দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনগুলি ও জাতীয়তাবাদের প্রভাব

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
Rate this post

দীর্ঘকাল ধরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল ও নেদারল্যান্ড এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশিক শাসন চালিয়ে আসছিল। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গঠনের উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং এর থেকে সংঘর্ষও বেধে যায়।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণই ছিল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে অবশ্য ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ঘটে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই আন্দোলনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে তাতে শেষ পর্যন্ত তাদেরই জয় হয়েছিল।

অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের জনমত ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। তাছাড়া যুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটেন তার উপনিবেশ গুলিকে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার দেবে বলে আশ্বাস দেয়।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পরাধীন জাতিগুলিকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। আটলান্টিক সনদেও সে কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়।

জাপান পশ্চিমি শক্তির বিরুদ্ধে এশিয়ার জনগণের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন করে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির স্বাধীনতা দানে কালক্ষেপ পরাধীন দেশগুলি তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ক্রমেই জোরদার করে তোলে, যার ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তাদের স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়।

কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ এতই শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল যে, তাদের উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 নতুন বিশ্বব্যবস্থা কী (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার)? তার প্রকৃত রূপ কী?

ব্রিটিশ উপনিবেশে মুক্তি আন্দোলন : ভারত ও পাকিস্তান :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক জগতে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ ছিল জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয় উনবিংশ শতকের শেষের দিকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট আন্দোলন; নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ বাহিনী ও আজাদ হিন্দ সরকার; বোম্বাই, করাচিতে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত নড়িয়ে দেয়।

সেই সঙ্গে কৃষক আন্দোলন, শিল্প ধর্মঘট পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তোলে। ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে, ভারতে আর তাদের বেশিদিন শাসন করা যাবে না। কংগ্রেস আর একটি গণ আন্দোলনের ডাক দিলেই তার ধাক্কায় ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে হবে।

এমতাকথায় ব্রিটেনের শ্রমিকদলের নেতা ক্লিমেন্ট এটলির তৎপরতায় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট ভারতকে ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করে।

ব্রহ্মদেশ :

ব্রিটিশ ভারত ছাড়ার ফলে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন শুরু হয়। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে ব্রহ্মদেশেও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়।

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন দ্বারা ব্রহ্মদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্রতর হয়।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জাপান ব্রহ্মদেশ অধিকার করে নেয়। জাপান ব্রহ্মদেশের স্বাধীনতা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে বর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় এবং তারা বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে মিত্রপক্ষকে নানাভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ জাপানের হাত থেকে ব্রহ্মের অধিকার ফিরিয়ে নেয়। এই সময় বর্মীরা পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে। ব্রিটিশ সরকার ব্রহ্মদেশ হাতে রাখা আর সম্ভব নয় ভেবে ব্রিটেনের শ্রমিকদল ব্রহ্মের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে বলে ঘোষণা করে।

এর ফলে ১৯৪৭ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রক্ষ্ম-স্বাধীনতা আইন পাশ হয়। ১৯৪৮ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে ব্রহ্মদেশ স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।

ডাচ্ উপনিবেশে মুক্তি আন্দোলন: ইন্দোনেশিয়া:

সুমাত্রা, জাভা, বালি প্রভৃতি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ছিল ডাচ্ সাম্রাজ্য, যার এখনকার নাম ইন্দোনেশিয়া। দীর্ঘদিন ধরে ডাচদের শাসনে থাকার ফলে ইন্দোনেশিয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সৃষ্টি হয় এবং ক্রমে সেখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ব্যাপক হতে, থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৪ খ্রিঃ ইন্দোনেশিয়া জাপানের দখলে চলে যায়। জাপান সুকর্নোর নেতৃত্বে সেখানে একটি সহযোগী সরকার গঠন করে এবং জাতীয়তাবাদী নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি দেয়। কিন্তু জাপানের অর্থনৈতিক শোষণ ও জোরজুলুম ইন্দোনেশিয়দের অল্প দিনের মধ্যে জাপান বিরোধী করে তোলে।

তারা জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ডাচ্ বিরোধী ও জাপান বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে জাপানের পরাজয় ঘটলে জাপান এই দেশ ছেড়ে চলে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে ইন্দোনেশিয়রা সুকর্নোর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে (১৭ই আগস্ট, ১৯৪৫ খ্রিঃ)। কিন্তু ডাচ্ সরকার এই প্রজাতন্ত্রকে স্বীকার করে নিতে পারল না।

ডাচুরা ব্রিটিশ সেনার সহযোগিতায় ইন্দোনেশিয়ায় ফিরে আসে এবং আধুনিক মারণাস্ত্রের সাহায্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকে।

শেষ পর্যন্ত মার্কিন হস্তক্ষেপ, ভারতবর্ষের তীব্র প্রতিবাদ প্রভৃতির ফলে ডাচ্ সরকার ১৯৪৯ খ্রিঃ হেগ সম্মেলনে ইন্দোনেশিয় প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়। ফলে ইন্দোনেশিয়ার ১৬টি দ্বীপ নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়।

ফরাসি উপনিবেশে মুক্তি যুদ্ধ: ইন্দোচিন বা ভিয়েতনাম:

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফরাসি উপনিবেশ ইন্দোচিন বা ভিয়েতনাম, আন্নাম, কোচিন-চিন, ক্যাম্বোডিয়া, লাওস ও টংকিং এই পাঁচটি অঞ্চলে ইন্দোচিন বিভক্ত ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইন্দোচিনের জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাওয়ার আশায় ফ্রান্সকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তা না পেলে ফ্রান্সের প্রতি তাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অল্প সময়ের মধ্যে জাপান ইন্দোচিন দখল করে নেয়। এই সময় হো-চি-মিন কমিউনিস্ট দল গঠন করে ফরাসিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় ঘটলে হো-চি-মিন ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু ফ্রান্স ইন্দোচিন ছেড়ে যেতে মোটেই রাজি হল না। ৫০ হাজার ফরাসি সেনা ইন্দোচিনে নেমে পড়ে।

কিন্তু ভিয়েতনামীরা ফেলে যাওয়া জাপানি অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা ফরাসিদের ব্যতিব্যস্ত করে তুললে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সরকার হো-চি-মিনের সঙ্গে এক চুক্তি করেন।

এই চুক্তিতে ফরাসি সরকার স্বীকার করে যে, ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু অবস্থা একটু ভালো হলে ফ্রান্স এই চুক্তি অস্বীকার করে।

তারা মার্কিন অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য নিয়ে জাতীয়তাবাদী ভিয়েতনামীদের ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। ফলে ভিয়েতনামের সঙ্গে ফরাসিদের সংঘর্ষ আবার শুরু হয়ে যায়।

ভিয়েতনামীরা তাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালায়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে দিয়েন-বিয়েন-ফু (Dien – Bien – Plut) তে ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে ভিয়েতনামীদের এক প্রবল যুদ্ধে ফরাসি বাহিনীর সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটে।

ওই বছরই জেনেভা চুক্তি দ্বারা ভিয়েতনামকে উত্তর ও দক্ষিণ-এই দুভাগে ভাগ করে হো-চি-মিনের নেতৃত্বাধীন উত্তর ভিয়েতনামকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের সংযুক্তির জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

কিন্তু ফরাসি কর্তৃত্ব শেষ হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে সেখানে নির্বাচন বন্ধ হয়। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এই যুদ্ধ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অকথ্য অত্যাচারের কাহিনিতে কলঙ্কিত। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ঘটে এবং ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনামের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment