ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও তার ফলাফল

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
4/5 - (1 vote)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে ভিয়েতনামের যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এক অতি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে শুধু ফ্রান্সেরই পরাজয় হয়নি, মার্কিন আগ্রাসনেরও প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই ভিয়েতনামে অবিরাম যুদ্ধ চলেছিল। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দুটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভিয়েতনাম জয়ী হয়ে স্বাধীন হয়।

এই দুটি পর্যায়ের প্রথম পর্যায় ছিল ১৯৪৫ খ্রিঃ থেকে ১৯৫৪ খ্রিঃ পর্যন্ত ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় পর্যায় ছিল ১৯৬১খ্রিঃ থেকে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনামের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ও পরাজয়।

প্রথম পর্ব (১৯৪৫-১৯৫৪):

লাওস, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়া এই তিনটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ইন্দোচিন ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফরাসি উপনিবেশের অংশ বিশেষ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাওয়ার আশায় ফ্রান্সকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তা না পেলে ফ্রান্সের প্রতি তাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ফ্রান্স দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই সুযোগে ভিয়েতনামে স্থানীয় নেতা হো-চি-মিন-এর নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে।

এর আগেই ১৯৩০ খ্রি, তাঁর উদ্যোগে ‘ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দলেরই ছিল মুখ্য ভূমিকা।

হো-চি-মিন কৃষিজীবী মানুষদের সংগঠিত করে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪১ খ্রিঃ, তিনি “লিগ ফর দি ইনডিপেন্ডেন্স ইন ভিয়েতনাম’ (League for the Independence in Vietnam) গঠন করেন।

এই সংগঠনের সংক্ষিপ্ত নাম ভিয়েতমিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হাতে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটলে জাপান ভিয়েতনাম দখল করে।

ইন্দোচিনে জাপানের আবির্ভাবের সুযোগে আন্নাম এর সম্রাট বাও দাই এবং কম্বোজ ও লাওসের রাজারা নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে।

হো-চি-মিন এই সুযোগে টংকিং-এর সাতটি প্রদেশে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা সেপ্টেম্বর হো-চি-মিনের নেতৃত্বে সেখানে ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সাম্যবাদী চিনের প্রভাব সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

ফ্রান্সের সঙ্গে ভিয়েতনামের যুদ্ধের সূচনা:

পটসডাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাপানের পরাজয়ের পর ইন্দোচিনের ১৭° অক্ষরেখার উত্তরে কুয়োমিনটাং চিন এবং ১৭° অক্ষরেখার দক্ষিণে ব্রিটেন দেখা শোনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স ইন্দোচিনে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ফিরে এলে ব্রিটেন দক্ষিণ ইন্দোচিন থেকে সরে যায় এবং সেখানে ফ্রান্সের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

অপরদিকে কুয়োমিনটাং চিনও উত্তর ইন্দোচিনে হো-চি-মিনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এ সময় একটি চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স হো-চি- মিনের সরকারকে ইন্দোচিন ফেডারেশনের অংশ বিশেষ বলে মেনে নেয়।

এ সময় ভিয়েতমিনের তরফ থেকে সমস্ত ভিয়েতনামকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করা হলে, ফ্রান্স তার প্রত্যুত্তরে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর হাইফং-এ বোমা বর্ষণ করে।

এর প্রতিবাদে ভিয়েতমিনরা ফরাসি অধিকৃত টংকিং -এর ওপর আক্রমণ চালায়। এইভাবে ইন্দোচিনে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, যা দীর্ঘ আট বছর ধরে চলে।

ফরাসিরা মার্কিন অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য নিয়ে জাতীয়তাবাদী ভিয়েতনামীদের ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টায় চালায়। ভিয়েতনামীরা তাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালায়।

এদিকে নিজেদের ব্যর্থতা অনুভব করে সম্রাট বাও দাই এর নেতৃত্বে ফ্রান্স ইন্দোচিনে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার প্রতিষ্ঠা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। অন্যদিকে হো-চি-মিন প্রতিষ্ঠিত ভিয়েতনাম সরকারকে চিন সরকার স্বীকৃতি দেয়।

