যুদ্ধে পরাজয়ের পর আমেরিকার ডলার সাম্রাজ্যবাদের দত্ত আর একবার চূর্ণ হল ভিয়েতনামের যুদ্ধে। বস্তুত আমেরিকার মতো আর্থিক, সামরিক সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এক শক্তির ভিয়েতনামের যুদ্ধে পরাজয় এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার।
শুধু তাই নয়, দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে চলতে থাকা এই যুদ্ধে আমেরিকার পাঁচ লক্ষ সৈন্য হতাহত হয়। বহু অর্থ নষ্ট হয়। বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন নীতি কিছু দিনের জন্য শ্লথ হয়ে পড়ে।
সমগ্র বিশ্বে ভিয়েতনামে মার্কিনি আক্রমণ শুধু সমালোচিতই হয়নি ভিয়েতনামের বিদেশ নীতি কলঙ্কিত হয়। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
তবে ভিয়েতনামের যুদ্ধে মার্কিন পরাজয়ের কারণ খুঁজতে গেলে একাধিক কারণ চোখে পড়ে। নানা কারণের সমন্বয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ঘটেছিল।
ভিয়েত কং এবং জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট -এর জনসমর্থন
প্রথমত, ভিয়েত কং এবং জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট ( NLF)-এর পেছনে বিপুল জনসমর্থন ছিল। এখানকার মানুষ দিয়েম সরকারের ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিল, কারণ তিনি সংস্কারমূলক কাজ করতে ব্যর্থ হন।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভিয়েতনামে যখন জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠিত হয়, তখন দিয়েম-বিরোধী কয়েকটি বিরোধী দলের মধ্যে কমিউনিস্টরা ছিল অন্যতম।
আমেরিকা দিয়েম সরকারের মতো অপদার্থ এবং জনবিরোধী একটি সরকারকে কমিউনিস্ট শক্তিকে প্রতিরোধ করার ব্যাপারে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে প্রকারান্তরে দক্ষিণ ভিয়েতনামে সাম্যবাদী শক্তির প্রসারে নিজেরাই সাহায্য করেছিল।
ভিয়েত কং -এর দক্ষতা
দ্বিতীয়ত, ভিয়েতমিনদের মতোই ভিয়েত কং রাও গেরিলা যুদ্ধের ব্যাপারে সমপরিমাণ দক্ষ ছিল। তারা তাদের নিজেদের পরিচিত অঞ্চলেই লড়াই করেছিল।
অথচ একটি অপরিচিত দেশে এই গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করা অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমেরিকার সৈন্যদের পক্ষে কোরিয়ার যুদ্ধের তুলনায় অনেক বেশি অসুবিধাজনক হয়েছিল।
গেরিলাদের ধ্বংস না করতে পারা
তৃতীয়ত . ভিয়েতনামীরা গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করায় আমেরিকা বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করে শুধু পীড়িত আবাল-বৃদ্ধবনিতাকে মেরেছিল, শস্যক্ষেত্র ধ্বংস করেছিল কিন্তু গেরিলাদের মারতে পারেনি। তাছাড়া মার্কিন সেনারা অতর্কিতে হানার জন্য কোনো গেরিলা প্রশিক্ষণ পায়নি।
রণকৌশল গত দক্ষতা
চতুর্থত, গেরিলা যোদ্ধাদের একটি বিশেষ ধরনের রণকৌশল হল মার্কিন সেনাদের পর্বতসঙ্কুল জনালের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে, তারপর তাদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। অনেক সময় অগ্নিবলয়ে আবদ্ধ ঘরে চক্রব্যূহে অভিমুন্যকে হত্যার মতো মার্কিন সেনাদের মারা হয়েছিল।
🔥আরও পড়ুনঃ-
চিন ও রাশিয়ার অস্ত্র সাহায্য করা
পঞ্চমত, ভিয়েত কং রা নিয়মিতভাবে উত্তর ভিয়েতনামের গেরিলা পদ্ধতিতে দক্ষ সৈন্য সাহায্য পেত এবং চিন ও রাশিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেত। বিশেষ করে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের পর এ ব্যাপারে রাশিয়ার গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।
কারণ, এসময় রাশিয়া চিনের সঙ্গে তুলনায় তো বটেই এমনকি সে নিজে আগে যে সব অস্ত্র সাহায্য দিত, তার তুলনায় এখন অনেক বেশি উন্নত ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করতে পারছিল।
অন্য সে অনেক উন্নত ধরনের অস্ত্রের সঙ্গে বিমান আক্রমণকারী আণবিক অস্ত্রও সরবরাহ করেছিল।
মার্কিন সামরিক বাহিনী ক্ষোভ ও হতাশা
ষষ্ঠত, ভিয়েতনাম যুদ্ধে শুধু মার্কিন সামরিক বাহিনী নয়, সাধারণ মার্কিন জনগণের কাছেও ভিয়েতনাম যুদ্ধ সমর্থিত হয়নি।
বৃদ্ধি পেয়েছিল মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা। কারণ দূরদর্শনের বিকাশের ফলে মানুষ একটি দেশের ধ্বংস সাধন, মানুষের কষ্ট ও নিজ দেশের সৈন্যের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছিল।
তাই বিশ্ব জনমতও এই আক্রমণের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। এতে মার্কিন সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিল।
ভিয়েতনামের মানুষের জাতীয়তাবাদ
সপ্তমত, হো-চি-মিনের প্রভাবে ভিয়েতনামের মানুষ জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ও ঐক্য চেতনায় গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।
এই ঐক্যতে কোনো মতেই ফাটল ধরানো সম্ভব ছিল না। হো-চি-মিনের প্রভাবে ভিয়েতনামের সমস্ত স্তরের মানুষ একসঙ্গে জেগে উঠেছিল নতুন দেশ ও বিশ্ব গড়ার অভীঃমন্ত্রে।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জয় এবং দেশের ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভিয়েতনামের সমস্ত মানুষ নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিল। তাই এরূপ ঐক্যবদ্ধ ধৈর্যশীল একটা জাতিকে পরাজিত করা আমেরিকার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, স্ববিরোধী ও ভ্রান্ত নীতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে আরও মলিন করেছিল, যার প্রভাবে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রকে পরাজয় স্বীকার করে ভিয়েতনাম থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল।