ট্রম্যান নীতির অর্থনৈতিক রূপ ছিল মার্শাল পরিকল্পনা, ট্রম্যান নীতি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত বিরোধী — বেষ্টন নীতি’কে সফল করতে অর্থনৈতিক ও সামরিক – দুটি পথ অনুসরন করেছিল। এর একটি ছিল পশ্চিম ইউরোপের আর্থিক পুনরুজ্জীবন ঘটানো ও সাম্যবাদী প্রভাব প্রতিহত করা। এজন্য গৃহিত হয় মার্শাল পরিকল্পনা।
যুদ্ধোত্তর ইউরোপ:
ট্রুম্যান নীতি ঘোষিত হওয়ার পর তার ব্যাপক প্রয়োগ হিসেবে মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। আমেরিকার পররাষ্ট্র সচিব জর্জ. সি. মার্শাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির অর্থনৈতিক বিপর্যয় স্বচক্ষে দেখে এসেছিলেন।
তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপের এই সব দেশগুলিতে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য সাহায্যদানে যদি আমেরিকা এগিয়ে না আসে তাহলে ওই সব দেশ স্বাভাবিকভাবে রাশিয়ার কাছে হাত পাতবে। ফলে ওই সব দেশে রুশ প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।
কারণ যেখানে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য সেখানেই কমিউনিজমের উদ্ভব। তাই তিনি পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেন।
মার্শাল প্ল্যান:
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে জর্জ, সি. মার্শাল আমেরিকার হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত এক ভাষণে তাঁর পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেন।
মার্শাল পশ্চিম ইউরোপে এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সুযোগে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটার আশঙ্কায় রাশিয়াসহ ইউরোপের সবকটি দেশকেই আমেরিকার কাছ থেকে অর্থ সাহায্য গ্রহণের আহ্বান জানান। মার্শালের এই ঘোষণাই ‘মার্শাল পরিকল্পনা” বা ‘মার্শাল এইড’ নামে অভিহিত।
শর্ত:
- (১) বলা হয় সাহায্য গ্রহনকারী দেশগুলি ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হবে (Organisation of European Economic Co-operation).
- (২) ইউরোপের পুনরুজ্জীবনের কর্মসূচি (European Recovery Programme) অনুযায়ী সাহায্যের অর্থ ও নিজস্বসম্পদ পরস্পরের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে
- (৩) বিশ্বের বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে অখন্ড ইউরোপীয় অর্থনীতি গড়তে হবে।
- (৪) যে সব দেশ বা দল মানুষের সমস্যা বজায় রেখে রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করতে চায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিরোধীতা করবে।
🔥আরও পড়ুনঃ-
উদ্দেশ্য:
মার্শাল ঘোষনা করেছিলেন, এটা কোন বিশেষ দেশের বিরুদ্ধে নয়, সার্বিক ভাবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হতাশা ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এই পরিকল্পনা বিশ্বে এমন এক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে, যেখানে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গুলির অস্তিত্ব সুনিশ্চিত হবে।
মার্শাল পরিকল্পনা দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল যথা—রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল যে, আমেরিকা এই পরিকল্পনার দ্বারা ইউরোপের দেশগুলিকে সাম্যবাদী রাশিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত করে নিজের প্রভাবাধীনে নিয়ে আসতে চেয়েছিল।
আর এই পরিকল্পনার অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটিয়ে সেখানে আমেরিকার উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রীর বাজার প্রস্তুত করা।
মার্শাল পরিকল্পনা রুপায়ন:
যুদ্ধোত্তর পশ্চিম ইউরোপ ছিল অর্থনৈতিক সংকটে দারুণভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। তাই ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি পশ্চিম ইউরোপের ১৬টি দেশ মার্শাল পরিকল্পনার শর্ত মেনে নিয়ে তা গ্রহণ করে।
শর্তানুসারে আমেরিকা সরকার চার বছরের জন্য ইউরোপের ওই দেশগুলিকে সব রকমের অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। তিন বছরে ওই দেশগুলি বারশ কোটি ডলার মার্কিন সাহায্য লাভ করে।
এই সাহায্যের নাম “ইউরোপীয় পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা” (European Recovery Programme)। এই সাহায্যের ফলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি প্রভৃতি দেশগুলি যুদ্ধোত্তর সংকট কাটিয়ে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা পায়।
ভূমিশয্যা থেকে উঠে পশ্চিমি গণতান্ত্রিক দেশগুলি আবার যৌবনের খর তেজে জ্বলে ওঠে। রাজনৈতিক দিক থেকে নির্বাচনে গণতান্ত্রিক দলগুলি কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়।
সাফল্য:
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দু’দিক থেকেই এই পরিকল্পনা সফল হয়েছিল। এর ফলে শিল্প উৎপাদন ২৫% বৃদ্ধি পায়। ব্রিটেনের রপ্তানী বাড়ে। পশ্চিম জার্মানির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ইউরোপে কৃষি উৎপাদন ১০% বাড়ে। ইউরোপীয় অর্থনীতিতে মন্দা কেটে যায়। জনজীবনে হতাশা দূর হয়। সাম্যবাদ প্রতিহত হয়ে মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া:
মার্শাল পরিকল্পনা আলোচনার জন্য প্যারিসে আহুত সম্মেলনে রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রী মলোটোভ যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মার্শাল পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, এই পরিকল্পনা গ্রহণ করলে সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার নষ্ট হবে।
সাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলি বাণিজ্যিক শোষণের কবলে পড়বে। তিনি এই পরিকল্পনাকে মার্কিন “ডলার সাম্রাজ্যবাদের পন্থা” বলে অভিহিত করেন। রাশিয়া ও তার পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলি মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ করতে অসম্মত হয়।
চেকোশ্লোভাকিয়া সরকার মার্শাল পরিকল্পনা অনুসারে মার্কিন অর্থ সাহায্য গ্রহণে আগ্রহ দেখালে রাশিয়া এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এই সরকার ভেঙে দিয়ে ওই দেশকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছিল।
রাশিয়া নিজের শক্তিকে অধিকতর সুসংহত করার জন্য পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলিকে নিয়ে “কমিকন” (Comecon) গঠন করে তার আওতায় রেখে কমিউনিস্ট দেশগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার ব্যবস্থা করে।
এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দ্বারা পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি প্রভৃতি দেশগুলির পুনর্গঠন করা হয়। এভাবে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে পারস্পরিক পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে উভয়ের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়, যা সাধারণভাবে ঠান্ডা লড়াই (Cold war) নামে অভিহিত হয়ে থাকে।