এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা মধ্যযুগের ইতিহাসের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি গজনবী ও ঘুরির ভারত আক্রমণ পার্থক্য সম্পর্কে আলোচনা করব। দুই শাসকই তাদের সামরিক অভিযান, শাসনব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখে গেছেন।
তাদের জীবনশৈলী, ভারতে শাসক হিসাবে ক্ষমতালাভ, বিভিন্ন সামরিক অভিযান, এবং শাসন ব্যবস্থা পরীক্ষা করে আমরা তাদের মধ্যে মিল এবং পার্থক্য খুঁজে বের করবো।
গজনবী ও ঘুরির ভারত আক্রমণ পার্থক্য
সুলতান মাহমুদ এবং মুহম্মদ ঘুরী উভয় শাসকই ভারত আক্রমণ করেন। উভয় শাসকই ছিলেন দক্ষ যোদ্ধা, রণকৌশলী, মুসলমান, এবং উভয়ে গজনী থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতকে আক্রমণ করার ঘটনা রয়েছে।
তাদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য থাকলেও তাদের কৃতিত্বের মধ্যে অনেক বৈসাদৃশ্য আমরা দেখতে পায়। গজনীর সুলতান অর্থাৎ শাসক ছিলেন সুলতান মাহমুদ, আর অন্যদিকে মুহম্মদ ঘুরী ছিলেন ভ্রাতা গিয়াসউদ্দিনের অধীন কর্মরত গজনীর শাসক।
অর্থাৎ এখানে উভয়ের পদমর্যাদা আলাদা হবার কারণে, উভয়ের ভারত আক্রমণের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য যেমন- আদর্শগত পার্থক্য, প্রকৃতিগত পার্থক্য, উদ্দেশ্যগত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। নিচে ভারতবর্ষে, সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযান এর মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
গজনবী ও ঘুরির ভারত আক্রমণ
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান
ভারত অভিযান | সাল | প্রধান যুদ্ধ |
প্রথম অভিযান | 1000-1001 | ওয়াহিন্দের যুদ্ধ |
দ্বিতীয় অভিযান | 1008-1009 | পেশোয়ারের যুদ্ধ |
তৃতীয় অভিযান | 1014-1015 | থানেশ্বরের যুদ্ধ |
চতুর্থ অভিযান | 1017-1018 | সোমনাথের যুদ্ধ |
পঞ্চম অভিযান | 1021-1022 | নাহরওয়ানের যুদ্ধ |
ষষ্ঠ অভিযান | 1025-1026 | ভাটিন্ডার যুদ্ধ |
সপ্তম অভিযান | 1026-1027 | সারহিন্দের যুদ্ধ |
মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযান
ভারত অভিযান | সাল | প্রধান যুদ্ধ |
প্রথম অভিযান | 1175-1176 | তরাইনের যুদ্ধ |
দ্বিতীয় অভিযান | 1191-1192 | চান্দাওয়ারের যুদ্ধ |
তৃতীয় অভিযান | 1192-1193 | তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ |
চতুর্থ অভিযান | 1194-1196 | চান্দওয়ারের যুদ্ধ |
পঞ্চম অভিযান | 1197-1198 | ঝিলামের যুদ্ধ |
ষষ্ঠ অভিযান | 1199-1200 | কনৌজের যুদ্ধ |
সপ্তম অভিযান | 1205-1206 | তারাওরির যুদ্ধ |
“সোমনাথ মন্দির: 1026 সালে, হিন্দুদের আরোগ্য দেবতা শিবের উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত সোমনাথ মন্দিরে সুলতান মাহমুদ আক্রমণ করেন। এই মন্দিরটি ধন-ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ ছিল। সুলতান মাহমুদ মন্দিরটি আক্রমণ করে ধন-সম্পদ লুট, মূর্তি ধ্বংস এবং মন্দিরের ব্যাপকভাবে ক্ষতি করে।”
🔥আরও পড়ুনঃ-
অভিযান সমূহের তুলনা (Expeditions Compared):
আদর্শ ও প্রকৃতির মধ্যে মূলগত পার্থক্য
সুলতান মামুদ ছিলেন গজনীর সুলতান, আর মহম্মদ ঘুরী ছিলেন ঘুর রাজ্যের অধীনে গজনীর শাসনকর্তা। ইহার ফলে উভয় পক্ষে সামরিক সুযোগ সুবিধার কিছু পার্থক্য ছিল, কিন্তু এই সুযোগ-সুবিধার পার্থক্য ভিন্ন এই দুইজন আক্রমণকারীর ভারত অভিযানের আদর্শ ও তাহার প্রকৃতির মধ্যেও কতকগুলি মূলগত পার্থক্য ছিল।
মামুদের উদ্দেশ্য ধনরত্ন লুণ্ঠন
প্রথমতঃ, সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের পশ্চাতে মুসলমান আধিপত্য স্থাপনের কোন সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্য ছিল না, তাঁহার অভিযানগুলির মূল প্রেরণা ছিল ভারতের ধনরত্ন লুণ্ঠন।
মহম্মদ ঘুরীর উদ্দেশ্য ভারত জয়
কিন্তু মহম্মদ ঘুরীর অভিযানগুলি আরও উচ্চস্তরের সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হইয়াছিল, তাহা ছিল ভারত জয়ের আকাঙ্ক্ষা । সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে অভিযান পরিচালনা, শিয়ালকোটে দুর্গ নির্মাণ প্রভৃতি তাহার সাক্ষ্য দেয়।
মামুদের ধর্মান্ধতা মহম্মদ ঘুরীর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি
ধর্মান্ধতাও সুলতান মামুদের অভিযান পরিচালনার অন্যতম প্রেরণা ছিল। পৌত্তলিক হিন্দুদের হত্যা করা, মন্দির ধূলিসাৎ করা এবং বিগ্রহাদি ধ্বংস করাই তাহার সাক্ষ্য বহন করে।
কিন্তু ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হইলেও মহম্মদ ঘুরী তাঁহার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিকে ধর্মান্ধতা দ্বারা আচ্ছন্ন হইতে দেন নাই। একমাত্র আজমীঢ়ে ছাড়া আর কোথায়ও তিনি হিন্দু দেব-দেবীর মন্দিরের উপর আক্রমণ করেন নাই ।
ভারতের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ
ভারতের রাজনৈতিক দুর্বলতা উভয়েই লক্ষ্য করিয়াছিলেন। সুলতান মামুদ এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিয়াছিলেন তাঁহার ধনলিপ্সা, ধর্মান্ধতা প্রভৃতি প্রবৃত্তিগুলি চরিতার্থ করিবার জন্য, ধর্মপ্রচার বা স্থায়ী কিছু গড়িবার জন্য নহে; কিন্তু মহম্মদ ঘুরী সেই সুযোগ গ্রহণ করিয়াছিলেন স্থায়িভাবে মুসলমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি রচনা করিবার জন্য, ভবিষ্যৎ ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করিবার জন্য।
মামুদের অভিযানের স্থায়ী ফল
তবে এ কথা সত্য যে, সুলতান মামুদের অভিযান- গুলির দ্বারা ভারতের অর্থনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতা বৃদ্ধি পাইয়াছিল। তাহাই মহম্মদ ঘুরীর অভিযানকে সাফল্য-মণ্ডিত করিয়াছিল, মুসলমান রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করিয়াছিল ।
“মুহাম্মদ ঘুর: মুহাম্মাদ ঘুর ঘোরের মুহাম্মাদ নামেও বেশি পরিচিত ছিলেন, আধুনিককালে বসবাস কারি আফগানিস্তানের ঘুরিদ রাজবংশের একজন শাসক ছিলেন। তিনি সুলতান মাহমুদ পথ অনুসরণ করে ভারত আক্রমণ অব্যাহত রাখেন, তবে তিনি সুলতান মাহমুদের চেয়ে আরও বেশি বিজয় লাভ করেছিলেন।”
চরিত্রের তুলনা (Characters Compared):
যোদ্ধা হিসাবে সুলতান মামুদের শ্রেষ্ঠত্ব
সুলতান মামুদের অভিযানের বিস্তৃতি এবং সামরিক দুর্ধর্ষতার দিক বিচার করিলে মহম্মদ ঘুরীর অভিযান অত্যন্ত অকিঞ্চিতকর মনে হইবে। সুলতান মামুদ কোন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে কখনও পরাজয় বরণ করেন নাই।
কিন্তু গুজরাটে এবং তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরীকে শোচনীয় পরাজয় বরণ করিতে হইয়াছে । সুতরাং যোদ্ধা হিসাবে সুলতান মামুদ শ্রেষ্ঠ ছিলেন এ কথা সত্য;
মহম্মদ ঘুরীর রাজনীতিজ্ঞান
কিন্তু রাজনীতিজ্ঞানের দিক দিয়া মহম্মদ ঘুরী বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোর অসারতা লক্ষ্য করিয়া ভারত জয় করা সম্ভব বুঝিয়াছিলেন এবং রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি লইয়া দৃঢ় পদক্ষেপে তাঁহার উদ্দেশ্য সাধন করিয়াছিলেন। তাই ভারতবর্ষের মুসলমান শাসনের ইতিহাসে মহম্মদ ঘুরীর দান সুলতান মামুদের দান অপেক্ষা অনেক বেশী ।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মামুদের শ্রেষ্ঠত্ব
তবে এ কথা স্বীকার করিতে হইবে যে সুলতান মামুদ শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করিয়া অক্ষয় কীর্তি অর্জন করিয়া গিয়াছেন । ফিরদৌসী, উত্তী, অলবিরুণী প্রভৃতি খ্যাতনামা কবি, ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক তাঁহার রাজসভা অলঙ্কৃত করিতেন। গজনীর বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগার স্থাপন মামুদের অপূর্ব কীর্তি । কিন্তু এই ক্ষেত্রে মহম্মদ ঘুরীর বিশেষ কোন অবদান নাই ৷
উপসংহার
উপরে উল্লেখিত সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযান এর মধ্যে পার্থক্য আসা করি আপনাদের ভালো লেগেছে। এই ধরনের আরো অন্য তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইট -এর নোটিফিকেশান কে অন করে রাখুন। আমাদের দেওয়া তথ্য ছাড়া আপনাদের সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরী সম্পর্কে আর অন্য কোনো তথ্য জানা থাকলে আপনারা আমাদের কম্যান্ড বক্সতে কম্যান্ড করে জানাতে একদম ভুলবেন না।
FAQs সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযান
প্রশ্ন: মুহাম্মদ ঘোরী ও সুলতান মাহমুদ কি একই?
উত্তর: মুহম্মদ ঘোরি এবং সুলতান মাহমুদ দুজনে আলাদা অঞ্চলে বসবাস করতেন এব তাদের শাসনের সময়কালও আলাদা ছিল।
প্রশ্ন: মুহাম্মদ ঘোরির আক্রমণ ও গজনীর মাহমুদের মধ্যে পার্থক্য?
উত্তর: মাহমুদের উদ্দেশ্য ছিল ধনরত্ন লুণ্ঠন করা আর মহম্মদ ঘুরীর উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে জয় করা।
প্রশ্ন: গজনীর মাহমুদ ও ঘোরির মুহাম্মদের আক্রমণের মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য কি ছিল?
উত্তর: গজনীর মাহমুদ ও ঘোরির মুহাম্মদের আক্রমণের মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য হল- গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে সুলতান মাহমুদ পরাজিত হয়নি কিন্তু মুহম্মদ ঘোরি পরাজিত হয়েছিল।
প্রশ্ন: সুলতান মামুদ কি নামে পরিচিত?
উত্তর: সুলতান মামুদ ছাড়াও ইয়ামিনউদ্দৌলা আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে সবুক্তগিন, মাহমুদ গজনভি ও মাহমুদে জাবুলি এই তিনটি নামে পরিচিত ছিল।
প্রশ্ন: ঘোরি কতবার ভারত আক্রমণ করেন?
উত্তর: ঘোরি তার জীবনাকালে 7 বার ভারত আক্রমণ করেন।
প্রশ্ন: ঘোরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
উত্তর: মুইজ আদ-দ্বীন মুহাম্মদ (ঘোরের মুহম্মদ) ছিলেন ঘোরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা।
প্রশ্ন: 17 বার ভারত আক্রমণ করেন কে?
উত্তর: সুলতান মামুদ তার জীবনাকালে 17 বার ভারত আক্রমণ করেন।
প্রশ্ন: সুলতান মাহমুদ কোন রাজবংশের শাসক ছিলেন?
উত্তর: সুলতান মাহমুদ ছিলেন গজনভিদ রাজবংশের শাসক, যিনি 998 থেকে 1030 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।