এই আর্টিকেলে আমরা মুঘল সম্রাট আকবরের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। সম্রাট আকবরের শাসনকালকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় বলে চিহ্নিত।
1556 সালে সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে আকবর তার উদ্ভাবনী নীতিগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।
তিনি পুরাতন ও নতুন রীতিনীতির সংমিশ্রনে একটি কেন্দ্রীভূত স্বৈরতান্ত্রিক সরকার গঠন করেছিলেন, যেখানে সর্বত্ব একই আইন, একই বিচার ব্যবস্থা এবং একই রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসন ব্যবস্থা। Akbars Regime in Bengali
আকবর ছিলেন একাধারে বীর যোদ্ধা, রণকৌশলী, ধর্মীয় সহনশীল, সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক এবং প্রতিভাবান শাসক । সম্রাট আকবর তার সাম্রাজ্যেকে মজবুত ও শক্তিশালী গড়ে তুলতে তিনি তার সভায় বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমাগম ঘটিয়ে ছিলেন।
মন্ত্রীর নাম | পদমর্যাদা |
বৈরাম খান | প্রধান মন্ত্রী |
টোডর মাল | অর্থমন্ত্রী |
রাজা মান সিং | সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক |
আবুল ফজল | প্রধান উপদেষ্টা ও ইতিহাসবিদ |
ফয়েজী | দরবারের কবি ও সাহিত্য উপদেষ্টা |
বীরবল | দরবারী এবং উপদেষ্টা |
তানসেন | গায়ক এবং সংগীত বিশেষজ্ঞ |
রাজা টোডর মাল | রাজস্ব মন্ত্রী |
মির্জা আজিজ কোকা | সেনাপতি ও উপদেষ্টা |
শাইখ আবু আল ফজল রহ | উপদেষ্টা ও ইতিহাসবিদ |
আব্দুল রহিম খান-ই-খানা | সেনাপতি ও কবি |
আজিম খান | বাংলা ও বিহারের রাজ্যপাল |
মান সিং আই | মহান রাজপুত এবং সর্বাধিনায়ক |
আব্দুল রহিম খান-ই-খানা | সেনাপতি ও কবি |
রাজা ভগবন্ত দাস | রাজপুত সম্মানিত এবং সেনাপতি |
আবুল মালী | রাজকীয় নির্মাতা |
শাসক হিসাবে প্রতিভার পরিচয়
মোগল সম্রাট আকবর যে কেবলমাত্র যুদ্ধ পরিকল্পনা ও যুদ্ধ জয়েই আপন পারদর্শিতা এবং প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন তাহা নহে, তিনি শাসন- ক্ষেত্রেও তাঁহার অসামান্য প্রতিভা ও সংগঠনী শক্তির পরিচয় দিয়া গিয়াছেন ।
তাঁহারই দ্বারা বিজিত বিশাল সাম্রাজ্যে একটি সুষ্ঠু, সুদক্ষ ও উৎকৃষ্ট শাসন প্রণালী সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক যথেষ্ট প্রশংসিত হইয়াছে ।
প্রজামঙ্গলকামী শাসনব্যবস্থা
পরবর্তী মোগল সম্রাটগণ আকবরের শাসনব্যবস্থাকেই মূলতঃ ভিত্তি করিয়া দেশ শাসন করিয়া গিয়াছেন। এমন কি পরবর্তীকালে ইংরাজ শাসকগণও
তাঁহার শাসননীতিকে অনেকাংশে গ্রহণ করিয়াছিলেন। “From the time of Warren Hastings the newly constituted Anglo-Indian authorities began to grope their way back to the institutions of Akbar”. -Dr. Smith.
আকবর তাঁহার শাসনব্যবস্থাকে জনসাধারণের সমর্থনের ভিত্তিতে গড়িয়া তুলিবার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। উদারতা, ধর্মসহিষ্ণুতা ও প্রজার মঙ্গল সাধনই তাঁহার শাসননীতির মূলমন্ত্র ছিল।
সম্রাট ও কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা (Emperor and the Central Government):
সম্রাটের ক্ষমতা
শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং; আইনতঃ তিনি ছিলেন সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ছিলেন সামরিক ও বে-সামরিক সমস্ত বিভাগের সর্বোচ্চ অধিনায়ক। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছাচারী হইলেও দায়িত্বহীন ভাবে দেশ শাসন করিতেন না প্রজার কল্যাণ সাধনের কামনা দ্বারাই তাঁহার শাসননীতি নির্ধারিত হইত।
তিনি জ্ঞানী ও গুণীর সহিত পরামর্শক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সমূহ গ্রহণ করিতে অভ্যস্ত ছিলেন। এইজন্য তিনি নিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করিতেন এবং প্রতিদিন তিনবার রাজসভার অধিবেশনে উপবেশন করিতেন ।
উলেমাদের প্রভাব হইতে নিজেকে মুক্ত রাখিয়া তিনি জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলের প্রতি সম-ব্যবহার করিবার জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন ।
বিভিন্ন বিভাগ ও ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী
শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আকবর কতকগুলি বিভাগের সৃষ্টি করিয়াছিলেন এবং কয়েকজন মন্ত্রীর উপর এই সমস্ত বিভাগের দায়িত্ব অর্পিত ছিল।
- (ক) মন্ত্রিগণের মধ্যে প্রধান ছিলেন ‘ভকিল’ বা ‘ওয়াজীর’।
- (খ) রাজস্ব এবং আয়-ব্যয় সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যভার ন্যস্ত থাকিত অর্থমন্ত্রী ‘দেওয়ানের’ উপর ।
- (গ) ‘মীর-বক্সী’ ছিলেন সামরিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত রাজকর্মচারী।
- (খ) ‘মীর সামান’ ছিলেন সম্রাটের গৃহ পরিচালনার এবং রাজ-কারখানার ভারপ্রাপ্ত উচ্চ রাজকর্মচারী।
- (ঙ) ‘সদর-উস-সুদুর’ ছিলেন ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারটি এবং বিচার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ কর্মচারী।
উচ্চ রাজকর্মচারীগণের ক্ষমতা
ইহারা ছাড়াও আরো বহুসংখ্যক উচ্চ রাজকর্মচারী দ্বারা আকবর কেন্দ্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা করিতেন। এই সমস্ত মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীগণকে মোগল সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ মনে করা হইলেও প্রকৃত ক্ষমতা ছিল সম্রাটের হস্তেই।
“The ministers were the four pillars of the empire, but not like the symbolical pillars of the Turkish empire which held the tent, but pillars like those of the Taj which do not support the structure but add its to dignity, majesty and beauty.”-Abul Fazl.
