কোরিয়া যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
Rate this post

চিন ও জাপানের মধ্যবর্তী ছোটো উপদ্বীপ কোরিয়া বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে তার স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল।

১৯১১-তে এই স্বাধীন উপদ্বীপটি জাপানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের কায়রো সম্মেলন এবং পরে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের পটসডাম সম্মেলন থেকে কোরিয়াকে স্বাধীনতা দানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।

কিন্তু যুদ্ধান্তে তা কার্যকরী হয়নি। কোরিয়ায় জাপানি সেনা পরাজিত হয়ে উত্তরাংশ রাশিয়ার এবং দক্ষিণাংশ আমেরিকার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ফলে কোরিয়া ৩৮° সমাক্ষরেখা দ্বারা দুভাগে ভাগ হয়ে যায়।

ফলস্বরূপ উত্তরাংশে রুশ বাহিনী এবং দক্ষিণাংশে মার্কিন বাহিনীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার দাবি তো ছিলই, তার মধ্যে এবার যুক্ত হল অখণ্ডতার দাবি।

দক্ষিণ কোরিয়া ছিল কৃষি প্রধান এবং উত্তর কোরিয়া ছিল শিল্প প্রধান। তাই কোরিয়ার সামগ্রিক উন্নতির জন্য দুই কোরিয়ার ঐক্য অপরিহার্য ছিল, কিন্তু এ ব্যাপারে বাধা ছিল দুই দেশের প্রহরারত সামরিক বাহিনী।

আর পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক আদর্শের অনুগামী দুটি রাষ্ট্রের বাহিনী উপস্থিত থাকায় কোরিয়ার সমস্যা জটিল হয়ে ওঠে।

কোরিয়ার সমস্যা ও জাতিপুঞ্জ :

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়া-সংক্রান্ত বিষয়টি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (U.N.O.) সাধারণ সভায় উত্থাপন করে। এই উদ্দেশ্যে সাধারণ সভা ৯জন সদস্য নিয়ে একটি কোরিয়া বিষয়ক অস্থায়ী কমিশন গঠন করে।

বিশিষ্ট ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে.পি.এস. মেনন এই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। কোরিয়া থেকে বিদেশি সৈন্য অপসারণ এবং শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে কোরিয়াতে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব এই কমিশনের ওপর অর্পিত হয়।

কোরিয়া দুই বিবদমান রাষ্ট্রবিভক্ত :

সোভিয়েত রাশিয়া উত্তরাংশে কমিশনের সদস্যদের ঢুকতে দেয়নি। এদিকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়ার দক্ষিণাংশে কমিশনের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত সিংম্যান-রী-এর নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয় এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নাম হয় ‘প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া’।

জাতিপুঞ্জ এই সরকারকে সমগ্র কোরিয়ার একমাত্র বৈধ সরকার বলে স্বীকৃতি জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কোরিয়া প্রজাতন্ত্রকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় ও নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে।

এর জবাবে ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বর মাসে কমিউনিস্ট নেতা কিম-উল-সুং-এর নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়ায় একটি সোভিয়েত অনুগামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নবগঠিত এই রাষ্ট্রের নাম হয় ‘জনগণতান্ত্রিক কোরিয়া’। সোভিয়েত রাশিয়া এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 1948 সালের বার্লিন সংকটের বিবরণ

কোরিয়া যুদ্ধের সূচনা :

১৯৫০-এর জুন মাসে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের পরামর্শদাতা জন ফস্টার ডালেস (John Foster Dulles) দক্ষিণ কোরিয়ার আইন সভায় এক ভাষণে সাম্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।

এর পরেই ২৫ জুন কোরিয়ার সেনাবাহিনী ৩৮° অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধের সূচনা করে।

সঙ্গে সঙ্গে জাতিপুঞ্জের কোরিয়া-সংক্রান্ত কমিশন উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করে। জাতিপুঞ্জ চিনের অন্তর্ভুক্তি প্রশ্নে সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৫০-এর জানুয়ারি থেকে জাতিপুঞ্জের সকল সভার অধিবেশন বয়কট করছিল।

এই অবস্থার সুযোগে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করে মার্কিন সেনাপতি ম্যাক আর্থারকে দায়িত্ব দিয়ে জাতিপুঞ্জ কোরিয়াতে সৈন্য পাঠায়।

জাতিপুঞ্জের বাহিনীতে ষোলোটি দেশ সৈন্য পাঠালেও অধিকাংশ সৈন্যই ছিল আমেরিকার সৈন্য। কার্যত আমেরিকান সেনাবাহিনী জাতিপুঞ্জের পতাকাতলে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে থাকে।

যুদ্ধের প্রথম পর্যায় :

জাতিপুঞ্জের বাহিনী ঠিকমতো কাজ শুরু করার পূর্বেই উত্তর কোরিয়ার বাহিনী দ্রুতগতিতে সাফল্য অর্জন করতে থাকে। তারা দক্ষিণ কোরিয়ার ৯৫ ভাগ এলাকা দখল করে নেয়।

দ্বিতীয় পর্যায় :

১৯৫০-এর ৯ই অক্টোবর জাতিপুঞ্জের বাহিনী ৩৮° অক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ করে। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে সমগ্র উত্তর কোরিয়া দখল করে।

জাতিপুঞ্জের বাহিনী জাতিপুঞ্জের নিষেধ ও ভারতের চিনে অবস্থানরত রাষ্ট্রদূত কে.এস. পানিক্করের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে জয়ের আনন্দে চিন সীমান্তে ইয়ালু নদীর তীরে উপস্থিত হয় এবং সন্নিহিত অঞ্চলে বোমা বর্ষণ শুরু করে।

তৃতীয় পর্যায় :

চিন সীমান্তে বোমা বর্ষণ শুরু করলে চিন আক্রান্ত হওয়ার আগেই মাও-সে-তুং এর নির্দেশে সোভিয়েত মদতপুষ্ট চিনা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী জাতিপুঞ্জ বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

চিন ও রাশিয়া উত্তর কোরিয়াতে প্রচুর অস্ত্র ও সেনা পাঠায়। চিনের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর তীব্র আক্রমণে জাতিপুঞ্জের বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে পিছু হটে।

চিনা বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল দখল করে। এইভাবে কোরিয়া ছেড়ে চিন-মার্কিন যুদ্ধের আশঙ্কায় রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান প্রমাদ গুনতে থাকে।

যুদ্ধ বিরতি ও যুদ্ধবন্দি প্রত্যার্পণ সমস্যা :

অবশেষে ট্রুম্যান ম্যাক আর্থারকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল ম্যাথিউ বি. বিরজওয়ে- কে জাতিপুঞ্জ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করেন। এর পর যুদ্ধের গতি মন্থর হয়। এ সময় রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে আবার ফিরে আসে ।

অবশেষে রাশিয়ার উদ্যোগে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে জুলাই বিভক্ত অবস্থায় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘটে। যুদ্ধবিরতির পর যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যার্পণের ব্যাপারটা বড়ো সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রস্তাব অনুসারে এবং ভারতের জেনারেল মিথাইয়া-র সভাপতিত্বে যুদ্ধবন্দি প্রত্যার্পণের জন্য নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের একটি কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের প্রচেষ্টায় যুদ্ধবন্দি বিনিময় সমস্যার সমাধান হয়।

ফলাফল :

  • (১) কোরিয়ার যুদ্ধ ছিল একটি নিষ্ফল যুদ্ধ। এই যুদ্ধের আপাত উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কোরিয়া দ্বিখণ্ডিতই থেকে যায়
  • (২) এই যুদ্ধ উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছিল। অসংখ্য লোক ক্ষয় ও সম্পদ বিনষ্ট হওয়ায় উভয় রাষ্ট্রের অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়।
  • (৩) এই যুদ্ধে চিন যে সামরিক শক্তি ও কুশলতার পরিচয় দিয়েছিল তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চিনকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা বেশিদিন সম্ভব হয়নি।
  • (৪) এই যুদ্ধের ফলে ঠান্ডা লড়াই-এর রাজনীতি ইউরোপ থেকে এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয়।
  • (৫) এই যুদ্ধের সূত্র ধরে চিন ও সোভিয়েত রাশিয়া পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে। ফলে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
  • (৬) কোরিয়া যুদ্ধে জাতিপুঞ্জের কিছুটা মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল।
  • (৭) কোরিয়া যুদ্ধের ফলে ইউরোপে মার্কিন বাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও কয়েকটি সামরিক জোট গড়ে তোলে।

কোরিয়া যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা

কোরিয়া যুদ্ধে কিছু দিন আগে স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারতবর্ষের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এই যুদ্ধে কোন পক্ষ না নিয়ে একজন মধ্যস্থতাকারী এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রদানকারী হিসেবে সাহায্য চালিয়ে যায়।

ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে কূটনৈতিক সু-সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য 1950 সালে অ্যাম্বুলেন্স সহ একটি মেডিকেল ইউনিটকে কোরিয়ায় পাঠান।

1953 সালে কোরিয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পিছনে জাতিসংঘের ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্ববাসীর কাছে ভারতের একটি উদার ভাবমূর্তি প্রকাশ পায়।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment