আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সাম্যবাদী চিনের প্রভাব সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
Rate this post

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা হল চিনে গণ প্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রতিষ্ঠা। কমিউনিস্ট চিনের উত্থান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন এনেছিল।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট চিন এক নতুন মাত্রা এনেছিল। কোনোরূপ বৈদেশিক সাহায্য না নিয়ে একটি ক্লান্ত যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশকে ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী ও ভাবাদর্শগত ভাবে প্রগতিশীল রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন মাও-সে-তুং এবং নিজের সাংগঠনিক শক্তির জোরে চিন আজ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তির মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে।

সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে চিনের সম্পর্ক :

গণ প্রজাতন্ত্রী চিন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরদিনই সর্বপ্রথম সোভিয়েত রাশিয়া চিনকে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। এই নবজাত রাষ্ট্রের জন্মের পর দিন থেকে সোভিয়েত রাশিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

বিষয়গত ও আদর্শগত কারণে চিন ও সোভিয়েত রাশিয়া পরস্পরের কাছাকাছি আসে। একদিকে বিশ্বে সাম্যবাদী আন্দোলনকে সুসংহত করা, অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্যবাদ বিরোধী বেষ্টনী নীতির মোকাবিলা করার জন্য সোভিয়েত রাশিয়া চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে দুই দেশের মধ্যে ‘মিত্রতা সূচক সহযোগিতা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। তাই পরবর্তীকালে ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার বিরুদ্ধে চিনের যুদ্ধ বাধলে সোভিয়েত রাশিয়া চিনকে কূটনৈতিক সমর্থন করে ছিল।

এরপরে স্তালিন, মাও-এর সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি করেন এবং শিল্পায়ন ও সমর সজ্জার আধুনিকীকরণের প্রতিশ্রুতি দেন।

১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মস্কো চিনকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সহযোগী নেতৃত্বের স্থান দেন। এর ফলে চিন একদিকে যেমন এশীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি মস্কো ও তার সহযোগীদের বিবাদে মধ্যস্থতা করেছে।

অবশ্য চিন ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে সুসম্পর্ক রক্ষিত হয়নি। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকেই উভয়ের মধ্যে মতাবিরোধ স্পষ্ট হতে দেখা যায়।

এমনকি উভয়ের মধ্যে সংঘাত এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছয় যে, সোভিয়েত রাশিয়া চিনকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ করতে পুরোপুরি অস্বীকার করে।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের প্রতিষ্ঠায় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চিনের সম্পর্কঃ

গণতন্ত্রের পূজারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্যবাদী চিনের উত্থানের পূর্বে সেখানকার জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রধান চিয়াং-কাই-শেক-এর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে ছিল।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের আগ্রাসন ও দূর প্রাচ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারে বাধাদানের উদ্দেশ্যে চিনকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে প্রচুর অর্থ সাহায্য করে অভ্যন্তরীণ পুনগঠনের সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল।

কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সাম্যবাদী চিনের আবির্ভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিচলিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী চিন প্রতিষ্ঠার পরেও ফরমোসায় জাতীয়তাবাদী চিন সরকারের প্রতি সমর্থন রাখে এবং জাতিপুঞ্জে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের সদস্যপদ লাভের বিরোধিতা করে।

তাছাড়া সদ্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট চিনের পক্ষে কোরিয়া ও ভিয়েতনামের যুদ্ধে আমেরিকার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণের সাহসিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

তাই সংগত কারণেই চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে তিক্ততা বৃদ্ধি পায়। পাঁচের ও ছয়ের দশক জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য ছিল চিনে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান।

১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ডিন রাচ্চ মন্তব্য করেন, প্রয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের কমিউনিস্ট সরকারকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমেও উচ্ছেদ করতে দ্বিধা করবে না।

তবে চিন-মার্কিন এই তিক্ত সম্পর্ক ১৯৭০ এর পর থেকে ক্রমশ দূর হতে শুরু করে। পোল্যান্ডে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিংগার এবং ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি নিক্সন চিন সফরে এলে চিন-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।

কিছুদিনের মধ্যেই উভয় দেশের মধ্যে দূত বিনিময় হয়। মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ লাভের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে এবং কমিউনিস্ট চিন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ করে।

বস্তুত, চিন-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি উভয় দেশের আর্থিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নত পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সঙ্গে চিনের সম্পর্ক :

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি অধিকাংশই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের ওপর গণ প্রজাতন্ত্রী চিনের প্রভাব ছিল অপরিসীম। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি চিনের প্রতি বিশেষ সদয় ছিল।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই ভারত, পাকিস্তান, ব্রহ্মদেশ, শ্রীলংঙ্কা ও আফগানিস্তান, গণ প্রজাতন্ত্রী চিনকে স্বীকৃতি দেয়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ কমিউনিস্ট চিনের সঙ্গে এগিয়ে এসে বন্ধুত্ব স্থাপন করে।

চিন এশিয়া আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলির ঔপনিবেশিক বিরোধী দৃষ্টির কারণে ওই সব দেশগুলিকে একটি বিন্দুতে মিলিত করার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু চিন সহযোগিতামূলক নীতির পাশাপাশি আধিপত্যমূলক মনোভাব দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়।

কোরিয়ার ও ভিয়েতনামে চিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উত্তর কোরিয়া ও উত্তর ভিয়েতনামের গণপ্রজাতন্ত্রের পক্ষ অবলম্বন করে।

চিনের সক্রিয় প্রতিরোধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ায় দীর্ঘসূত্রী যুদ্ধ অবসানের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৬ খ্রিঃ নভেম্বরে চৌ-এন-লাই ভিয়েতনাম সফর করেন এবং ভিয়েতনামকে চিনের সদিচ্ছা ও সহযোগিতার পূর্ণ আশ্বাস দেন।

১৯৫০ থেকে ১৯৫৯ খ্রি. পর্যন্ত চিন তৃতীয় বিশ্ব তথা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা ও সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করেছিল। ১৯৫৪ খ্রিঃ জুন মাসে চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ভারত ভ্রমণে আসেন।

তিনি ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ব্রহ্মদেশ, লাওস, কম্বোডিয়াকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলেন। ভারতের পঞ্চশীল নীতিকে চিন গ্রহণ করে এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে।

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বান্দুং সম্মেলনের পর থেকে চিনের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৪ খ্রিঃ চিন আফ্রিকার মানুষের নয়া উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে সমর্থন জানায়।

আমেরিকা ও ব্রিটেনের মদতপুষ্ট ইহুদিদের নাগপাশ থেকে প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করার জন্য চিন এক ইস্তাহার পত্র প্রকাশ করলে সমগ্র আরব দুনিয়া চিনের প্রতিবাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

তবে চিন শুধু মাত্র সহযোগিতার পথ অনুসরণ করেনি, এর পাশাপাশি এশিয়ার রাজনীতিতে পেশিশক্তিরও প্রয়োগ করে। যেমন – তিব্বতের ওপর চিন বলপূর্বক আধিপত্য স্থাপন করে, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এমনকি পরবর্তীকালে ভিয়েতনাম ও লাওসের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

উপসংহার :

উপরের আলোচনা থেকে বলা যায় যে কমিউনিস্ট চিনের উত্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে, আজ ছোটো বড়ো সমস্ত প্রকার রাষ্ট্রই চিনের শক্তি সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে। মাও-সে-তুং-এর পরবর্তী কমিউনিস্ট নেতারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের উন্নতির বিষয়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশ যেমন চিনের অর্থনৈতিক বাজারের ওপর প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টা করছে, তেমনি আবার চিনও শিল্পোন্নত দেশগুলির কাছ থেকে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাই চিনা কূটনীতিবিদরা তাঁদের বিদেশ নীতিকে নমনীয় করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment