মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস সুলতানী আমল

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
Rate this post

শাসনব্যবস্থ। (Administrative system):

এক নজরে

এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস সুলতানী আমল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। ভারতীয় ইতিহাসে সুলতানি আমল বলতে ১৩০০ থেকে ১৬০০ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম শাসন কালকে বোঝানো হয়।

ঘুরিদ রাজবংশের একজন বিশ্বস্ত সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবক দ্বারা 1206 সালে ভারতে সুলতান বংশের প্রতিষ্ঠান লাভ করে। 1526 সালে পানিপথের যুদ্ধে বাবরের কর্তৃক সুলতান ইব্রাহিম লোদির পরাজয়ের পর ভারতে সুলতান সাম্রাজ্যের অবসান হয়। চলুন জানা যাক মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস সুলতানী আমল কেমন ছিল।

বিজয়ী মুসলীম শক্তি

ভারতবর্ষে মুসলমানগণ আসিয়াছিল বিজয়ী রূপে; হিন্দুগণের সামরিক শক্তিকে পর্যুদস্ত করিয়া, সমগ্র দেশবাসীকে পদানত করিয়া তাহারা তাহাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল।

দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করিতে ও তাহাদের রাজনৈতিক প্রভুত্ব দেশবাসীর উপর স্থাপন করিতে সক্ষম হইলেও হিন্দু রাজগণ, শক্তিশালী জমিদারগণ সে আধিপত্যকে অনায়াসে মানিয়া লইতে রাজী হয় নাই; তাই মুসলমান সুলতানগণকে এবং তাঁহাদের শাসনকর্তাগণকে সব সময়েই তাহাদের বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হইতে হইয়াছে।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 আকবরের মনসবদারি প্রথা সহ বিভিন্ন সামাজিক ও প্রশাসনিক সংস্কার

আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিরুদ্ধতার সম্মুখীন

কেবলমাত্র এই আভ্যন্তরীণ বিরুদ্ধতা নহে, বহির্দেশ হইতে মোঙ্গলগণের বারংবার আক্রমণের বিরুদ্ধেও তাহাদিগকে সদা সতর্ক থাকিতে হইত। সুতরাং ভারতের মুসলমান সুলতানগণকে ও তাঁহাদের শাসনকর্তাগণকে সামরিক শক্তির দিকে সর্বদা নজর দিতে হইয়াছে।

সিংহাসনের জন্য অন্তর্দ্বন্দ্ব

তাহা ছাড়া, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন না থাকায় সিংহাসনে আরোহণের জন্য প্রত্যেককেই ক্ষমতার লড়াইয়ে জয়যুক্ত হইতে হইত।

সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীলতা

এই সমস্ত অবস্থা ভারতের সুলতানগণকে সম্পূর্ণভাবে সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল করিয়া তুলিয়াছিল এবং তাহাদের সৃষ্ট শাসনব্যবস্থাও ছিল সময় ভিত্তিক ।

স্বৈরাচারী সুলতান:

Sultanate period in bengali

খলিফার সহিত সম্পর্ক

দিল্লীর সুলতানি আমলে সুলতান ছিলেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী, রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিপতি। ইসলাম ধর্মনীতি অনুসারে বাগদাদের খলিফা ছিলেন মুসলমান জগতের একমাত্র অধিকর্তা। জগতের যে কোন স্থানের মুসলমান শাসকগণ ছিলেন তাঁহার প্রতিনিধিস্বরূপ।

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র

দিল্লীর সুলতানগণের মধ্যে কেহ কেহ তাঁহার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করিলেও তাহা ছিল নিতান্তই মৌখিক। প্রকৃত পক্ষে তাঁহারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী হিসাবেই শাসন করিতেন । অন্যান্য মুসলমান রাষ্ট্রের ন্যায় দিল্লীর সুলতানিকেও ধর্মাশ্রয়ী (Theocratic) রাষ্ট্র বলিয়া অভিহিত করা হইয়া থাকে।

কোরাণের অনুশাসন

সুলতান ছিলেন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক স্বরূপ; অবশ্য একই সঙ্গে সম্রাট ও ধর্মগুরু বলিয়া নিজদিগকে স্বীকৃত করাইয়া লওয়া সব সময়ে তাঁহাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই।

ইসলামের বিধি নিষেধ দ্বারা তাহাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হইবার কথা; কিন্তু কোরাণের অনুশাসনের প্রতি সুলতানকে বাধ্য রাখার মত কোন উপযুক্ত শক্তি বা শাসনতন্ত্র দেশে ছিল না ।

সুলতানের স্বৈরাচার (সুলতান পদ মনোনয়ন ও নির্বাচন)

সুলতানগণ ছিলেন সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী। তাঁহারা একাধারে ছিলেন সর্বোচ্চ শাসনকর্তা, সেনাপতি, আইন প্রণেতা এবং সর্বোচ্চ বিচারক। সুলতানগণ ছিলেন বংশানুক্রমিক; কিন্তু এবিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায়, সুলতানগণ তাঁহাদের উত্তরাধিকারী মনোনীত করিয়া যাইতেন।

মাঝে মাঝে অকর্মণ্য সুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া শক্তিশালী অভিজাতবর্গ নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে সুলতান নির্বাচিত করিতেন।

সামন্ততান্ত্রিক শাসন – ব্যবস্থা

সমগ্র শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি ছিল সামন্ততান্ত্রিক। অভিজাত শ্রেণী হইতেই প্রাদেশিক শাসনকর্তা, সামরিক নেতা ও উচ্চ রাজকর্মচারী নিযুক্ত হইতেন; তাঁহারা জায়গীর ভোগ করিতেন এবং যথেষ্ট শক্তির অধিকারী হইতেন।

সুলতানের এবং কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা দেখা দিলেই তাঁহারা স্বাধীন হইয়া উঠিতেন । সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইহাই ছিল সহজাত ত্রুটি।

কেন্দ্রীয় শাসন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী ও পরিষদ

সুলতানি শাসনব্যবস্থাকে প্রধানতঃ দুইটি ভাগে ভাগ করা যাইতে পারে— কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক। কেন্দ্রে স্বৈরাচারী শাসক সুলতান অভিজাতবর্গ হইতে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী নিযুক্ত করিয়া শাসনকার্য নির্বাহ করিতেন।

‘মজলিস-ই-খালওয়াৎ’ নামে সুলতানের বিশ্বস্ত অনুচরদের দ্বারা গঠিত একটি পরিষদ ছিল; সুলতানকে পরামর্শ দেওয়াই তাহার কাজ ছিল, অবশ্য সুলতান ইহার পরামর্শ গ্রহণ করিতে বাধ্য ছিলেন না।

বিভিন্ন মন্ত্রী ও শাসন-বিভাগ

সুলতান অভিজাত শ্রেণী হইতে ওয়াজীর (প্রধানমন্ত্রী) এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিযুক্ত করিয়া শাসনকার্য পরিচালনা করিতেন। ক্রমে ‘দেওয়ান-ই- ওয়াজীর’ (রাজস্ববিভাগ), ‘দেওয়ান-ই-আরজ’ (সমর- বিভাগ), ‘দেওয়ান-ই-ইনশা’ (পত্রাদি প্রেরণ বিভাগ), “দেওয়ান-ই-রিয়াস’ (কৃষি বিভাগ) প্রভৃতি বিভাগের উৎপত্তি হইয়াছিল ৷

বিচার ব্যবস্থা

‘কাজী-উল-কাজাৎ’ (প্রধান বিচারপতি) ছিলেন বিচার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত। তাঁহার অধস্তন অন্যান্য বিচারকের সাহায্যে তিনি দেশে বিচার- কার্য পরিচালনা করিতেন। মুফতিগণ বিচারপতিগণকে কোরাণের আইন বিশ্লেষণে সাহায্য করিতেন।

জমি-সংক্রান্ত বিবাদ- বিসম্বাদের বিচার অবশ্য রাজস্ব বিভাগের কর্মচারিগণ দ্বারাই নিষ্পন্ন হইত । দণ্ডবিধি সাধারণতঃ কঠোর ছিল।

রাজস্ব সংগ্রহের বিভিন্ন পন্থা

সুলতানি আমলে হানাফি-নীতি (Hanafi School) অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হইত;

  • (ক) মুসলমানদের নিকট হইতে ‘জাফাৎ’ বা ধর্মকর,
  • (খ) হিন্দুদের নিকট হইতে ‘খারাজ’ বা ভূমি কর,
  • (গ) ‘খামস’ অর্থাৎ যুদ্ধের সময় লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক- পঞ্চমাংশ,
  • (ঘ) অমুসলমানদের নিকট হইতে ‘জিজিয়া’ প্রভৃতি ছিল রাজকোষে অর্থাগমের উৎস।

সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব

এই সকল রাজস্ব ও কর ভিন্ন গোচারণ কর, ফল কর, আবওয়ার বা অতিরিক্ত কর প্রভৃতিও আদায় হইত ৷ সুলতানি আমলে রাজস্ব নীতি কোন নির্দিষ্ট ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না ।

প্রথমদিকে হিন্দু আমলের নীতিই অনুসৃত হইতেছিল । পরে আলাউদ্দিন, মহম্মদ তুঘলক প্রমুখ সুলতানগণ বিভিন্ন ভাবে তাহার সংস্কার সাধনের চেষ্টা করিয়াছিলেন ।

সেনাবাহিনী

সুলতানগণকে এক বিশাল সেনাবাহিনী পোষণ করিতে হইত। পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তীবাহিনী প্রভৃতি লইয়াই তাঁহাদের বাহিনী গঠিত ছিল। অশ্বারোহী বাহিনী ছিল সব চেয়ে বেশী কার্যকরী।

সৈন্যবাহিনীতে কিছু হিন্দুও ছিল, তবে বেশীরভাগই ছিল বিদেশী মুসলমান । তাহাদের নায়কগণ ছিল অভিজাত বংশীয় ব্যক্তি, তাহারা প্রয়োজনের সময় সৈন্য সরবরাহের অঙ্গীকারবদ্ধ হইয়া জায়গীর ভোগ করিত।

সেনাবাহিনী সংগঠনে দুর্বলতা

আলাউদ্দিন সর্বপ্রথম জায়গীরদারদের উপর নির্ভর না করিয়া স্থায়ী সৈন্যবাহিনী গঠন করিয়াছিলেন; অবশ্য ফিরোজ তুঘলক আবার সামন্ত প্রথাকেই সৈন্যবাহিনীর ভিত্তি হিসাবে অবলম্বন করিয়াছিলেন। ইহা নিঃসন্দেহে সুলতানি শক্তির সংহতি বিনষ্ট করিয়াছিল। সুলতানগণ একটি গুপ্তচর বাহিনীর সাহায্যে বিভিন্ন খবরাদি সংগ্রহ করিতেন ।

প্রাদেশিক শাসন শাসনকর্তার স্থান

শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র সুলতানি সাম্রাজ্যটি কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল এবং এই প্রদেশগুলির শাসনকার্য প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের হস্তে ন্যস্ত থাকিত।

কেন্দ্রের শাসনব্যবস্থায় সুলতান যে স্থান অবলম্বন করিতেন, প্রদেশে শাসনকর্তাগণ প্রায় অনুরূপ স্থান অধিকার করিতেন। তিনি ছিলেন শাসনব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে সর্বময় কর্তা।

শিকে, পরগণা ও গ্রাম

কেবলমাত্র প্রাদেশিক রাজস্ব হইতে শাসন পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ করিয়া অবশিষ্টাংশ কেন্দ্রীয় রাজকোষে পাঠাইলেই সুলতান সন্তুষ্ট হইয়া আর কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতেন না। প্রদেশগুলি আবার ‘শিকে’ (Shiqus) এবং ‘পরগণায়’ বিভক্ত ছিল। সর্বনিম্নে ছিল গ্রাম ।

সহর অঞ্চলে শান্তিরক্ষা গ্রাম্য স্বায়ত্তশাসন

সহর অঞ্চলগুলিতে শাস্তি রক্ষার ভার ছিল কোটোয়ালের উপর । পুলিশবাহিনীর এবং বিভিন্ন কর্মচারীর সাহায্যে তিনি সহরে শাস্তি রক্ষা করিতেন। বিদেশীর উপর নজর রাখিতেন। সুলতানি শাসনে দেশের গ্রাম্য জীবনে বিশেষ কোন পরিবর্তন হয় নাই।

প্রাচীন পল্লী সমাজ ব্যবস্থায় যেটুকু স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ ছিল তাহার উপর কোন হস্তক্ষেপ করা হয় নাই । গ্রাম্য এলাকার বিচার ও শাসনভার ছিল গ্রাম্য পঞ্চায়েতের উপর ন্যস্ত; গ্রাম্য চৌকিদারই গ্রামে পুলিশের কাজ করিত ৷

বেসামরিক শাসন-ব্যবস্থার অভাব

সুলতানি আমলের শাসনব্যবস্থা বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায় যে তখন কোন সুনিয়ন্ত্রিত বে-সামরিক শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না। সামরিক কার্যকলাপ লইয়াই রাষ্ট্রের ব্যস্ততা ছিল বেশী। রাজশক্তির কেন্দ্র ছিল সেনানিবাস ও দুর্গগুলি।

মাঝে মাঝে, সুলতান দুর্বল হইলে বা আভিজাতবর্গ শক্তিশালী হইয়া উঠিলে শাসনক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। শাসন ব্যাপারে জনসাধারণের সমর্থন বা শুভেচ্ছা অর্জন করার কোন প্রচেষ্টাই কোথাও ছিল না ।

সামাজিক অবস্থা (Social Condition):

history of sultanate period

মূসলমানগণের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষা

মুসলমান আক্রমণের পূর্বে গ্রীক, শক, তূণ প্রভৃতি বহু জাতি ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াছিল; কিন্তু কালক্রমে তাহারা তাহাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র সত্ত্বা হারাইয়া ভারতবাসীর মধ্যে মিশিয়া গিয়াছিল।

কিন্তু মুসলমান আক্রমণকারীদের ক্ষেত্রে ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায়। তাহারা তাহাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াই এদেশে বসবাস করিতে আরম্ভ করে। ইহার কয়েকটি কারণ ছিল।

স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে-পারার কারণ

মুসলমানরা ছিল বিজয়ী, সুতরাং গর্বিত এবং অহঙ্কারী, আর হিন্দুরা ছিল রাজনীতিগত ভাবে তাহাদের পদানত। ধর্মের দিক দিয়া তাহারা ছিল একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী এবং পৌত্তলিক হিন্দুদের সম্বন্ধে তাহাদের ছিল একটি বিতৃষ্ণার ভাব। তাহাদের অনেকেই ছিল ধর্মান্ধতায় ভরা, হিন্দুদের জোর করিয়া ধর্মান্তরিত করা তাহারা তাহাদের পবিত্র কর্তব্য বলিয়া মনে করিত।

রাজনৈতিক ও ধর্ম বিষয়ে পার্থক্য (মুসলিম সংস্কৃতি)