প্রাদেশিক শাসন (Provincial Administration):
প্রদেশের শাসনকর্তা সুবাদার
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য আকবর জায়গীর প্রথা উঠাইয়া দিয়া সমগ্র সাম্রাজ্যকে ১৫টি ‘সুবা’ বা প্রদেশে বিভক্ত করিয়াছিলেন। এই সমস্ত প্রদেশগুলির শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীয় শাসনের অনুরূপ ছিল।
প্রদেশগুলির শাসনকর্তা ‘সুবাদার’ ছিলেন সম্রাটের প্রতিনিধি। সম্রাটের পক্ষ হইতে তিনি প্রদেশের সামরিক ও বেসামরিক সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং স্থানীয় সৈন্যবাহিনীর তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ অধিনায়ক।
দেওয়ানের ভূমিকা
কিন্তু প্রদেশের রাজস্ব আদায়ের এবং আয়-ব্যয় সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ছিলেন ‘দেওয়ান’; তিনি সরাসরি সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হইতেন এবং সুবাদারের অধীনতা হইতে মুক্ত ছিলেন।
দেওয়ান ও সুবাদারের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করিয়া দিয়া এবং তাহাদিগকে ঘন ঘন বদলীর ব্যবস্থা করিয়া সম্রাট প্রদেশগুলির উপর নিজ আধিপত্য বজায় রাখিতেন।
ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ‘সদর-উদ্-সুদুর,’ বিচার বিভাগের ‘কাজী’, রাজস্ব- বিভাগের ‘আমিল’ প্রভৃতি রাজ কর্মচারীগণের সাহায্যে প্রদেশিক শাসনকার্য পরিচালিত হইত ৷
সরকার, পরগণা, শহর ও গ্রাম:
ফৌজদারের দায়িত্ব গ্রামাঞ্চলের শাসন
প্রদেশগুলি ছিল কতকগুলি সরকারে বিভক্ত এবং সরকারের শান্তিরক্ষার ভার ছিল ‘ফৌজদার‘-এর উপর। প্রয়োজনমত তিনি সুবাদারকে ফৌজ দিয়া সাহায্য করিতেন। সরকারগুলি ‘পরগণা’ ও মহলে বিভক্ত ছিল।
গ্রামাঞ্চলে অবশ্য শাস্তি রক্ষার ভার চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী গ্রাম্য মোড়লের উপরই ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছিল । এ অঞ্চলে কনুনগো, মুকাদ্দম, পাটোয়ারী প্রভৃতি কর্মচারীগণ বিভিন্ন বিভাগের কার্য পরিচালনা করিতেন ।
শহর অঞ্চলের শাস্তি রক্ষার ভার ছিল ‘কটোয়ালের’ উপর। নাগরিকদের ধন ও প্রাণের নিরাপত্তা বিধানই ছিল কটোয়ালের প্রধান কর্তব্য ।
🔥আরও পড়ুনঃ-
বিচার ব্যবস্থা (Judiciary System):
সর্বোচ্চ বিচারক সম্রাট কাজী ও ‘শরিয়ৎ’
বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সম্রাট স্বয়ং। তিনি ছিলেন সমস্ত আইনের উৎস এবং সর্বোচ্চ আদালত। ‘কাজী’গণ ছিলেন বিভিন্ন অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত বিচারক; তিনি ‘শারিয়ৎ’ বা ইসলামীয় আইন, অনুসারে বিচার করিতেন।
তিনি ‘মুফতি’ ও ‘মীর-ই-আদলগণের’ সাহায্যে বিচার কার্য নির্বাহ করিতেন । তবে রাজনৈতিক মামলার বিচার সুবাদার এবং ধর্মসংক্রান্ত সমস্যার বিচার ‘সদর-উদ্-সুদুরগণই” নির্বাহ করিতেন । দেওয়ানী মোকদ্দমার বিচার অবশ্য দেওয়ানের হাতেই ন্যস্ত থাকিত।
গ্রাম্য পঞ্চায়েৎ ন্যায় ও সততার নীতি
গ্রামাঞ্চলে গ্রাম্য পঞ্চায়েৎ দ্বারাই বিচারকার্যাদি নির্বাহ হইত। আকবরের আমলে কোন প্রকার লিখিত আইন-কানুন ছিল না । বিচারকগণ কোরাণের নির্দেশ এবং ইসলামীয় রীতি-নীতির উপর নির্ভর করিয়াই বিচার কার্য সম্পন্ন করিতেন।
তবে এ কথা সত্য যে আকবর বিচার কার্যে ন্যায়, সততা ও ‘আইনের চক্ষে সকলে সমান’ এই সকল নীতি অনুসরণ করিতে সর্বদা সচেষ্ট থাকিতেন। সেই সময়ের খ্রীষ্টধর্মযাজকগণ আকবরের নিরপেক্ষ বিচার কার্যের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন।
ন্যায়-বিচারের বিধান হইতে তিনি নিজেকেও রেহাই দিতেন না। “If I were guilty of an unjust act I would rise in judgement against myself.”- Akbar.
রাজস্ব নীতি (Revenue System):
রাজা টোডরমলের দান জমির উৎপাদিকা শক্তির ভিত্তিতে রাজস্ব
আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত রাজস্ব- নীতি ঐতিহাসিকগণের নিকট উচ্চ প্রশংসা লাভ করিয়াছে। তাঁহার রাজত্বের প্রথম দিকে রাজস্ব সংক্রান্ত কয়েকটি পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা গৃহীত হইয়াছিল।
কিন্তু ১৫০২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা টোডর- মলকে ‘দেওয়ান-ই-আসরফ”-এর পদে নিযুক্ত করিয়া আকবর স্থায়ী সংস্কার সাধনের ব্যবস্থা করিলেন। টোডরমলের রাজস্ব-সংস্কারের মূল নীতি ছিল জমির উৎপাদিকা শক্তির ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণ করা।
তিন প্রকার রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন
টোডরমলের রাজস্ব-সংস্কারের পর আকবরের সাম্রাজ্যে তিন প্রকার রাজস্ব-ব্যবস্থা অবলম্বিত হইয়াছিল—গাল্লাবক্স, জাবৎ ও নসক্ । ‘গাল্লারস্’ নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক প্রকার শস্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ রাজস্ব রূপে গৃহীত হইত। এই ব্যবস্থা নিম্ন-সিন্ধু, কাবুল ও কাশ্মীরে প্রচলিত ছিল । ‘জাবাৎ’ ব্যবস্থা অনুযায়ী শস্যের পরিবর্তে নগদ টাকা রাজস্ব হিসাবে ধার্য হইত এবং জমির উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদনের ভিত্তিতে এই টাকার পরিমাণ নির্ধারিত হইত।
সকল জমি জরিপ ও চারি শ্রেণীতে বিভক্ত
এই ব্যবস্থার প্রথমে সকল জমি জরিপ করিয়া উহাদের চাষ আবাদের কাল অনুসারে ‘পোলজ’ (যে জমি প্রতি বৎসর চাষ হয়), ‘পরাউতি’ (যে জমি ২১ বৎসর অন্তর চাষ হয়), ‘চাচর’ (যে সকল জমির চাষ ৩/৪ বৎসর অন্তর করা হয়), ‘বানজার’ (যে সকল জমি ৫ বৎসরের অধিক পতিত পড়িয়া থাকে) – এই চারি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হইত।
গড়-উৎপাদনের এক- তৃতীয়াংশ রাজকর
এই এক একটি শ্রেণীর জমির গড় উৎপাদন শক্তি নির্ণয় করিয়া তাহার এক তৃতীয়াংশ রাজস্বরূপে ধার্য করা হইত। কৃষকগণ শস্ত্রে অথবা নগদ মূল্যে রাজস্ব জমা দিতে পারিত।
রাজস্ব-ব্যবস্থা ছিল ‘রায়তওয়ারী’ অর্থাৎ রাজস্ব ব্যাপারে সরকারের সহিত কৃষকদের সম্পর্ক ছিল প্রত্যক্ষ। এই ব্যবস্থা গুজরাট, মালব, রাজপুতানার কিছু অংশে এবং মুলতান হইতে বিহার পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলে প্রবর্তিত হইয়াছিল।
‘রায়তওয়ারী’ ব্যবস্থা কৃষকগণের সুযোগ সুবিধা
ভালভাবে জমি জরিপ করিয়া খাজনা নির্দিষ্ট করিয়া দিবার কলে প্রজাগণের সুবিধাই হইল। সাধারণতঃ যে বৎসর জমির চাষ হইত না, বা ফসল ভাল হইত না সেই বৎসর খাজনা মুকুব করা হইত ৷
তাহাছাড়া, সরকারের সহিত প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ফলে জমিদার বা রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীগণের অত্যাচারের হাত হইতে প্রজাগণ রক্ষা পাইয়াছিল ।
এই ব্যবস্থার জন্য টোডরমল ঐতিহাসিকগণের প্রশংসার পাত্র হইয়া আছেন । “Todar Mall was the ablest and the most upright of the great imperial officers.”- Dr. Smith.
বাংলাদেশে ‘নসক্’ ব্যবস্থা
নসক্ ব্যবস্থা একমাত্র বাংলাদেশেই প্রচলিত ছিল এবং পরবর্তীকালের জমিদারী ব্যবস্থার সহিত ইহার অনেকটা সাদৃশ্য আছে। এই অঞ্চলে মোটামুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করিয়া রাজস্ব স্থির করিয়া দেওয়া হইয়াছিল।
বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করিবার কারণ আবুল ফজল তাঁহার “আইন-ই আকবরীতে” উল্লেখ করিয়াছেন। “It is not customary in this Suba (Bengal) for the husband- men and government to divide the crop. Grain is always cheap and the produce of the land is determined by Nasag.” -Abul Fazal (Vide Ain-i-Akbari)
মনসবদারী প্রথা (Mansabdari System):
জায়গীর ব্যবস্থার পরিবর্তে মনসবদারী
মনসবদারী প্রথা ছিল আকবরের শাসনব্যবস্থার অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি জায়গীর প্রথা সম্পূর্ণ উঠাইয়া দিয়া এই প্রথার প্রচলন করেন। ‘মনসব’ কথাটির অর্থ হইল পদমর্যাদা। সাধারণতঃ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীগণকে ‘মনসবদার’ বলিয়া অভিহিত করা হইত, আর নিম্নপদস্থ কর্মচারীগণকে বলা হইত ‘রোজিন্দার’।
সামরিক ভিত্তিতে তেত্রিশটি শ্রেণী
মোগল আমলে সামরিক ও বে-সামরিক শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি হইয়া উঠিয়াছিল এই মনসবদারী প্রথা। উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীগণকে সামরিক ভিত্তিতে শ্রেণীবিভক্ত করা হইত।
তাঁহারা ১০টি সৈন্যের অধিনায়ক হইতে ৫০০০ সৈন্যের অধিনায়ক পর্যন্ত তেত্রিশটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। রাজপুত্রেরা দশহাজারী, আটহাজারী ও সাতহাজারী এই তিনটি সর্বোচ্চ ‘মনসবদারী’ পাইতেন ।
মনসবদারগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য
মনসবদারগণ তাঁহাদের পর্যায় অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্যসহ সম্রাটের সহিত যুদ্ধে যোগদান করিতেন। তাঁহারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন পাইতেন। মনুসবদারী উত্তরাধিকারী সূত্রে লাভ করা যাইত না, সম্রাটের নিকট হইতে পাইতে হইত। মনসবদারগণ বে-সামরিক কর্তব্য পালনেও বাধ্য থাকিতেন। এইখানেই আকবরের শাসনব্যবস্থার সামরিক চরিত্র দৃষ্ট হয়।
সামরিক ব্যবস্থা (Military System):
চারিটি শ্রেণী
সাম্রাজ্য বিস্তার ও সাম্রাজ্য রক্ষার প্রয়োজনে অকবরকে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করিতে হইয়াছিল। তাঁহার সৈন্যবাহিনী পদাতিক, অশ্বারোহী, গোলন্দাজ ও নৌ-বাহিনী এই চারিশ্রেণীতে বিভক্ত ছিল ।
ইহাদের মধ্যে অশ্বরোহী বিভাগ ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও সৈন্যবাহিনীর মেরুদণ্ডস্বরূপ। অশ্বারোহীগণ মনসবদার কর্তৃক নিযুক্ত হইত এবং তাঁহারই নিকট হইতে বেতন পাইত।
গোলন্দাজ বাহিনীতে বেশিরভাগ পর্তুগীজ ও বিদেশীগণকে লওয়া হইত, কারণ মোগলগণ এ ব্যাপারে বিশেষ পারদর্শী ছিল না বলিয়া মনে হয় ।
নৌ-বাহিনীর অবস্থা
আকবর প্রথমদিকে নৌ-বাহিনীর উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না; কিন্তু পরে মগ ও পর্তুগীজদের দৌরাত্ম ও অত্যাচার হইতে উপকূলবর্তী দেশ সমূহকে রক্ষা করিবার জন্য তিনি নৌ-বাহিনী গঠন করিতে বাধ্য হন; তাহাও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। নৌ-বাহিনীতে তাঁহাকে কিছু ইংরাজ ওলন্দাজ নাবিক লইতে করিতে হইয়াছিল । আকবরের সৈন্যবাহিনীতে কিছু সংখ্যক রণহস্তীও ছিল।
স্থায়ী সৈন্যদলের প্রশ্ন
আকবরের সৈন্যবাহিনী বিভিন্ন দেশ ও জাতির লোক দ্বারা গঠিত হইয়াছিল; সুতরাং ইহাকে কোনরূপে জাতীয় বাহিনী বলা যায় না। আকবরের কোন স্থায়ী সৈন্যদল ছিল কিনা, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। স্মিথের মতে আকবরের এরূপ কোন সৈন্যদল ছিল না।
ব্লকম্যান (Blockman) বলেন যে মাত্র ২৫,০০০ সৈনিক সামরিক পেশার জন্য বৃত্তি পাইত। কিন্তু সমসাময়িক খ্রীষ্টান ধর্মযাজকদের মতে কাবুল অভিযানের সময় আকবর ৪৫,০০০ হাজার অশ্বারোহী এবং ৫০০০ হাজার রণ-হস্তী ব্যবহার করিয়াছিলেন।
সামরিক ব্যবস্থার ত্রুটি
কিন্তু ইহা সত্ত্বেও ঐতিহাসিকগণ আকবরের সামরিক ব্যবস্থার কতকগুলি ত্রুটি লক্ষ্য করিয়াছেন। প্রথমতঃ, যুদ্ধ পরিচালনার ভার দুইজন সেনাপতির উপর ন্যস্ত করার নীতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মঙ্গলজনক হয় নাই ।
দ্বিতীয়তঃ, নৌ-বাহিনীর উপর গুরুত্ব আরোপ না করা আকবরের অদূরদর্শিতারই পরিচায়ক। তৃতীয়তঃ, রাজপুত ও মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ কৌশলের প্রভেদ থাকায় অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হইত।
বাহ্যিক উপকরণের বাহুল্য
চতুর্থতঃ, আকবরের বাহিনীতে রসদ ও যানবাহনের ব্যবস্থাদি যথেষ্ট উন্নত ছিল না। সর্বোপরি, মোগল বাহিনীর গতি ছিল মন্থর; মোগল বাদশাহ সাঙ্গ-পাঙ্গ হারেম এবং নানারূপ বাহ্যিক উপকরণ সহ যুদ্ধযাত্রা করিতে অভ্যস্ত ছিলেন। এই সমস্তর ফলে মোগলবাহিনী পরবর্তী যুগে ক্রমেই দুর্বল হইয়া পড়িতে থাকে ।
শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি (Nature of Administration):
উদার ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা
আকবর প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থার কিছু কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে তিনি তদানীন্তন শাসনব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করিয়া-ছিলেন। শাসনব্যবস্থা প্রণয়নে তিনি অনেক ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি ও উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়াছেন ।
তাঁহার শাসনব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গুণ ছিল উহার ধর্মনিরপেক্ষতা। তাঁহার শাসনব্যবস্থায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই সমান মর্যাদা ও অধিকার লাভ করিত।
শাসনব্যবস্থার দক্ষতা ও স্থায়িত্ব
কিন্তু এই শাসনব্যবস্থা কেবল যে উদার ছিল তাহাই নহে, ইহা দক্ষও ছিল। পরবর্তী মোগল সম্রাটগণ আকবর প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থার ভিত্তিতেই দেশ শাসন করিয়া গিয়াছেন।
পরবর্তী যুগের ইংরাজ শাসকগণও তাহার মধ্যে অনুকরণের অনেককিছু পাইয়াছিলেন। সেইজন্য সমসাময়িক ও বর্তমান প্রায় সকল ঐতিহাসিকই তাঁহার শাসনব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন।
রাজস্ব সংস্কারের গুরুত্ব
রাজস্ব ক্ষেত্রে রাজা টোডরমলের সাহায্যে আকবর যে সকল সংস্কার সাধন করেন তাহা ছিল দীর্ঘস্থায়ী। তিনি অবশ্য পূর্ববর্তী হিন্দুরীতি এক-ষষ্ঠাংশের বদলে শস্যের এক-তৃতীয়াংশ খাজনার হার নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন।
কিন্তু ইহাতে প্রজাসাধারণের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়িয়াছিল মনে করা ভুল হইবে, কারণ তিনি অন্যান্য বহুবিধ কর তুলিয়া দিয়াছিলেন ।
শের শাহের কাছে ঋণী’
তাঁহার শাসনব্যবস্থার জন্য তিনি কাহার কাছে কতখানি ঋণী তাহা লইয়া যথেষ্ট আলোচনা হইয়াছে। অনেকে বলেন যে আকবর শের শাহ, কর্তৃক প্রবর্তিত শাসন পদ্ধতিরই অনুকরণ করিয়াছিলেন মাত্র । এ কথা সত্য যে শের শাহের রাজস্ব ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মুদ্রানীতি আকবরকে বহুলাংশে সাহায্য করিয়াছিল ।
আকবরের মৌলিকতা
ভারতবর্ষে ধর্মনিরপেক্ষ জনসাধারণের সমর্থনপুষ্ট শাসনব্যবস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা শের শাহই অনেকখানি তুলিয়া ধরিয়াছিলেন । আকবর তাহাতে পরিপূর্ণ রূপ দিয়াছেন মাত্র; কিন্তু এ সমস্ত সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে আকবরের শাসনব্যবস্থার অনেক ক্ষেত্রেই তাঁহার মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায় ।
পারস্য দেশীয় শাসন ব্যবহার প্রভাব
তাঁহার প্রবর্তিত মনসবদারী প্রথা পারস্য দেশে বহু পূর্ব হইতেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু তিনি তাহা ভারতীয় পরিবেশের উপযুক্ত করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিলেন, নিজ প্রতিভাবলে তিনি ভারতীয় এবং ‘আরবীয়-পারসিক’ (Perso – Arabic) শাসন পদ্ধতির সমন্বয় সাধন করিয়াছিলেন।
দেশীয় প্রথার ভিত্তি
তিনি এদেশের প্রচলিত রীতি-নীতি, গ্রাম্য স্বায়ত্বশাসন প্রভৃতি চিরাচরিত প্রথার ভত্তিতেই তাঁহার শাসনব্যবস্থা রচনা করিয়াছিলেন। সুতরাং এ কথা সত্য যে তিনি অনেক ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী হিন্দু রীতিনীতি অনুকরণ করিয়াছিলেন।
পূর্বগামীদের অনুসরণ করিয়াও আপন প্রতিভার পরিচয়
কিন্তু এ কথাও স্মরণ রাখা দরকার যে, যে কোন শাসকের পক্ষেই তাঁহার পূর্বগামীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়া স্বাভাবিক। আকবরের ক্ষেত্রেও তাহা প্রযোজ্য। তবুও তিনি সর্বক্ষেত্রে আপন মৌলিক চিন্তাধারা, প্রতিভা সংগঠনীশক্তি ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়া গিয়াছেন ।
আকবরের সংস্কার সমূহ: (Reforms of Akbar):
সামাজিক সংস্কারসমূহ
আকবর যে কেবলমাত্র সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন তাহা নহে, তিনি সমাজের ও রাষ্ট্রের বহুক্ষেত্রে নানা সংস্কার সাধন করিয়া তাঁহার মহত্বের পরিচয় রাখিয়া গিয়াছেন।
(ক) তিনি ১৫৬৩ খ্রীষ্টাব্দে তীর্থকর উঠাইয়া দিয়া হিন্দুদের ধর্মাচরণের একটি বাধা অপসারণ করেন। (খ) ঐ একই সময়ে তিনি জিজিয়া কর উঠাইয়া দিয়া হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কৃত্রিম প্রভেদ দূর করেন।
তীর্থকর ও জিজিয়া কর সতীদাহ, বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথা
(গ) তিনি ‘সতীদাহ’ ও বাল্যবিবাহ প্রথা দূর করিবার জন্যও যথেষ্ট চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। তিনি পণপ্রথা ও বহু বিবাহ প্রথাও রোধ করিবার পক্ষে ছিলেন। (ঘ) যুদ্ধ বন্দীদের ক্রীতদাস করিয়া রাখিবার নীতিও তিনি নিষিদ্ধ করিয়া দেন ।
মুদ্রার সংস্কার সাধন
প্রচলিত মুদ্রার সংস্কার সাধন আকবরের একটি অক্ষয় কীর্তি। প্রথমে তিনি টাকশাল বিভাগে কয়েকটি সংস্কার সাধন করেন। তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশে টাকশাল স্থাপন করিয়া উহা এক একজন উপযুক্ত কর্মচারীর তত্ত্বাবধানে রাখেন; অবশ্য এই সমস্ত টাকশালের উপর কেন্দ্রের কর্তৃ ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত থাকিত।
তিনি রৌপ্য ও স্বর্ণ উভয় প্রকার মুদ্রার প্রচলন করিয়া দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত করিয়া দেন। ” Akbar deserves high credit for the excellence of his extremely barred coinage as regards purity of metal and fulness of weight and artistic execution.”- Dr. Smith.
উপসংহার
উপরে আলোচ্য আকবরের শাসন ব্যবস্থা আলোচনা করে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে আকবরের শাসনকাল মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসেএকটি স্বর্ণযুগ ছিল।
তার দূরদর্শী নেতৃত্ব, প্রশাসনিক সংস্কার, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা মোগল সাম্রাজ্যকে একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছিল।
FAQs
প্রশ্ন: মুঘল সম্রাট আকবরের সন্তান সংখ্যা কয়টি?
উত্তর: সম্রাট আকবরের সন্তান সংখ্যা মোট 11 টি।
প্রশ্ন: আকবরের কতজন স্ত্রী ছিল?
উত্তর: মোগল সম্রাট আকবরের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ছটি।
প্রশ্ন: আকবরের শাসন ব্যবস্থা মূল বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর: আকবরের শাসন ব্যবস্থা মূল বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় সহনশীলতা।
প্রশ্ন: সম্রাট আকবরের শাসন কাল কতো বছর ছিল?
উত্তর: ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৯ বছর মুঘল সম্রাট আকবার শাসন করেছিল।
প্রশ্ন: সম্রাট আকবরের কোন উপদেষ্টা খান ই খানান উপাধি প্রাপ্ত হন?
উত্তর: সম্রাট আকবরের তার বিশ্বস্ত সেনাপতি বৈরাম খাঁকে খান ই খানান উপাধিতে ভূষিত করেন।
প্রশ্ন: মুঘল আমলে জায়গীর প্রাপ্ত সেনাপতির উপাধি কি ছিল?
উত্তর: মোগল আমলে জায়গীর প্রাপ্ত সেনাপতির উপাধি ছিল ফৌজদার।
প্রশ্ন: আকবরের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?
উত্তর: আকবরের প্রধানমন্ত্রীর নাম বৈরাম খান।