প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপকতা এবং ধ্বংসলীলা মানুষকে যুদ্ধের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং শাস্তির জন্য আগ্রহী করে তোলে। তার ফলেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর অনেক প্রচার ও আশা নিয়ে জাতিসংঘ ( League of Nations) নামে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয়।
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতাগণ আশা করেছিলেন যে, তারা এমন এক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করবেন যেখানে যুদ্ধ, পররাজ্য গ্রাস, আক্রমণ অতীতের কাহিনিতে পরিণত হবে। তারা এমন এক নিরাপদ বিশ্ব স্থাপন করবেন, যেখানে রাষ্ট্রগুলি বিশ্বমৈত্রী ও শান্তির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরস্পরকে সাহায্য করবে।
কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই এই মহৎ উদ্দেশ্যে গঠিত প্রতিষ্ঠানটির পরিসমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ধ্বংসলীলা ও গণহত্যার সহযোগিতার আদর্শ চাপা পড়ে যায়। বিভিন্ন কারণে জাতিসংঘ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি।
জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ গুলি আলোচনা করো
বিশ্ব শান্তি রক্ষার লক্ষ্যে গঠিত জাতিসংঘের ব্যর্থতার পিছনে একাধিক কারণ লক্ষণীয়। নিচে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো:
(১) বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির অসহযোগিতা:
যদিও মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন-এর প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, কিন্তু মার্কিন আইনসভা ভার্সাই শান্তিচুক্তি অনুমোদন না করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতি সংঘের সদস্যপদ গ্রহণ করেনি।
সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যোগদান না করায় জাতিসংঘ অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। জাতিসংঘের সম্মিলিত প্রতিরক্ষার আদর্শ এতে পালন করা দুরূহ হয়ে উঠেছিল। শুধু তাই নয়, সোভিয়েত রাশিয়া ও জার্মানিকেও প্রথম দিকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেওয়া হয়নি।
সদস্য হওয়ার কয়েক বছর পর জার্মানি জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করে এবং রাশিয়াকে জাতিসংঘ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাই প্রথম থেকেই জাতিসংঘ তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করে যেতে পারেনি।
🔥আরও পড়ুনঃ-
(২) সাংগঠনিক দুর্বলতা:
জাতিসংঘের সাংগঠনিক দুর্বলতাও এর পতনের অন্যতম কারণ ছিল। জাতিসংঘ বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল। কিন্তু জাপান ছাড়া প্রায় সব সদস্য রাষ্ট্রই ছিল ইউরোপীয়।
তাই এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার মানুষেরা কিংবা উপনিবেশের অধিবাসীরা জাতিসংঘকে কখনোই নিজেদের প্রতিনিধিমূলক প্রতিষ্ঠান বা আশা-আকাঙ্ক্ষার শরিক বলে মনে করেনি।
(৩) সাংবিধানিক দুর্বলতা:
জাতিসংঘের সংবিধানের দুর্বলতা এর পতনের জন্য কম দায়ী ছিল না।
(ক) জাতিসংঘের কোনো নিজস্ব সামরিক বাহিনী ছিল না। ফলে আইনভঙ্গকারী বা আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কোনো শাস্তিদান বা ভীতি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারত না।
শুধু আক্রান্ত রাষ্ট্রকে সহায়তাদানের জন্য কিছু পরামর্শদান করতে পারত মাত্র। তাই অনেক সদস্যরাষ্ট্র জাতিসংঘকে তেমন গুরুত্ব দিতে চাইত না।
(খ) জাতিসংঘ সনদে কয়েকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে যুদ্ধকে বে-আইনি ঘোষণা করা হয়নি। আবার আগ্রাসনকেও নিষিদ্ধ করা হয়নি।
(গ) জাতিসংঘ সমানাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত ছিল না। জাতিসংঘ পরিষদের স্থায়ী সদস্যগণ অস্থায়ী সদস্যদের অপেক্ষা অনেক বেশি অধিকার ভোগ করত।
(৪) সদস্য রাষ্ট্রগুলির আন্তরিকতার অভাব:
জাতিসংঘকে কার্যকরী করে তুলতে সব সদস্য রাষ্ট্রের যে আন্তরিক সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল তা কোনো সদস্য রাষ্ট্রই করেনি। তারা জাতিসংঘের আদর্শকে সমর্থন করা অপেক্ষা নিজেদের জাতীয় স্বার্থরক্ষা ও স্বার্থ বৃদ্ধির ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়।
কোনো সদস্য রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থে আঘাত লাগলেই সেই রাষ্ট্র জাতিসংঘের সিদ্ধান্তকে অমান্য করতে দ্বিধাবোধ করত না। সদস্য রাষ্ট্রগুলির আন্তরিকতার অভাব এবং সন্দেহাত্মক মনোভাবই জাতিসংঘের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
(৫) বিভিন্ন রাষ্ট্রের আক্রমণাত্মক মনোভাব:
পরিশেষে বলা যায়, জাতিসংঘের আদর্শকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালির আবিসিনিয়া অধিকার,
স্পেনের গৃহযুদ্ধে জার্মানি ও ইতালির সক্রিয় হস্তক্ষেপ, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির অস্ট্রিয়া ও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে চেকোস্লোভাকিয়া দখল এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণ,
সোভিয়েত রাশিয়ার ফিনল্যান্ড আক্রমণ এবং তা প্রতিহত করতে জাতিসংঘের অক্ষমতা জাতিসংঘের সমাধি রচনা করে। অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহাপ্রলয়ে জাতিসংঘের সমাধি সম্পূর্ণ হয় ।
জাতিসংঘের অবদান:
নানাবিধ কারণের ফলে জাতিসংঘের সমাধি ঘটলেও এর অবদান যে একেবারে ছিল না, তা বলা ঠিক হবে না। আসলে জাতিসংঘের প্রকৃত ক্ষমতা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ।
এই সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেই জাতিসংঘ তুরস্ক ও ইরাকের বিবাদ, গ্রীস ও বুলগেরিয়ার বিবাদ, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের অকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বিরোধ, পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার দ্বন্দ্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাতিসংঘ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল বলেই আসন্ন কয়েকটি যুদ্ধের হাত থেকে ওই সব দেশ রক্ষা পেয়েছিল।
তাই বলা যায়, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত জাতিসংঘের শান্তি রক্ষার কাজ যথেষ্ট প্রশংসনীয় ছিল।
তাছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক অনেক জনহিতকর কার্য যেমন— যুদ্ধবন্দি বিনিময়, বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক সাহায্যদান, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিহত করার ব্যবস্থা, দাস প্রথার ন্যায় কিছু সামাজিক দুর্নীতি দূর করার ব্যবস্থা, সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার জন্য বিশেষ চেষ্টা, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ প্রভৃতি কার্যের মাধ্যমে নিজের কৃতিত্ব রেখে গেছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বে বিধ্বস্ত পৃথিবীতে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিবাদের মীমাংসার প্রয়োজন সম্পর্কে মানব সমাজকে সচেতন করে তুলতে সমর্থ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘের অবসান ঘটলেও এর আন্তর্জাতিক উদ্দেশ্য ও আদর্শের প্রভাব স্থায়িত্ব লাভ করছে।
তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পরেই জাতিসংঘের আদর্শেই আবার যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে রাষ্ট্রসংঘ (United Nations) গড়ে তোলা হয়।
জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই যে বর্তমান যুগের নানাবিধ আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান নিহিত আছে, এটা তারই স্বীকৃতি। সুতরাং, জাতীসংঘ সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।