ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ ও ফলাফল । Great Bengal Famine in Bengali

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
3.7/5 - (12 votes)

এই আর্টিকেলের মাধ্যমে বাংলার কলুষিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং মহামারী ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করবো। ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং সরকারের অত্যাধিক শোষণের শেষ পরিণতি ছিল এই দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং লেখকদের বর্ণনায় এই দুর্ভিক্ষের করুন পরিণতি স্পষ্ট ভাবে লক্ষিত হয়। নিচে ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা করা হল।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কি?

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের জানতে হবে যে 1770 খিষ্টাব্দে এবং বাংলায় 1176 সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলায় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তা বাংলার ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। যেটি ছিল 18 শতকের সবথেকে গুরুতর অর্থনৈতিক মন্দা।

কর আদায়ের নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণ ও লুটপাট, 1768-1769 সাল পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হবার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। বাংলায় 1176 সালে এই দুর্ভিক্ষ হবার কারণে একে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়। এই দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক পরিণতি হল মানুষ এবং পশু উভয়ের অগণিত প্রাণনাশ।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ ফলাফল

great bengal famine of 1770
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছবি

শাসনতান্ত্রিক ও রাজস্ব ব্যবস্থার চরম দুর্গতির পরিণতি হিসেবে ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় এক বিপর্যয়-সৃষ্টিকারী দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বাংলা ১১৭৬ সনে এই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় বলে ইতিহাসে এটি ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বলে সমধিক পরিচিত।

এই দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল অনাবৃষ্টি। আর এর পরোক্ষ কারণ ছিল ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ কর্তৃক প্রবর্তিত দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। কোম্পানীর রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচারে বাংলার কৃষকগণ কপর্দক শূন্য হয়ে পড়ে।

এর ফলে বহু কৃষি জমি অনাবাদী থেকে যায় এবং খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়। ১৭৭০ খ্রীঃ-তে খাদ্যাভাব চরম দুর্ভিক্ষের আকার ধারণ করে।

হান্টারের রচিত Annals of Rural Bengal গ্রন্থে এই মন্বন্তরের এক মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যায়: “১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দের প্রচণ্ড গ্রীষ্মে মানুষ মরিতে লাগিল। কৃষকেরা তাহাদের গরু বিক্রয় করিল, লাঙল বিক্রি করিল, চাষের বীজ খাইতে লাগিল, তাহাদের ছেলেমেয়ে বিক্রি করিল।

শেষে ছেলেমেয়ের ক্রেতাও দুর্লভ হইল তাহারা খাদ্যাভাবে গাছের পাতা ও মাঠের ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল এবং শেষে মৃতদেহ ভক্ষণ করিতে লাগিল।”

এই দুর্ভিক্ষের ফলে বাংলার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়। কিন্তু এই নিদারুণ মন্বন্তরের সময়ও কোম্পানী দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষদের নিকট থেকে রাজস্ব আদায়ে কোনপ্রকার শৈথিল্য দেখায় নি (“In spite of the distress the revenue was collected with cruel severity.”-V. Smith) ।

এই দুর্ভিক্ষের ফলে রাজ্যের শান্তি ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং তার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়। জনগণের নৈতিক মান এবং সমাজজীবনের প্রভূত ক্ষতি হয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিলাতস্থিত কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারেন যে, দ্বৈত শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রত্যক্ষভাবে রাজ্যের শাসন-সংক্রান্ত দায়িত্ব গ্রহণ ভিন্ন অন্য কোন পথ নেই।

এরূপ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈত শাসনব্যবস্থার বিলোপসাধন করেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এই দুর্ভিক্ষকে পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস সুলতানী আমল

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কেন ঘটেছিল?

who was responsible for bengal famine
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ছবি

বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ঘটার পিছনে একাধিক কারণ লক্ষ্য করা যায় যার মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হল সরকারের শোষণ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়। নিচে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ গুলি বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

জলবায়ু পরিবর্তন

1768 থেকে 1769 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের ঠিক আগে বাংলা ও বিহার জুড়ে ভয়াবহ খরা দেখা দেয়। অনিয়মিত ও অল্প বৃষ্টির কারণে ফসল উৎপন্ন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলাবাসী জল ও খাদ্য সংকটের মধ্যে পরে।

দ্বৈত শাসনের প্রভাব

বাংলায় নিযুক্ত দুই গভর্নর ভেরেস্ট (১৭৬৭-৬৯ খ্রি.) এবং কার্টিয়ার (১৭৬৯-৭২ খ্রি.) তারা সুষ্ঠ ভাবে প্রশাসন চালাতে ব্যর্থ হয়। কারণ তাদের আমলে কুখ্যাত নৈরাজ্য ও শোষণের শাসন ব্যবস্থা দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার প্রচলন হয়।

মাত্রাধিরিক্ত করের বোঝা

অনাবৃষ্টি হবার সত্বেও যেখানে ১৭৬৮ খৃষ্টাব্দে বাংলা রাজস্ব ছিলাে ১,৫২০৪৮৫৬ টাকা এবং দুর্ভিক্ষের ঠিক পরে অর্থাৎ ১৭৭১ খৃষ্টাব্দে কর বেড়ে হয় ১,৫৭২৬৫৭৬ টাকা। যা শাসক গোষ্ঠীর কঠর নীতি পরিলক্ষিত হয়।

সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত

সরকার জনগনের জন্য খাদ্য সঞ্চয় না করে কেবল মাত্র সৈন্যদের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করে রেখে ছিল। কয়েক বছর চাষ না হবার কারণে খাদ্য অভাব দেখা দিলে কিছু অসাধু ব্যাবসায়ী বেশি দামে খাদ্য বস্তু বিক্রয় করবে বলে খাদ্য বস্তু বেআইনী ভাবে মজুত করে রাখে, সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো রকম কঠোর শাস্তি মূলক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলাফল

bengal famine 1770
  • ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের করুন পরিণতি হল খাদ্যাভাবে বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়।
  • বাংলা প্রশাসনিক, সামাজিক এবং  অর্থনৈতিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
  • দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হবার কারণে পানীয় জলের অভাবও দেখা যায়। যার ফলে মানুষের তৃস্না নিবারণ বা চাষবাসের জন্য জল সংকট সব থেকে বড় সংকট হয়ে ওঠে।
  • যেখানে কম জল পাওয়া যাচ্ছিল, সেখানে জল দূষণ -এর কারণে নানান রোগের উপদ্রোপ বেড়ে যায়।
  • বহু মানুষের প্রাণনাশের ফলে চাষবাস করা মানুষের অভাব দেখা যায় তাই অনেক জমি জঙ্গলে পরিণত হয় ।
  • সমাজের বন্ধু যেমন কামার, কুমাের, ছুতোর, তাঁতি, কৃষক প্রভৃতি মানুষের ব্যাপক মৃত্যুর ফলে এই সমস্ত কাজকর্ম করার লোকের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
  • দক্ষ কারিগরের অভাবে বাংলার সুনাম ধন্য বস্ত্রশিল্প প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়।
  • দেশের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়, চারিদিকে অরাজগতার সৃষ্টি হয়, চুরি ডাকাতির  উপদ্রোপ অনেকটা বেড়ে যায়।
  • গ্রামে থেকে লোকজন শহরে চলে যায়, যার ফলে প্রচুর গ্রাম জনশূন্য হয়ে পরে এবং শহরে মানুষের চাপ বাড়তে থেকে।

FAQs ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

প্রশ্ন: ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় বাংলার নবাব কে ছিলেন?

উত্তর: ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ে বাংলার কোনো নবাব ছিল না, কারণ তখন বাংলার শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়ার হাতে কোম্পানির ন্যস্ত ছিল।

প্রশ্ন: ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কত সালে হয়েছিল?

উত্তর: ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ইংরাজিতে 1770 খিষ্টাব্দে এবং বাংলায় 1176 বঙ্গাব্দে ঘটে ছিল।

প্রশ্ন: ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় বাংলার গভর্নর কে ছিলেন?

উত্তর: ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় বাংলার গভর্নর ছিলেন জন কর্টিয়ার (১৭৬৯-৭২ খ্রি.)।

প্রশ্ন: ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে কোন উপন্যাসে?

উত্তর: ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে।

প্রশ্ন: বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কবে হয়েছিল?

উত্তর: বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর 1176 বঙ্গাব্দে হয়েছিল।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সারা বাংলা সহ বিহারের বেশ কিছু অংশ সরাসরি প্রবাহিত হয়েছিল। ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষকে অনেকে ১৭৭৬ সালের দুর্ভিক্ষ ভেবে ভুল করে থাকে, আসলে বাংলায় 1176 বঙ্গাব্দে এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে একে ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ বলা হয়।

এই দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়, যা ছিল বাংলার প্রথম ভয়াবহ প্রাণহানি। ১৭৭০ সালের আগে বা পরে, বাংলার সমস্ত মানুষের পরিসংখ্যার নিরিখে এতো মানুষের প্রাণহানি এর আগে কখনো হয়নি।

তাই ইতিহাসের পাতায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছিল বাংলার একটি ভয়াবহ অভিশপ্ত অধ্যায়, যেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং তার সঙ্গে ছিল ব্রিটিশদের অমানবিক অত্যাচার যা বাংলা বাসীকে অতিষ্ট করে তুলেছিল। এর শেষ পরিণতি ছিল অনেক মানুষের প্রাণহানি।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment