরে নেগির নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করা হয়। তিনি অবাধ নির্বাচন, হাঙ্গেরি থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার দাবি করেন। হাঙ্গেরির স্বাধীনতার দাবিও তোলেন। ক্রুশ্চেভ তাতে সম্মত হন। কিন্তু ওয়ারশ জোট ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করলে বিশাল সোভিয়েত বাহিনী (২,৫০,০০০) নিষ্ঠুর দমন নীতি শুরু করে। ইমরে নেগিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কাদারের নেতৃত্বে এক সোভিয়েত অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। (নভেম্বর, ১৯৫৬খ্রিঃ)।
চেকোস্লোভাকিয়া:
নবগঠিত চেকোস্লোভাকিয়া প্রথমে জার্মানির পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে যায়। পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির মতো চেকোস্লোভাকিয়াতেও সোভিয়েত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
চেকোস্লোভাকিয়া ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু দেশের শিল্প-বাণিজ্য, কৃষি এককথায় জাতীয় অর্থনীতি ছিল রাষ্ট্র তথা কমিউনিস্ট দলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থে চেক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হত। ক্রুশ্চেভের আমলে বি-স্ট্যালিনকরণ নীতি চালু করা হলে, তার সূত্রে চেক জাতীয়তাবাদীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। পরে ব্রেজনেভ জমানায় আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
চেকোস্লোভাকিয়ার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য ডঃ অটো সিক-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন চেক রাষ্ট্র প্রধান আলেকজাণ্ডার ডুবচেক এক নবসংস্কার পরিকল্পনা (প্রাগ-বসন্ত) পেশ করেন (১৯৬৮, এপ্রিল)। তাতে ব্যক্তিতান্ত্রিকতার বদলে গণতন্ত্রীকরণ, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ, রাজবন্দীদের মুক্তি, মুদ্রা যন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধান ব্রেজনেভ চেকোস্লাভাকিয়ার সোভিয়েত কর্তৃত্ব হ্রাসের আশঙ্কায় সামরিক দমন-পীড়ন নীতির আশ্রয় নেন। ব্যাপক রক্তপাতের মাধ্যমে চেক বিদ্রোহ দমন করা
হয় (১৯৬৮, আগস্ট)।
যুগোস্লোভিয়া:
যুগোস্লোভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটোর সঙ্গে সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধান স্ট্যালিনের তিক্ত সম্পর্কের জন্য কমিনফর্ম (Cominform) থেকে যুগোস্লোভিয়াকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু ক্রুশ্চেভ বহুকেন্দ্রিক নীতি সমর্থন করে কমিনফর্ম ভেঙে দেন। যুগোস্লোভিয়ার
সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করেন।
উপসংহার
এভাবে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, প্রভৃতি দেশে স্ট্যালিন জমানার যে কর্তৃত্বমূলক প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার অবসান ঘটে। সূচিত হয় এক নতুন যুগ। পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে, পূর্ব ইউরোপে, কমিউনিস্ট দুনিয়ায়, বিশ্ব রাজনীতিতে, যা ছিল হয় তো আগামী দিনের ইঙ্গিত।