আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে দক্ষিণ ভারতের দুটি বড় শক্তিশালী সাম্রাজ্য বিজয়নগর ও বাহমনি সাম্রাজ্যের সংঘাতের মূল কারণ কি ছিল তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
প্রায় দুশো বছর ধরে পাশাপাশি বেড়ে ওঠা এই দুই সাম্রাজ্য মূলত বিজয়নগর হিন্দু রাজার সঙ্গে সম্মিলিত বাহামনি রাজ্যটির বেরার রাজ্য ব্যতীত আরও চারটি মুসলিম রাজ্য যেমন বিজাপুর, আহমেদনগর, গোলকুন্ডা এবং বিদর রাজ্যের সম্মিলিত লড়াই।
বিজয়নগর সাম্রাজ্য এবং বাহমানি সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘাতের মূল কারণ গুলি ছিল ধর্মীয়, আঞ্চলিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণের এক জটিল মিশ্রণ। যা ছিল দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে ক্ষমতা, প্রভাব, স্বার্থ রক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি শাশ্বত সংগ্রাম।
বিজয়নগর ও বাহমনি সাম্রাজ্যের সংঘাতের মূল কারণ কি ছিল?
দক্ষিণ ভারতের দাক্ষিণাত্য অঞ্চলটি কাদের নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতায় থাকবে তানিয়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্য এবং বাহমানি সাম্রাজ্যের মধ্যে বিরোধীতা চরমে ওঠে। 1336 সালে দক্ষিণ ভারতের হিন্দু রাজ্য বিজয়নগর প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মূল লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলে হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং বজায় রাখা। আর 1347 সালে প্রতিষ্ঠিত বাহমানি সাম্রাজ্য ছিল মুসলিম রাজ্য, এই রাজ্যের শাসকরা চেয়েছিল ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠান এবং বিস্তার করতে।
1336 সাল থেকে 1565 সাল পর্যন্ত বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসকরা ধীরে ধীরে তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তৃত করে এবং দক্ষিণ ভারতে একটি বিশিষ্ট শক্তিতে পরিণত করে।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসকরা ছিলেন হিন্দু ধর্মের রক্ষক আর তাই বাহমানি সাম্রাজ্য সহ প্রতিবেশী ইসলামি সালতানাতদের কাছ থেকে ক্রমাগত হুমকি আসত।
বাহমানি সাম্রাজ্যের সম্রাটরা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মোকাবেলা করতে এবং নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন।
ধর্মীয় সংঘাতের পাশাপাশি উভয় সাম্রাজ্যই তাদের বাণিজ্য অঞ্চল, মূল্যবান সম্পদ, এবং তাদের আসেপাশের অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা প্রায়সয় একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হতেন।
এই ধর্মীয় বিভাজন দুটি সাম্রাজ্যের একে অপরের শত্রুতে পরিণত করে। যার কারণে তাদের মধ্যে ঘন ঘন সংঘর্ষ এবং সামরিক অভিযান চলতে থাকে।
দাক্ষিণাত্য অঞ্চলটি ছিল মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি বড় প্রাণকেন্দ্র। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বণিকরা এই স্থানে আসতো মূলত ব্যবসা করতে।
উভয় সাম্রাজ্যের জন্য এই সমস্ত বাণিজ্যিক পথ এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করাটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাই বিজয়নগর ও বাহমনি এই দুই রাজ্য অর্থনৈতিক কারণ এবং আঞ্চলিক আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিল। মূলত এই সমস্ত বিষয় গুলি ছিল বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের দ্বন্দ্বের কারণ।
দেবগিরির অভিজাত- বর্গের বিদ্রোহ ও স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা
দাক্ষিণাত্যের স্বাধীন রাজ্য : বাহমনী বংশ : মহম্মদ-বিন- তুঘলকের রাজত্বকালের শেষভাগে সুলতানি সাম্রাজ্যের চতুর্দিকে নানারূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছিল; ফলে কেন্দ্রীয় শক্তিও দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল।
এই সুযোগে দাক্ষিণাত্যে দেবগিরির অভিজাতবর্গ বিদ্রোহী হুইয়া একটি নূতন মুসলমান রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ইহাই ইতিহাসে বাহমনী রাজ্য নামে বিখ্যাত।
অভিজাত সম্প্রদায় দৌলতাবাদ দখল করিয়া প্রথমে ইসমাইল মুখ নামে তাহাদেরই একজন নেতাকে স্বাধীন সুলতান বলিয়া ঘোষণা করেন।
কিন্তু তিনি তাঁহার অক্ষমতা প্রমাণ করিলে হাসান নামে অপর একজন আমীর আলাউদ্দিন-বাহ মন-শাহ’ উপাধি ধারণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন।
জাফর বা হাসেমের বংশ পরিচয়
ফেরিস্তার বর্ণনা অনুসরণ করিয়া অনেকে মনে করিতেন যে, হাসান তাঁহার গাঙ্গু নামক ব্রাহ্মণ প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্যই তাঁহার প্রতিষ্ঠিত বংশের নাম ‘বাহমনী’ বংশ রাখিয়াছিলেন।
কিন্তু সম-সাময়িক মুদ্রা ও লিপি এবং সমসাময়িক গ্রন্থ বুরহান-ই-মাসির ও ‘তরকৎ-ই-আকবরী’ হইতে উপরোক্ত মতের কোন সমর্থন পাওয়া যায় না।
সুতরাং স্মিথ প্রমুখ বর্তমান ঐতিহাসিকগণ মনে করেন আলাউদ্দিন বহমন শাহ পারস্যের খ্যাতনামা বীর বাহমন-বিন-ইফদিয়ার বংশধর হিসাবেই তিনি তাঁহার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের নাম বাহমনী বংশ রাখেন ৷
বাহমনী বংশের স্বরূপ:
বাহমনী রাজ্যের সীমা শাসনাবস্থা
আলাউদ্দিন বাহ্মন শাহ, গুলবর্গায় তাঁহার রাজধানী স্থাপন করিয়া রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হইলেন। তুঘলক বংশের পরবর্তী সুলতান ফিরোজ শাহের যুদ্ধ বিরোধী নীতি তাঁহাকে আরও উৎসাহিত করিয়া তুলিল।
তিনি একে একে গোয়া, দাবল, কোলাপুর, তেলাঙ্গানা ও কর্ণাট প্রদেশের অংশ বিশেষ দখল করিয়া তাঁহার রাজ্যকে পূর্ব দিকে দৌলতাবাদ হইতে পশ্চিমে হায়দ্রাবাদ, এবং উত্তরে ওয়েস গঙ্গা হইতে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত করিলেন ।
তিনি তাঁহার সমগ্র রাজ্যকে গুলবর্গা, দৌলতাবাদ, বেরার ও বিদর এই চারিটি প্রদেশ বা তরফে বিভক্ত করিয়া চারিজন শাসনকর্তা নিযুক্ত করিলেন । সমসাময়িক সাহিত্যে বাহ মন শাহের শাসন ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করা হইয়াছে। ১৩৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয় ।
বাহমনী বংশের স্বরূপ
বাহমনী রাজ্য প্রায় একশত সত্তর বৎসরকাল স্থায়ী হইয়া ছিল এবং আঠারোজন সুলতান যথাক্রমে রাজত্ব করিয়াছিলেন। এই সুলতানগণের রাজত্বকালের ইতিহাস হইতেছে ষড়যন্ত্র, অন্তর্বিপ্লব এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সহিত যুদ্ধ-বিগ্রহ ও লুণ্ঠনের ইতিহাস।
দেশের শাসনব্যবস্থা ছিল দুর্বল এবং সেদিকে বেশীর ভাগ সুলতানই কোন দক্ষতা দেখাইতে পারেন নাই। অধিকাংশ সুলতানই ছিলেন অত্যাচারী ধর্মান্ধ, রক্তপিপাসু ও ব্যভিচারী। স্থানীয় ও বিদেশী মুসলমান আমীরগণের স্বার্থ সংঘাত সমস্ত অবস্থাকে আরও বিষাক্ত করিয়া রাখিত।
তবে দক্ষিণের প্রতিবেশী হিন্দু রাজ্য বিজয়নগর ও বরঙ্গলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে তাঁহাদের উৎসাহের কোন অভাব ছিল না।
বাহমনী ও বিজয়নগরের মধ্যে সুদীর্ঘ সংগ্রাম:
মহম্মদ শাহ (১৩৫৮- 99) বিজয়নগরের সহিত যুদ্ধের কারণ
বাহমন শাহের পর তাঁহার পুত্র প্রথম মহম্মদ শাহ্, সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি দেশের শাসনব্যবস্থাকে কিছুটা সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করিতে সক্ষম হন।
কিন্তু তাঁহারই সময়ে বাহমনি ও বিজয়নগর রাজ্যের মধ্যে সুদীর্ঘ সংগ্রামের সূত্রপাত হয়। রাজ্যের সীমা বিস্তার, লুণ্ঠন প্রভৃতির ইচ্ছাই এই যুদ্ধের প্রেরণা যোগাইয়াছে।
বরঙ্গলের রাজা পরাজিত বিজয়নগর রাজও পরাজিত
রায়চুর দোয়াবের অধিকার লইয়া এই যুদ্ধ আরম্ভ হয় । মহম্মদ শাহ প্রথমে বরঙ্গলের রাজাকে পরাজিত করিয়া গোলকুণ্ডার দুর্গ এবং প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা লাভ করেন।
অতঃপর তিনি বিজয়নগররাজ প্রথম ভুথাকে পরাজিত করিয়া প্রায় চারিলক্ষ হিন্দুর প্রাণনাশ করেন। বিজয়- নগররাজ প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিয়া সন্ধি করিতে বাধ্য হন।
কিন্তু এইখানেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয় নাই; পরবর্তী সুলতান মুজাহিত শাহের (১৩৭৭-৭৮) সময়েও এই যুদ্ধ চলিতে থাকে।
মুজাহিত শাহের সময়েও যুদ্ধ
সুলতান বিজয়নগরের রাজধানী অবরোধ করিয়াও বিশেষ সুবিধা করিতে পারেন নাই। তাঁহার পর দ্বিতীয় মহম্মদের সময় (১৩৭৯-৯৭) এই যুদ্ধ সাময়িক ভাবে স্থগিত ছিল; কারণ তিনি শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি বেশী অনুরাগী ছিলেন।
তিনি অনেক বিদ্যালয় ও মসজিদ স্থাপন করেন। এশিয়ার বিভিন্ন স্থান হইতে আগত বহু পণ্ডিত তাঁহার রাজসভা অলঙ্কৃত করিতেন।
দ্বিতীয় হরিহর কর্তৃক বাহমনী রাজ্য আক্রান্ত
কিন্তু ফিরোজ শাহের (১৩৯৭-১৪২২) আমল হইতে বিজয়নগরের সহিত আবার যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে বিজয়নগররাজ দ্বিতীয় হরিহর বিরাট এক সৈন্যবাহিনী সহ রায়চুর দোয়ার আক্রমণ করেন।
কিন্তু ব্যর্থ হইয়া তিনি সন্ধি করিতে বাধ্য হন। বাহমনী রাজ্যের উত্তরদিকস্থ খাদেশ, গুজরাট ও মালবের মুসলমান সুলতানগণের সহিতও ফিরোজের বিরোধ চলিতেছিল।
🔥আরও পড়ুনঃ-
বিজয়নগর রাজ দ্বিতীয় ভুখা পরাজিত (১৪২০ খ্রীষ্টাব্দ ফিরোজ পরাজিত)
তাঁহাদের প্ররোচনায় ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দে এই দুই রাজ্যের মধ্যে আবার যুদ্ধ আরম্ভ হয়। প্রথম আক্রমণে কিরোজ ব্যর্থ হইলেও পরে তিনি বিজয়নগররাজ দ্বিতীয় ভূধাকে পরাজিত করিয়া অত্যন্ত অপমানজনক সর্তে সন্ধি করিতে বাধ্য করেন। কিন্তু ১৪২০ খ্রীষ্টাব্দে তৃতীয় অভিধানে ফিরোজ সম্পূর্ণ পরাজিত হন।
আহম্মদশাহ (১৪২২-৩৫) দ্বিতীয় দেবরায় পরাজিত
বিজয়নগরের সেনাবাহিনী রাজ্যের পূর্ব ও দক্ষিণাংশ অধিকার করিয়া লন। অতঃপর ফিরোজ শাহের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিয়া তাঁহার ভ্রাতা আহম্মদ শাহ, তাঁহাকে হত্যা করেন করেন ও নিজে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই তিনি বিজয়নগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বিজয়নগররাজ দ্বিতীয় দেবরায়কে প্রচুর ক্ষতিপূরণ ও বাৎসরিক করদানে বাধ্য করেন।
বরঙ্গল জয় ও রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত
অতঃপর আহম্মদ শাহ, বরঙ্গল আক্রমণ করিয়া ঐ রাজ্যটি সম্পূর্ণ পদানত করিয়া লন। তিনি গুজরাট ও মালবের সুলতানগণকেও পরাজিত করিয়া তাঁহার রাজ্যসীমা বিস্তৃত করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
কিনি গুলবর্গা হইতে বিদরে তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তিনি ছিলেন একজন ধর্মোন্মত্ত সংকীর্ণমনা দুর্ধর্ষ শাসক।
রাজদরবারে দুই পরস্পর বিরোধী দল
তবে তিনি বিদ্যা ও বিজ্ঞানের প্রতিও কিছু অনুরাগ প্রদর্শন করিয়া ছিলেন। আহম্মদ শাহের রাজত্ব কালের সময় হইতেই রাজ দরবারে দুই পরস্পর বিরোধী দলের উদ্ভব হয়।
প্রথম দলটিতে ছিল সুন্নী সম্প্রদায়ভুক্ত স্থানীয় মুসলমানগণ, আর দ্বিতীয় দলটিতে ছিল সিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত বিদেশী মুসলমানগণ । ইহাদের মধ্যে সংঘাতের ফলে শাসনব্যবস্থা ক্রমেই দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিল ।
পরবর্তী সুলতানগণ
ইহার পর আলাউদ্দিন আহম্মদ (১৪৩৫-৫৭), হুমায়ুন শাহ (১৪৫৭-61) ও নিজামশাহ (১৪৬১-৬৩) পর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাহাদের রাজত্ব কালেও বিজয় নগরের সহিত যুদ্ধ-বিগ্রহ অব্যাহত ভাবে চলিতে থাকে।
পরবর্তী সুলতান তৃতীয় মহম্মদ শাহ্, (188062)- এর রাজত্বকালে রাজ্যের সকল ক্ষমতা মাসুদ-গা ওজান নামে একজন সুদক্ষ মন্ত্রীর হস্তগত হইল ।
মামুদ গাওয়ান:
মামুদ গাওয়ান কর্তৃক মন্ত্রিত্ব দখল
মামুদ গাওয়ান ছিলেন একজন বিদেশী মুসলমান এবং বাহমনী রাজ্যের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। রাজ্যের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করিয়া তিনি বুদ্ধ মন্ত্রী ‘খাজা জাহান’কে হত্যা করাইলেন এবং নিজে ‘খাজা, জাহান’ উপাধি ধারণ করিয়া মন্ত্রী হইলেন।
তিনি রাজাকে সুরক্ষিত করিবার জন্য এবং রাজ্যের সীমা সম্প্রসারিত করিবার জন্য কয়েকটি যুদ্ধাভিযান পরিচালিত করিয়াছিলেন।
কোঙ্কন ও বিজয়নগরের বিরুদ্ধে অভিযান
কোঙ্কনের হিন্দু রাজগণের কোঙ্কন ও বিজয়নগরের বিরুদ্ধে কয়েকটি সার্থক অভিযান পরিচালিত করিয়া তিনি কতকগুলি দুর্গ ও শহর নিজ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন।
বিজয়নগর রাজ্য হইতে তিনি গোয়া বন্দরটি দখল করেন। সঙ্গমেশ্বর রাজ্যের নিকট হইতে তিনি খালনার দুর্গটি আদায় করেন।
অন্যান্য যুদ্ধ-বিগ্রহ গাওয়ানের সমর কুশলতা
উড়িষ্যার রাজাকেও তিনি পরাজিত করিয়াছিলেন এবং তাঁহারই মন্ত্রীত্বকালে রাজ মহেন্দ্রী ও কোলবীর নামক দুর্গ দুইটিও দখল হয় । ১৪৮১ খ্রীষ্টারে গাওয়ান কাজী আক্রমণ করিয়া তথাকার মন্দিরস্থ ধনরত্নাদি লুণ্ঠন করেন।
তাঁহার এই সমস্ত অভিযানের মধ্য দিয়া তাঁহার সমর কুশলতার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় এবং রাজ্যের সীমাও যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয় ।
গাওয়ানের শাসন দক্ষতা
মামুদ গাওয়ান রাজ্যের শাসনব্যবস্থারও যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত করিয়া তিনি রাজ্যে রাজস্ব আদায়ের সুবন্দোবস্ত করেন; বিচার ও শিক্ষা ব্যবস্থারও উন্নতি সাধন করেন।
সৈন্যবাহিনীতে তিনি কঠোর শৃঙ্খলা প্রবর্তন করিয়াছিলেন। এইজন্যই সমসাময়িক ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘বুরহান-ই-মাসির (Burhan-i-Ma’asir)-এর মতে ‘মন্ত্রী হিসাবে গাওয়ান ছিলেন অদ্বিতীয়।’
ব্যক্তিগত জীবন বাহমনী রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে
গাওয়ানের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল নিষ্কলুষ ও অনাড়ম্বর। বিদ্যা ও বিদ্যানের প্রতি তাঁহার যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তাঁহারই প্রচেষ্টায় বাহ মনি রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করিয়াছিল।
কিন্তু তাঁহার ক্ষমতা ও আধিপত্যে স্থানীয় আমীরগণের দলটি ঈর্ষান্বিত হইয়া উঠে; তাহাদের কুপরামর্শে সুলতান তৃতীয় মহম্মদ শাহ গাওয়ানকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাহমনী রাজ্যেরও পতন আরম্ভ হইয়া গেল । With his death departed all the cohesion and power of the Bahmani Kingdom.”- Meadows Taylor.
বাহমনী রাজ্যের পতন:
অকর্মণ্য সুলতানগণ অভিজাতবর্গের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব
তৃতীয় মহম্মদ শাহের পরবর্তী স্থলতান মামুদ শাহ্, (১৪৮২-১৫১৮) ছিলেন যেমন অকর্মণ্য তেমনি দুর্বল চিত্ত। তাঁহার সময়ে কোন সুযোগ্য মন্ত্রীরও উদ্ভব হয় নাই । স্থানীয় ও বিদেশী অভিজাতবর্গের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বও তীব্র হইয়া উঠিল।
পরবর্তী সুলতানগণের অকর্মণ্যতা ও ধর্মান্ধতা এই কলহ বুদ্ধিতে সাহায্য করিল মাত্র। কেন্দ্রীয় পড়িল এবং এই সুযোগে প্রাদেশিক শাসকগণ একে একে স্বাধীন হইয়া পড়িতে লাগিল ।
পাঁচটি রাজ্যে বিভক্ত
অবশেষে শেষ সুলতান কলিমুল্লাহ শাহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দে বাহমনী বংশের অবসান ঘটে। বাহমনী রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হইয়া পাঁচটি স্বাধীন রাজ্যের উৎপত্তি হইল:
(ক) বিজাপুর রাজ্য, (খ) নিজাম শাহী বংশ প্রতিষ্ঠিত আহম্মদনগর রাজ্য, (গ) ইমাদ শাহী বংশ প্রতিষ্ঠিত বেরার রাজ্য, (ঘ) কুতুব শাহী বংশ প্রতিষ্ঠিত গোলকুণ্ডা রাজ্য, এবং (ঙ) বারিদ শাহী বংশ প্রতিষ্ঠিত বিদর রাজ্য ।
বাহমনী বংশের স্বরূপ ও কৃতিত্বঃ
সুলতানগণের স্বরূপ ও নীতি
বাহমনী রাজ্যের অস্তিত্বের একশত সত্তর বৎসর কাল ষড়যন্ত্র, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সহিত যুদ্ধ বিগ্রহেই কাটিয়াছিল। আঠারো জন সুলতানের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিলেন শাসক হিসাবে অকর্মণ্য ও দুর্বলচিত্ত।
ধর্মীয় গোঁড়ামীর উপর ভিত্তি করিয়া তাঁহাদের নীতি নির্ধারিত হইত। সুতরাং রাজ্যের শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য বা শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষ কোন কৃতিত্ব পরিলক্ষিত হয় না।
রুশ পর্যটকের মন্তব্য
রুশ পর্যটক আথেনেসিয়াস নিকিতিন (Athanasius Nikitin) বাহমনী রাজ্য সম্বন্ধে এক বিবরণীতে বলিয়াছেন যে, এ রাজ্যের অভিজাতবর্গ ছিলেন ধনী এবং সর্বদাই বিলাস-ব্যসনে নিমজ্জিত; কিন্তু জনসাধারণের অর্থ নৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয় ও শোষণে জর্জরিত।
নিকিতিনের মতে আমীর ওমরাহগণের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির তুলনায় স্থলতানের প্রকৃত ক্ষমতা ছিল নিতান্তই সামান্য।
স্মিথের অভিমত
ডাঃ স্মিথের মতে বাহমনী বংশ ভারতে কোনরূপ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিতে সক্ষম হন নাই। “It would be difficult to specify the definite benefit conferred upon India by this dynasty.”-Smith.
উপসংহার
উপরে উল্লেখিত বিজয়নগর ও বাহমনি সাম্রাজ্যের সংঘাতের মূল কারণ কি ছিল আশাকরি আপনাদের পচ্ছন্দ হয়েছে। আমাদের দেওয়া তথ্য ছাড়া আপনাদের আরো অন্য কোনো তথ্য জানা থাকলে আপনারা আমাদের কমেন্ট বক্সতে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আরো নতুন নতুন তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটতে আবার আসার অনুরোধ রইল।
FAQs
প্রশ্ন: বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?
উত্তর: হরিহরা ও বুক্কা 1336 সালে বিজয়নগর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠান করেন।
প্রশ্ন: বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক কে ছিলেন?
উত্তর: কৃষ্ণদেবরায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন।
প্রশ্ন: বিজয়নগর রাজ্যের রাজধানীর নাম কি?
উত্তর: হাম্পি ছিল বিজয়নগর রাজ্যের রাজধানীর ।
প্রশ্ন: দক্ষিণ ভারতের বাহমনি রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?
উত্তর: দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলকের উপর অসুন্তুষ্ট হয়ে 1347 সালে আলাউদ্দিন বাহমান শাহ বাহমানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন: বাহমনী রাজ্যের রাজধানীর নাম কি?
উত্তর: 1347 থেকে 1425 সাল পর্যন্ত বাহমনী রাজ্যের রাজধানী ছিল গুলবর্গা (বর্তমানে কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থিত) এবং 1425 থেকে 1527 সাল পর্যন্ত বাহমনী রাজ্যের রাজধানী ছিল বিদার।
প্রশ্ন: বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পূর্বতন নাম ছিল?
উত্তর: বিসনেগার রাজ্য ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পূর্বতন নাম।