দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঠান্ডা লড়াই-এর যুগে আর একটি সংকট বিশ্বকে আণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল তা হল কিউবা সংকট। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ দ্বীপ কিউবা ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের অধীনতাপাশ ছিন্ন করে।
কিন্তু ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ‘প্ল্যাট চুক্তি’ (Platt Agreement) দ্বারা মার্কিন সরকার কিউবার কাছ থেকে কিউবার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অধিকার আদায় করে। অবশ্য উদারপন্থী মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ক্ষমতায় এসেই ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে এই চুক্তি বাতিল করে দেন।
বিশ্বের সর্বাধিক চিনি উৎপাদক দেশ কিউবা প্রাকৃতিক সম্পদেও ছিল ভরপুর। এখানে বহু ধরনের কলকারখানা গড়ে উঠলেও বেকারের সংখ্যা ছিল বহু। সাধারণ মানুষ চরম দারিদ্র্য ও দুর্দশার মধ্যে কালাতিপাত করত।
এর কারণ কিউবার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পপতিদের দ্বারা। মার্কিন মূলধনই কিউবায় সর্বাধিক বিনিয়োগ করা হয়েছিল। মার্কিন পুঁজিপতিদের স্বার্থেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত।
আর্থিক স্বার্থেই ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের মার্চে মার্কিন সাহচর্যে ফ্যালজেনিকো বাতিস্তা (Fulgenico Batista) ক্ষমতায় আসেন এবং ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে কিউবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
বাতিস্তার পতন ও ফিদেল কাস্ত্রোর ক্ষমতা গ্রহণ:
দুর্নিতিপরায়ণ ও অত্যাচারী বাতিজ্ঞা কিউবাতে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি ফিদেল কাস্ত্রো (Fidel Castro)-র নেতৃত্বে এক অভ্যন্তরীণ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং বাতিস্তা কিউবা থেকে পালিয়ে যান।
কারো দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে প্রথম জীবনে উদারপন্থী, পরে কমিউনিস্ট।
কিউবার অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ও বৈদেশিক নীতি:
কাস্ত্রো একদিকে বড়ো বড়ো খামার, বিদেশি শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয়করণ করেন এবং নানা ধরনের বৈপ্লবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে জনগণের উন্নতিবিধানে সচেষ্ট হন।
অন্যদিকে মার্কিন বিরোধী সমাজতান্ত্রিক জগতের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করেন। স্বভাবতই কিউবার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। কারণ ওই সব প্রগতিশীল নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরোধী ছিল।
১৯৬১-র জানুয়ারি মাসে কিউবা হাভানার মার্কিন দূতাবাসে কর্মীর সংখ্যা ১১-র মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার দাবি জানালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সঙ্গে সকল কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নবগঠিত এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়।
১৯৬১-র মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে ফ্লোরিডা থেকে কিউবার উদ্বাস্তুরা ফিদেল কাস্ত্রো সরকারের বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ অভিযানও করেছিল।
🔥আরও পড়ুনঃ-
কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ:
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে আমেরিকা মহাদেশের অন্যান্য অনেক রাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে। কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তুলতে ‘আন্ত আমেরিকান রাষ্ট্র সংস্থা’ (O.A.S.) গঠিত হয়।
এতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার মোট উৎপাদিত চিনির অর্ধাংশ ভালো দাম দিয়ে ক্রয় করত। তেল কোম্পানিগুলির কিউবার সঙ্গে বিরোধের জন্য কিউবাকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবা থেকে চিনি আমদানির পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিল।
এর ফলে কিউবার অর্থনীতিতে অভাবনীয় সংকট দেখা দিল। কিন্তু এসময় তাকে রক্ষা করল রাশিয়া ও চিন। রাশিয়া ও চিন কিউবা থেকে চিনি ক্রয় করতে সম্মত হল।
এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেয়ে কাস্ত্রো কিউবায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন প্রায় সমস্ত সংস্থা জাতীয়করণ করেন। ফলে বলা যায়, কিউবায় বড়ো ধরনের মার্কিন পুঁজি বিনিয়োগের অস্তিত্ব প্রায় মুছে গেল।
কিউবায় রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ:
কাস্ত্রো সরকার কিউবার ৫০ লক্ষ মানুষকে আমেরিকা ও তার মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে বাঁচাতে সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্যে কিউবাতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করে। এ সময় রাশিয়ার মস্কো রেডিও এই মর্মে ঘোষণা করে যে, কিউবার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ভীতির প্রেক্ষিতে কিউবার আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে কিউবার যে-কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার আছে।
কিউবার প্রকৃত বন্ধুদের ন্যায়সংগত অধিকার আছে তার সাহায্যের আবেদনে সাড়া দেওয়া। রাশিয়ার এই ঘোষণা সমস্ত আমেরিকাবাসীকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলল; বিশেষ করে ১৯৬২-র অক্টোবর মাসে যখন কিউবায় আণবিক কেন্দ্র গড়ে উঠছে, তখন আমেরিকার গুপ্তচর বাহিনীর বিমান থেকে তোলা এমন একটি ফটো আমেরিকার প্রধান সংবাদপত্রগুলিতে ছাপানো হল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি কেনেডি সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ক্রুশ্চেভকে অনুরোধ করলেন সমস্ত ঘাঁটি ধ্বংস করতে, ক্ষেপণাস্ত্র তুলে নিতে, সমস্ত প্রযুক্তিবিদদের ফেরত নিতে এবং সমস্তরকম সরঞ্জাম পাঠানো বন্ধ করতে। সেই সঙ্গে তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বললেন যে, যে-কোনো উপায়ে হোক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
কিউবার চতুর্দিকে তিনি নৌ অবরোধের ব্যবথা করলেন এবং যাতে কোনো জাহাজ কিউবাতে আসতে না পারে বা তল্লাশীর পর তবে কিউবাতে যেতে পারবে, তার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। সোভিয়েত সরকার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয় এবং কিউবাগামী কোনো রুশ জাহাজ বাধাপ্রাপ্ত হলে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়।
জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার এই পরস্পর বিরোধী ঘোষণায় একটি বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে জাতিপুঞ্জের সেক্রেটারি জেনারেল উ-থান্ট ও তৃতীয় বিশ্বের জোট নিরপেক্ষ দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডি ও রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ক্রুশ্চেভের কাছে শান্তি রক্ষার আবেদন জানায়।
এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ক্রুশ্চেভ কিউবা থেকে রকেট উৎক্ষেপণ ঘাঁটি অপসারিত করেন এবং কেনেডি তাঁর নৌ-অবরোধ তুলে নেয় এবং ভবিষ্যতে কিউবা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেন। উভয় রাষ্ট্রপ্রধানের এই শুভবুদ্ধির জন্য পৃথিবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদমুক্ত হয়।
গুরুত্ব:
কিউবা সংকটের স্থায়িত্ব খুব অল্প দিনের হলেও এর গুরুত্ব অসাধারণ। কিউবা সংকট আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শাপে বর হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনায় দুই মহাশক্তি বুঝতে পেরেছিল যে, কত সহজে আণবিক যুদ্ধ শুরু করা যায় এবং তার পরিণতি কী হতে পারে।
সুতরাং এই ঘটনার পরে উভয় পক্ষের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের যে উন্মাদনা চলছিল তা অনেকাংশে প্রশমিত হয়। কিউবা সংকট উভয় মহাশক্তিকে কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং তারা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের পথ গ্রহণ করে।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়া, আমেরিকা ও ব্রিটেনের মধ্যে যে আণবিক বোমা পরীক্ষার ওপর বাধানিষেধ আরোপ করে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা কিউবা সংকটের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। দাঁতাতের প্রক্রিয়া শুরু হয়।