হিন্দু মন্দির ধ্বংস এবং তাহাদের ঐশ্বর্য লুণ্ঠন প্রভৃতিও এই ব্যবধান সৃষ্টিতে সাহায্য করিয়াছিল। এ কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মুসলমানগণ যখন বিজয়ীরূপে এদেশে প্রবেশ করে তখন তাহাদের একটি সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিয়াছে; ‘ইসলামের গণ্ডির অন্তর্ভুক্ত সকলের মধ্যে ছিল একটি ভ্রাতৃভাব, তাহাদের সামাজিক রীতিনীতির মধ্যেও একটি গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব ছিল। এই সমস্তই মুসলমান সমাজকে সংহত করিয়া রাখিতে সাহায্য করিয়াছে ।

হিন্দু সমাজে প্রতিক্রিয়া

অপরপক্ষে মুসলমানদের আক্রমণ ও প্রভাবের প্রতিক্রিয়া হিসাবে হিন্দুসমাজে দেখা দিয়াছিল রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতা ফলে উভয়ের মিলনের পথে অব্যম্ভাবীরূপে বাধার সৃষ্টি হইয়াছিল। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এদেশের সমন্বয়ী শক্তি একেবারে ব্যর্থ হয় নাই।

দীর্ঘকাল পাশাপাশি বসবাস করার ফলে পরস্পর পরস্পরকে কতক পরিমাণে প্রভাবান্বিত করিয়াছিল; এবং উভয়ের সংস্কৃতির সংমিশ্রণে অনেক ক্ষেত্রে নূতন সংস্কৃতির নব উন্মেষ দেখা গিয়াছিল ৷

পরস্পরের সামাজিক জীবনের উপর প্রভাব

হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পার্থক্য যতই থাকুক না কেন তাহাদিগকে এদেশে পাশাপাশি বাস করিয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন যাপন করিতে হইয়াছিল। ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল- স্বরূপ তাহাদের সামাজিক জীবনও পরস্পরের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিল ৷

হিন্দুগণের সামাজিক জীবন যতই বেশী রক্ষণশীল ও সংকীর্ণ হইয়া উঠিতেছিল, ততই নিষ্পেষিত সমাজের নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান সমাজের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিতে লাগিল ৷ তাহারা মুসলমান সমাজের মধ্যে হিন্দুর আচার-আচরণ বহন করিয়া লইয়া গেল।

মুসলমান সমাজে পরিবর্তন

সুলতানগণ অনেকে হিন্দুপত্নী গ্রহণ করিবার ফলে ও হিন্দু আচার-ব্যবহার অনেকখানি মুসলমান সমাজে প্রবেশ করিবার সুযোগ সৃষ্টি হইয়াছিল। ক্রমে হিন্দু সাধু সন্তদের মত মুসলমান সমাজেও পীরদের উদ্ভব হইয়াছিল। বিবাহাদি ব্যাপারে মুসলমান সমাজেও শ্রেণীগত বৈষম্য দেখা দিল ।

হিন্দু সমাজেও পরিবর্তন রক্ষণশীলতা বৃদ্ধি

হিন্দু সমাজেও নানা পরিবর্তন দেখা দিতে লাগিল । মুসলমান আধিপত্য স্থায়ী হইবার ফলে তাহারা হইয়া পড়িয়াছিল ‘জিম্মি‘ (Zimmi) অর্থাৎ মুসলমান রাষ্ট্রে অ-মুসলমান প্রজা কতকগুলি সর্তাধীনে বসবাস করিবার অধিকারী।

ইসলামীয় আইন-বিশারদের মতে, “He who pays the Jezyah and obeys the ‘Mahammadan State is called Zimmi.” সমস্ত রকমভাবে হিন্দু নির্যাতন মুসলমান আইনজ্ঞদের দ্বারা সমর্থিত হইত ।

 “I have heard you have degraded the Hindus to such an extent that their wives and children beg their bread at the doors of muslims. You are, in doing so, rendering a great service to religion. All your sins will be pardoned by reason of this single act. All Egyptian jurist to Alauddin.

সমাজে স্ত্রী জাতীর স্থান

এই অবস্থায় হিন্দুদের মধ্যে রক্ষণশীলতা এবং শ্রেণীগত বৈষম্য ও সংকীর্ণতা আরও বৃদ্ধি পাইল । নিজদিগকে রক্ষা করিবার এরূপ ভাবে চেষ্টা করিলেও হিন্দু সমাজে মুসলমান প্রভাব একেবারে রোধ করা গেল না।

পর্দা প্রথা মুসলমান সমাজেরই বৈশিষ্ট্য ছিল; ক্রমে উচ্চশ্রেণীর হিন্দু মেয়েদের ক্ষেত্রেও উহা প্রয়োগ হইতে লাগিল। মুসলমানদের ন্যায় হিন্দু মেয়েরাও সম্পূর্ণভাবে পুরুষদের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িল।

সমাজে ‘সতী’ ও ‘জৌহর’ প্রথাও প্রচলিত ছিল। স্ত্রী জাতির উপর এই সময়ে নানা দিক দিয়া অত্যন্ত কঠোর বিধি নিষেধ আরোপিত হইলেও মোটামুটিভাবে স্ত্রী-জাতিকে সম্মানের চক্ষে দেখা হইত। ইবন বতুতা হিন্দুসমাজের নৈতিকতা ও আতিথেয়তার ভূয়সী প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন।

ক্রীতদাস ব্যবস্থা

সুলতানি আমলে ক্রীতদাসের সংখ্যা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়াছিল; অভিজাত সম্প্রদায় ক্রীতদাস পোষণকে তাহাদের আভিজাত্যের চিহ্ন বলিয়া মনে করিতেন।

অভিজাত শ্রেণীর প্রাধান্য

অভিজাত সম্প্রদায় ছিল সমাজে সবচেয়ে বেশী প্রভাব প্রতিপত্তিশালী, তাহারা বেশীর ভাগই ছিল বিদেশাগত; দেশের মাটির সহিত, জনসাধারণের সহিত তাহাদের কোন যোগাযোগ ছিল না।

সর্বপ্রকার স্বার্থসিদ্ধির জন্যই তাহারা ব্যস্ত থাকিত । সুলতানি আমলের শেষের দিকে মদ্যপান ও ব্যভিচার তাহাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হইয়া উঠিয়াছিল।

হিন্দু সমাজের উপর প্রভাবের স্বরূপ

সর্বশেষে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সামাজিক পরিবর্তনের বেশীরভাগই স্পষ্ট পরিলক্ষিত হইয়াছিল সমাজের উপরের স্তরে, শহর অঞ্চলে। পল্লী অঞ্চলের হিন্দুরা মোটামুটিভাবে পূর্বেকার মতই সামাজিক জীবন যাপন করিয়া যাইতে সক্ষম হইয়াছিল। পরিবর্তনের অতি সামান্য ধারাই তাহাদের স্পর্শ করিয়াছিল ।

অর্থ নৈতিক অবস্থা (Economic condition):

sultanate period rulers

অর্থ নৈতিক কাঠামো অপরিবর্তিত

সমসাময়িক বিবরণ, সাহিত্য, লোকগীতি, বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনা প্রভৃতি হইতে সুলতানি যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে একটি মোটামুটি ধারণা লাভ করা যায়। মুসলমান আক্রমণকারীগণ এদেশে আসিয়া তাহাদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল সত্য কিন্তু এদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর কোন বিশেষ পরিবর্তন সাধন করিতে পারে নাই।

কৃষি- উৎপাদনের জন্য এদেশের চাষীদের উপরই তাহাদিগকে নির্ভর করিতে হইত। ভূমি-ব্যবস্থারও কোন মূলগত পরিবর্তন সাধন তাহারা করে নাই; কেবলমাত্র উপর হইতে অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তিগণ জায়গীর ভোগ করিত।

কৃষি-উৎপাদন ক্ষেত্র

কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়া কোন কোন সুলতান সেচ ব্যবস্থায় কিছুটা উৎসাহ দান করিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু তাহা ছাড়া তাঁহারা সাধারণতঃ এ বিষয়ে আর বিশেষ কোন দায়িত্ব বোধ করিতেন না ৷

স্বাবলম্বী গ্রাম্য অর্থনীতি

গ্ৰাম অঞ্চল মোটামুটিভাবে কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের দিক দিয়া স্বাবলম্বী ছিল এবং গ্রামবাসীগণ সাধারণভাবে অতীত অর্থ নৈতিক ব্যবস্থাকে বজায় রাখিতে পারিয়াছিল। শহর এলাকায় অবশ্য নানারকম শিল্পের উন্নতি ঘটিয়াছিল।

শিল্পোৎপাদন বাংলার বয়নশিল্প

সুলতান ও অভিজাত শ্রেণীর প্রয়োজন মিটাইবার জন্য বয়ন শিল্প এবং অন্যান্য সামগ্রী প্রস্তুতের শিল্পসমূহ যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করিয়া উন্নত হইয়া উঠিয়াছিল ।

আমীর খুসরভ এবং মাহুয়ান, বারথেমা, এডোয়ার্ডো বারবোসা প্রভৃতি বৈদেশিক পর্যটকগণ বাংলাদেশের শিল্প সমূহের, বিশেষ করিয়া বয়নশিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন। “…the richest country is Bengal in world for cotton, ginger, sugar, grain and flesh of every kind. -Barthema.

বহির্বাণিজ্যের প্রসার

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রও মুসলমান আক্রমণের ফলে বিরাট কিছু পরিবর্তন ঘটে নাই । মুসলমান যোদ্ধাগণ বাণিজ্য বিষয়ে অবজ্ঞা পোষণ করিতেন; সুতরাং পূর্বের ব্যবসায়ী শ্রেণীই এক্ষেত্রে তাহাদের প্রাধান্য বজায় রাখিয়াছিল।

এই সময়ে বহির্বাণিজ্যের যথেষ্ট প্রসার হইয়াছিল । ইউরোপের ও এশিয়ার বহুদেশের সহিত জলপথে ভারতের বাণিজ্য ক্রমেই বৃদ্ধি পাইয়াছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বণিকগণ এই সময় হইতেই ভারতের উপকূলে ভিড় জমাইতে থাকে ।

জনসাধারণের অর্থ নৈতিক অবস্থা

কিন্তু সাধারণ জনসাধারণের আর্থিক অবস্থা খুব উন্নত ছিল মনে করিলে ভুল হইবে । সুলতান ও অভিজাত সম্প্রদায় ঐশ্বর্য ও বিলাসিতায় জীবনযাপন করিতেন ; আর দেশবাসীকে তাহাদের অর্থ ও সামগ্রী সংগ্রহ করিতে হইত।

বিরাট করভার, আবওয়াব (অতিরিক্ত কর), আভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের পথে নানা বাধা প্রভৃতি সাধারণ দেশবাসীর জীবন অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত করিয়া তুলিয়াছিল । আমীর খুসরভ কৃষকদের এই অবস্থার সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়া গিয়াছেন ।

 “Every pearl in the royal crown is but the crystallised drop of blood fallen from the tearful eyes of the poor peasants.”-Amir Khusrav.

FAQs

প্রশ্ন: দিল্লির শেষ সুলতান কে ছিলেন?

উত্তর: দিল্লির শেষ সুলতান ছিলেন ইবরাহীম লোদী। তিনি 1517 খিস্টাব্দ থেকে 1526 খিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

প্রশ্ন: দিল্লির কোন সুলতান সর্বপ্রথম খলিফার স্বীকৃতি পান?

উত্তর: খলিফা যার অর্থ ইসলামী বিশ্বাসে নবী মুহাম্মদের উত্তরসূরি। দিল্লির কোনো সুলতানকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

প্রশ্ন: দিল্লির প্রথম সুলতান কে ছিলেন?

উত্তর: দিল্লির প্রথম সুলতান ছিলেন কুতুবুদ্দিন আইবেক (১২০৬ খ্রিস্টাব্দ)।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment