ঠান্ডা লড়াই বলতে কী বোঝো?

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
Rate this post

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমি মিত্র রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার যে সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার মনোভাব গড়ে উঠেছিল, যুদ্ধের শেষে তা পরিবর্তিত হয়ে প্রবল মতভেদ, বিদ্বেষ, পারস্পরিক সন্দেহ ও কূটনৈতিক বিরোধের সৃষ্টি করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমি দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শগত পার্থক্য উভয় শক্তি গোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়িয়ে দেয়।

পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের প্রসার ও নিজ প্রাধান্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি শক্তি জোট’ গঠন করে। এর প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যুত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে পশ্চিমি শক্তি জোট’ গঠন করে ছিল।

দুই জোটের শক্তি মধ্যে প্রকৃত যুদ্ধ না ঘটলেও বিশ্বযুদ্ধের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। এই বাতাবরণ বা দুটি শক্তি জোটের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের আশঙ্কাজনিত মানসিক চাপকে ‘ঠান্ডা লড়াই’ (Cold war) বলে অভিহিত করা হয়।

বৈশিষ্ট্য :

ঠান্ডা লড়াই-এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

প্রথমত, ঠান্ডা লড়াই-এর মূল কথা হল সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

দ্বিতীয়ত, উভয় রাষ্ট্র চেষ্টা করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে এবং সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করতে।

তৃতীয়ত, উভয় রাষ্ট্রই ঠান্ডা লড়াই সম্বন্ধে তাদের নীতিকে রাজনৈতিক মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট। সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্যবাদের নামে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নামে ঠান্ডা লড়াই পরিচালনা করে।

চতুর্থত, ঠান্ডা লড়াই-এর দু’পক্ষই যথাসম্ভব সামরিক প্রস্তুতি বাড়িয়ে চললেও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে নামতে বিরত থাকে।

ঠান্ডা লড়াই এর কারণ :

আদর্শগত বিরোধ :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে গনতন্ত্র রক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন একসঙ্গে যুদ্ধ করলেও পুঁজিবাদি বুর্জোয়া গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সাম্যবাদ বিরোধী মনোভাব যুদ্ধের আগে থেকেই ছিল।

অধ্যাপক সুম্যান এর মতে, কুড়ি শতকের ত্রিশের দশকে ইউরোপের রক্ষনশীল এবং ব্যবসায়ীরা তোষণ নীতির সমর্থক ছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের সরকার ও একই মনোভাবাপন্ন ছিল। তারা সোভিয়েত সাম্যবাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসীবাদ ও নাৎসীবাদকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।

মিউনিখ চুক্তি, চেকোস্লোভাকিয়া ও তাস্ট্রিয়া দখল হিটলারের এই কাজকে তারা স্বীকৃতি দিয়েছিল। হিটলারের পূর্ব অভিযান সোভিয়েত ইউনিয়নের আতংকের কারণ ছিল।

দ্বিতীয় রনাঙ্গন :

জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পূর্নমাত্রায় আক্রমন শুরু করলে (১৯৪১, জুলাই) স্ট্যালিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি চার্চিল এর কাছে ৩০ ডিভিশন ব্রিটিশ সৈন্য সাহায্য বা জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় রনাঙ্গন খোলার প্রার্থনা জানান। জার্মানির দ্বারা সোভিয়েত ইউনিয়ন বিধ্বস্ত হোক, -সম্ভবত : এই ধারনার জন্য পশ্চিমি শক্তিবর্গ সোভিয়েত প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছিল, যা সোভিয়েত পশ্চিমি জোটের দ্বন্দ্বের একটি কারণ ছিল।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ের কারণ কি ছিল

মার্কিন সোভিয়েত মতভেদ (যুদ্ধকালীন) :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইয়াল্টা সম্মেলন (৯ই ফ্রেব্রুয়ারী ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে) পোল্যান্ড অধিকারের প্রশ্নে স্ট্যালিনের কঠোর মনোভাব পশ্চিমি জোটকে বিক্ষুদ্ধ করলেও রুজভেল্ট মানিয়ে চলেন। পটসডাম সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এর কঠোর মনোভাব স্ট্যালিন মেনে নিতে বাধ্য হন। জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে দুই শক্তির মতভেদ বৃদ্ধি পায়।

যুদ্ধোত্তর কালে পশ্চিমি জোটের দ্বারা পশ্চিম জার্মানি গঠন, নতুন মুদ্রা প্রবর্তিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বার্লিন অবরোধ করে (১৯৪৮, জুলাই)। ফলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

সোভিয়েত রাশিয়া ও পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির মধ্যে মতপার্থক্য :

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বেই যুদ্ধোত্তর কালের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে যেসব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতেই সোভিয়েত রাশিয়া ও পশ্চিমি শক্তিগুলির মধ্যে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। যুদ্ধশেষে শাস্তি সম্মেলনে সোভিয়েত পক্ষ এবং সোভিয়েত বিরোধীদের মধ্যে দারুণ তিক্ততার সৃষ্টি হয়।

শেষে অনেক বাকবিতণ্ডার পর কয়েকটি দেশের সঙ্গে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হলেও ওই চুক্তিগুলি প্রস্তুত করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমি দেশগুলির মধ্যে যে তিক্বতার সঞ্চার হয় তা ঠান্ডা লড়াই-এর পটভূমি রচনা করে।

সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধি :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ ও এশিয়ার সদ্য-স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলিতে সোভিয়েত প্রভাব ও সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের শেষ দিকে পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল লাল ফৌজের দখলে চলে যায়।

লাল ফৌজের আশ্রয়ে পোল্যান্ড, রুমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশে কমিউনিস্ট দল শক্তিশালী হয়ে সরকার দখল করার উপক্রম চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোশ্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, আলবানিয়া, ফিনল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি রাজ্যগুলির ওপর নিজ প্রাধান্য বিস্তার করে নিজের সীমায় তাদের নিয়ে একটি আবেষ্টনী গড়ে তোলে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ট্রুম্যান নীতি :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফলে ইউরোপে আধিপত্য বৃদ্ধি এবং ইউরোপের বাইরে এশিয়ার দেশগুলিতে সোভিয়েত প্রভাব বাড়ায় আমেরিকা সহ পশ্চিমি দেশগুলি উদ্বিগ্ন হয়।

এই অবস্থায় মূলত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ফুলটন বক্তৃতায় আতঙ্কিত ও সতর্কিত হয়ে মূলত কমিউনিস্ট প্রভাব রোধ করার জন্য ও সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১২ মার্চ তাঁর বিখ্যাত ট্রুম্যান ডকট্রিন’ ঘোষণা করেন।

বলা হয় যে, মুক্ত বিশ্বের কোনো স্থানে সংখ্যালঘু সশস্ত্র গোষ্ঠী অথবা বৈদেশিক শক্তি, গণতান্ত্রিক বৈধ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করলে সেই বৈধ সরকারকে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র সর্বপ্রকার সাহায্যদান করবে।

এই নীতির দ্বারা ট্রুম্যান বিশ্বের অ-কমিউনিস্ট সরকারগুলিকে কমিউনিস্ট আক্রমণ থেকে রক্ষা করার পুলিশি দায়িত্ব গ্রহণ করার অঙ্গীকার জানান। এই ঐতিহাসিক ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রিস ও তুরস্ককে ৪০০ মিলিয়ন ডলার মঞ্জুর করে ।

মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে সাহায্য দান :

এর পর যুদ্ধোত্তর পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলিকে শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অগ্রসর হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে যে, যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে সাহায্য না করলে অদূর ভবিষ্যতে সমগ্র ইউরোপে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে এবং ওই সমস্ত দেশ সাম্যবাদের প্রভাবাধীন হয়ে পড়বে।

এই জন্য মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র ‘টুম্যান নীতি’ ঘোষণার তিন মাসের মধ্যেই এক অর্থনৈতিক সাহায্যদান-সংক্রান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করে, যা মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনায় বলা হয় যে, ইউরোপের যে সব রাষ্ট্র তাদের আর্থিক পুনরুজ্জীবনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চাইবে তাদের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহায়তা দেওয়া হবে।

এর ফলে ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, পশ্চিম জার্মানি প্রভৃতি পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১২ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে। অবশ্য রাশিয়াকে সুকৌশলে এই সাহায্য থেকে বাদ দেওয়া হয়।

সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাষ্ট্রজোট :

মার্শাল পরিকল্পনার ফলে পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির সম্পর্ক আরও তিক্ত ও বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে ওঠে। মার্শাল পরিকল্পনার জবাবে কমিউনিস্ট দেশগুলি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ‘কমিকন’ (COMECON) স্থাপন করে।

কমিউনিস্ট দেশগুলির অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং ব্যাবসাবাণিজ্যে পরস্পরকে সাহায্য করাই ছিল ‘কমিকন’-এর উদ্দেশ্য। এভাবে সব দিক দিয়ে যখন পূর্ব-পশ্চিম জোটের মধ্যে বিবাদ বিসংবাদ ও বিরোধিতা ক্রমেই বাড়তে লাগল তখন পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গ ‘ন্যাটো’ (NATO), সিয়েটো (SEATO), সেন্টো (CENTO) প্রভৃতি আঞ্চলিক রাষ্ট্রজোট গঠন করে সোভিয়েত রাশিয়ার তাঁবেদার রাষ্ট্রের আবেষ্টনী রচনার প্রত্যুত্তর দেয়।

সোভিয়েত রাশিয়াও এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ওয়ারশ’ চুক্তি (Warsaw Pact) নামে সামরিক জোট গঠন করে।

উপসংহার :

এভাবে পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ পরস্পর বিরোধী দুটি মেরুতে ভাগ হয়ে পড়ার ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরস্পর সন্দেহ, সামরিক সাজসরঞ্জাম বৃদ্ধি, পারমাণবিক মারণাস্ত্র প্রস্তুতের প্রতিযোগিতা প্রভৃতি শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার পক্ষে এমন বিপজ্জনক করে তোলে যে, পৃথিবী আর একটি বিশ্বযুদ্ধের প্রায় প্রাপ্ত সীমায় এসে উপস্থিত হয়। অর্থাৎ যুদ্ধ না ঘটলেও যুদ্ধের মত অবস্থা সৃষ্টি হয়। তবে বর্তমানে সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙন এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বলা যেতে পারে।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment