আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো। ১২১০ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীর প্রথম সুলতান কুতুব-উদ্দিনের আকস্মিক ভাবে মৃত্যু হইলে, ভারতে মুসলমান আধিপত্যে এক সঙ্কটজনক অবস্থা দেখা দেয়।
অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিদ্রোহের ফলে কুতুব-উদ্দিনের রাজ্য ছিন্নভিন্ন হইয়া যাইবার উপক্রম হয়। কিন্তু সামসুদ্দিন ইলতুৎমিসের সাহস, বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার ফলে সেই সঙ্কট কাটিয়া যায় এবং ভারতে মুসলমান রাজ্য স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইলতুৎমিসের প্রথম জীবন ও সিংহাসন লাভ:
1. | নাম | শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ |
2. | জন্মতারিখ | 1150 খ্রীষ্টাব্দ (আনুমানিক) |
3. | জন্মস্থান | বর্তমান আফগানিস্তানে (আনুমানিক) |
4. | প্রথম জীবন | ক্রীতদাস |
5. | রাজত্বকাল | 1211-1236 খ্রীষ্টাব্দ |
6. | মৃত্যু | 1236 খ্রীষ্টাব্দ |
7. | উত্তরাধিকার | কন্যা রাজিয়া সুলতানা |
প্রথম জীবনে ক্রীতদাস কুতব-উদ্দিনের জামাতা
সামসুদ্দিন ইলতুৎমিস ছিলেন জাতিতে ইচবরী তুর্কী, এবং এক তুর্কী অভিজাত পরিবারের সন্তান। কিন্তু পারিবারিক কলহের ফলে তিনি ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রীত হইয়া যান।
নানা ভাগ্য-বিপর্যয়ের পর তিনি কুতুব-উদ্দিনের সুনজরে পড়েন এবং অল্পকালের মধ্যে আপন প্রতিভাবলে তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর ও সেনাপতিত্বে উন্নীত হন। কুতুব-উদ্দিন তাঁহাকে আপন জামাতারূপে বরণ করিয়া বদাউনের শাসন-কর্তা নিযুক্ত করেন।
আমীর- গণের সমর্থনে সিংহাসনে আরোহণ
দিল্লীর আমীর ওমরাহগণের অধিকাংশই, ইলতুৎমিসের দক্ষতা ও সমরকুশলতার জন্য তাহার উপর শ্রদ্ধাশীল হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং কুতুব- উদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁহারা তাঁহাকেই দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান।
তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া সসৈন্যে দিল্লীতে উপস্থিত হইলেন। আমীর- গণের একটি অংশ আরাম শাহের দাবি সমর্থন করিলে তিনি তাহাদিগকে পরাজিত করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন।
রাজ্যের সঙ্কট ও ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব:
মুলতানের নাসিরুদ্দিন ও গজনীর তাজউদ্দিন
সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই ইলতুৎমিস নানা সঙ্কটজনক অবস্থার সম্মুখীন হইলেন। দিল্লীর আমীরগণের বিরুদ্ধাচরণ নির্মূল হইলেও মুলতানের শাসনকর্তা নাসিরুদ্দিন কাবাচা নিজেকে স্বাধীন বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং পাঞ্জাব দখল করিবার জন্য সচেষ্ট হইলেন। অপরদিকে গজনীর তাজউদ্দিন ইলদিজ মহম্মদ ঘুরীর ভারতত্ত্ব সাম্রাজ্যের উপর অধিকার দাবি করিয়া পাঞ্জাব অধিকার করিতে প্রবৃত্ত হন।
বাংলা: হিন্দুরাজগণ
বাংলার আলী মর্দান খিলজী স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করিলেন । রণথত্তোর ও গোয়ালিয়রের হিন্দু রাজগণও সুযোগ বুঝিয়া তাঁহাদের পূর্ব স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিলেন । সুতরাং সমস্ত দিক হইতে ইলতুৎমিস এক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হইলেন এবং ভারতে মুসলমান আধিপত্যের সংহতি বিচ্ছিন্ন হইবার উপক্রম হইল।
তাজউদ্দিন ও নাসিরুদ্দিন পরাজিত বাংলা অধিকার
কিন্তু সমরকুশলী ইলতুৎমিস অত্যন্ত সাহস ও তৎপরতার সহিত এই অবস্থার সম্মুখীন হইলেন। ১২১৬ খ্রীষ্টাব্দে তরাইনের নিকট এক যুদ্ধে তিনি তাজউদ্দিন ইলদিজকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও বন্দী করেন।
১২১৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি নাসিরুদ্দিন কাবাচাকে পরাজিত করিয়া পাঞ্জাব হইতে বিতাড়িত করেন। ১২২৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বাংলার বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং পর পর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করিয়া ১২৩১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাকে সম্পূর্ণভাবে দিল্লীর অধিকারভুক্ত করিয়া লন।
সিন্ধুদেশ জয় রণথম্ভোর, গোয়ালিয়র, উজ্জয়িনী
১২২৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সিন্ধু দেশও জয় করেন। অতঃপর রণথম্ভোর, গোয়ালিয়র, মালব প্রভৃতি অঞ্চল ইলতুৎমিস কর্তৃক অধিকৃত হয়। তিনি উজ্জয়িনী অধিকার করিয়া মহাকালের মন্দিরটি ধ্বংস করেন। সুতরাং উত্তর ভারতের এক বিস্তৃত অংশে ইলতুৎমিসের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভারতে মুসলমান রাজ্য স্থায়িভাবে স্থাপিত হয় ৷
চিঙ্গিজ খাঁ-এর সিন্ধু উপত্যকায় উপস্থিতি
তাঁহার রাজত্ব কালে ১২২১ খ্রীষ্টাব্দে বিখ্যাত মোঙ্গল নেতা চিঙ্গিজ খাঁ (Chingiz Khan) খারজম্ বা থিবার শাহ জালাল-উদ্দিনের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া সিন্ধু উপত্যকায় আসিয়া উপস্থিত হন।
জালাল- উদ্দিন সাময়িকভাবে দিল্লীতে অবস্থানের অনুমতি প্রার্থনা করিলে ইলতুৎমিস তাঁহাকে সেই অনুমতি দিতে অস্বীকার করিয়া তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করেন। অতঃপর জালাল-উদ্দিন সিন্ধুদেশের বহুস্থান বিধ্বস্ত করিয়া পারস্য দেশে পলায়ন করেন।
জালালউদ্দিনকে আশ্রয় না দিবার কারণ
কিছুকালের মধ্যে মোঙ্গল বাহিনীও ভারত ত্যাগ করিলে দেশ একটা বিধ্বংসকারী আক্রমণ হইতে রক্ষা পায় । ইহাতে ইলতুৎমিসের বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায় ৷
কেবলমাত্র তিনি যে চিঙ্গিজ খাঁ-র শত্রুতা পরিহার করিতে চাহিয়াছিলেন তাহাই নয়; দিল্লীতে জালাল উদ্দিনের উপস্থিতি দিল্লীর তুর্কী আমীর- ওমরাহদের মধ্যে নানারূপ বিভেদ সৃষ্টি করিতে পারিত এবং ফলে ইলতুৎমিসের প্রতি তাহাদের আনুগত্য হ্রাস পাইত। জালাল-উদ্দিনের প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করিয়া তাই তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছিলেন।
খালিফার অনুমোদনের গুরুত্ব
তিনি ১২২৯ খ্রীষ্টাব্দে বাগদাদে খালিফার নিকট হইতে অনুমোদন লাভ করেন এবং ‘সুলতান-ই-আজম’ (Great Sultan) উপাধিতে ভূষিত হন। ইহাতে তাঁহার ও তাঁহার সাম্রাজ্যের গৌরব বৃদ্ধি পায় । এই সময় হইতেই দেশে আরবী মুদ্রা ও রূপার টাকার প্রচলন হয়। ১২৩৬ খ্রীষ্টাব্দে ইলতুৎমিসের মৃত্যু হয়।
🔥আরও পড়ুনঃ-
ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব (His Achievements and Estimate):
রণকুশল যোদ্ধা ও সুদক্ষ সেনাপতি
সামান্য ক্রীতদাসের অবস্থা হইতে দিল্লীর সুলতান পদে উন্নীত হওয়ার মধ্য দিয়াই ইলতুৎমিসের দক্ষতা ও প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ৷ তিনি ছিলেন রণকুশল যোদ্ধা ও সুদক্ষ সেনাপতি।
সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছিলেন। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কার্যকলাপ এবং প্রদেশ ও রাজ্যগুলির স্বাধীনতার প্রয়াস ভারতে মুসলমান আধিপত্যের অস্তিত্বই বিপন্ন করিয়া তুলিয়াছিল।
মানসিক দৃঢ়তা ও কূটনীতিজ্ঞান সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা ও গৌরব বৃদ্ধি
কিন্তু অভূতপূর্ব দৃঢ়তা ও কুটনীতিজ্ঞানের পরিচয় দিয়া তিনি সকল সমস্যারই সমাধান করেন এবং ভারতে স্থলতানি সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করেন ও তার পরিধি বিস্তার করেন। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সহিত খালিফার অনুমোদন সংগ্রহ করিয়া তিনি নিজের ও তাঁহার সাম্রাজ্যের গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছিলেন।
বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা
খারজম বা খিবার শাহ জালাল উদ্দিনকে আশ্রয় না দিয়া তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছিলেন। ইহাতে কেবলমাত্র যে এই শিশু রাষ্ট্রটি চিঙ্গিজ খাঁর আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইয়াছিল তাহাই নয়, দিল্লীর তুর্কী আমীর-দের মধ্যে সম্ভাব্য বিভেদের পথও পরিহার করা গিয়াছিল।
ইতিহাসে ইলতুৎমিসের স্থান দাসবংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান
সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মহম্মদ ঘুরী ও কুতুব-উদ্দিনের বিজিত সাম্রাজ্যের সংহতি ও দৃঢ়তা আনিয়াছিলেন ইলতুৎমিস । এইজন্য তাঁহাকেই বলা যায় দিল্লীর দাস বংশের প্রকৃত স্থাপয়িতা।
দিল্লীর তুর্কী শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করিয়া তিনি ভারতে মুসলমান শাসন স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। ইহার সহিত তাঁহার সামরিক প্রতিভা, দূরদর্শিতা, শাসনদক্ষতা প্রভৃতি বিচার করিয়া অনেক ঐতিহাসিক তাঁহাকে ‘দাশ-বংশের’সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।
শাসন ও ধর্মব্যাপারে সাহিত্য ও শিল্পে
তাঁহার সময়েই এ দেশে সর্বপ্রথম আরবীয় মুদ্রা ও রূপার টাকা প্রচলিত হয়। তবে শাসন ব্যাপারে তিনি নূতন কোন দক্ষতার পরিচয় রাখিয়া যান নাই, দেশের প্রচলিত ব্যবস্থাকেই বজায় রাখিয়াছিলেন।
ধর্ম সম্বন্ধে তিনি ছিলেন গোঁড়া এবং পরধর্ম সম্পর্কে কোন- রূপ উদারভাব তিনি পোষণ করিতেন না। তবে তিনি সাহিত্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বহু বিদ্বান ও গুণী ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়া তিনি দিল্লীকে ইসলাম সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করিয়াছিলেন।
সমসামরিক ঐতিহাসিক ও লিপি
তাঁহারই প্রচেষ্টায় দিল্লীর কুতুব-মিনারের নির্মাণ কার্য সমাপ্ত হয়। ইহা তাঁহার শিল্পানুরাগের অন্যতম নিদর্শন । ঐতিহাসিক মিনহাজ-উল-সিরাজ তাঁহার বদান্যতা, ধর্ম- প্রবণতা ও শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া গিয়াছেন।
“Never was a Sovereign of such exemplary faith and of such kindness and reverence towards recluses devotees, divines and doctors of religion and law.”-Minhaj-ul-Siraj.
সমসাময়িক লিপিতে তাঁহাকে ‘Protector of the lands of God’ এবং ‘the helper of the servants of God’ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে।
উপসংহার
উপরে উল্লেখিত ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব আলোচনা কর প্রশ্নের উত্তর আলোচনার মাধ্যমে আমরা দেখতে পায় ইলতুতমিশের শাসনকালে দিল্লির সালতানাতে সামাজিক সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার এবং ধর্মীয় সহনশীলতা মাধ্যমে একটি উন্নত শাসন ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। তাই ইতিহাসের পাতায় ইলতুৎমিশকে দিল্লির একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক গণ্য করা হয়। তার কৃতিত্বের উপর ভর করে পরবর্তীকালে দিল্লির শাসকরা ভিত্তি স্থাপন করেছিল বলা যায়।
FAQs ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব
প্রশ্ন: ইলতুৎমিস এর মৃত্যুর পর কে সিংহাসনে বসেন?
উত্তর: ইলতুৎমিস এর মৃত্যুর পর তার পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজ অল্প সময়ের জন্য সিংহাসনে আরোহণ করেন।
প্রশ্ন: ইলতুৎমিস এর ছেলের নাম কি?
উত্তর: রুকনউদ্দিন ফিরোজ ছিলেন ইলতুৎমিশ এর ছেলে।
প্রশ্ন: ইলতুৎমিস কবে সিংহাসনে বসেন?
উত্তর: ইলতুৎমিস ১২১১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন।
প্রশ্ন: ইলতুৎমিশের কন্যার নাম কি?
উত্তর: সুলতানা রাজিয়া ছিলেন ইলতুৎমিশের কন্যা।
প্রশ্ন: ইলতুৎমিসের প্রধান সমস্যা কি ছিল?
উত্তর: ইলতুৎমিসের প্রধান সমস্যা ছিল উত্তরাধিকারের সমস্যা।
প্রশ্ন: ইলতুৎমিশের পর কে সিংহাসনে বসেন?
উত্তর: ইলতুৎমিশের পর ১২৩৫ সালে রুকনুদ্দিন ফিরোজ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন।
প্রশ্ন: ইলতুৎমিস কোন বংশের রাজা ছিলেন?
উত্তর: ইলতুৎমিস ছিলেন দাস রাজবংশের রাজা।