প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য লাভ করেও ফরাসিদের ব্যর্থতা অনিবার্য ছিল। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিক থেকে ফরাসি বাহিনী একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হতে থাকে।

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে হ্যানয় ও হাইফং ফ্রান্সের হস্তচ্যুত হয়। অবশেষে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে দিয়েন-বিয়েন ফুতে (Dien-Bien-Phu) ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে ভিয়েতনামীদের এক প্রবল যুদ্ধে ফরাসি বাহিনীর সম্পূর্ণ পরাজয় হয়।

ফরাসি সেনাপতি ভিয়েতমিন সেনাপতি গিয়াপের কাছে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে আত্মসমর্পণ করলে আট বছর ব্যাপী যুদ্ধের দ্বারা ভিয়েতনামে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের অবসান হয়।

জেনেভা সম্মেলন:

ওই বছরই জেনেভা সম্মেলনে ভিয়েতনামকে উত্তর ও দক্ষিণ দুভাগে ভাগ করে হো-চি-মিনের নেতৃত্বাধীন উত্তর ভিয়েতনামকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয় এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের সংযুক্তির জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৬১-৭৫):

১৯৫৪ থ্রি, জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে ফরাসিরা সরে গেলেও সেই স্থান দখল করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন মদতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের শাসক বাও দাইকে এক গণভোটে পদচ্যুত করে নাগো দিয়েন দিয়েম (Ngo Dien Diem) রাষ্ট্রপতি হন) দিয়েন সরকার প্রচ্ছন্ন মার্কিন প্ররোচনায় জেনেভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনামের জন্য নির্বাচন থেকে সরে আসে।

মার্কিন সরকার দিয়েম সরকারকে প্রচুর পরিমাণ আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিতে থাকে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে ৬৮৫ জন মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা আসেন।

এদিকে দিয়েম সরকার ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনের বিরোধিতা করলে ইন্দোচিনে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। ১৯৬০ খ্রিঃ ২০শে ডিসেম্বর দক্ষিণ ভিয়েতনামে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠিত হয়। দিয়েম এই গোষ্ঠীকে ভিয়েত কং (Viet Cong) নাম দেন। অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে উত্তর ভিয়েতনাম তাদের নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে।

দিয়েম সরকারের পতন:

জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের অন্যতম কর্মসূচি ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত দিয়েম সরকারের অবসান ও মার্কিন সামরিক উপদেষ্টাদের অপসারণ। এর ফলে ভিয়েতনামের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশি মাত্রায় অংশগ্রহণ করে।

১৯৬৭ খ্রিঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারসাজিতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের নির্বাচনে নাগুয়েন ডন থিউ (Naguyen Von Thieu) ও কাই কাই যথাক্রমে রাষ্ট্রপতিও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এই নতুন সরকারের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ‘ভিয়েত কং’ বাহিনী তীর আক্রমণ করে।

এদিকে ভিয়েত কংদের ওপর আক্রমণও বৃদ্ধি পায়। ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়।

১৯৬৪ এর আগস্টে টংকিং উপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনী ও ১৯৬৫-র ফেব্রুয়ারিতে প্রেকৃতে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটির ওপর উত্তর ভিয়েতনামী ও ভিয়েত কং বিপ্লবীরা আক্রমণ করেছে এই অজুহাতে মার্কিন বোমারু বিমান উত্তর ভিয়েতনামে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে।

সেই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু করল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। এদিকে ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পায় তিনগুণ।

অন্যদিকে ভিয়েত কং- এর আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে জানুয়ারি বৌদ্ধ উৎসব টেট’এর সূচনার দিন ভিয়েতক‍ বাহিনী ও উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী শুরু করে টেট অভিযান।

মার্কিন বাহিনী ডাঃ নাগ ও খে সানে তাদের সামরিক ঘাঁটি এবং হিউ ও সায়গন শহর রক্ষায় এক মরিয়া যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

কমিউনিস্টরা সুপরিকল্পিতভাবে কম্বোডিয়া ও লাওস দখল করে নেয়। সমগ্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফেলা বোমা ভাপেক্ষা অধিক বোমাবর্ষণ করা হল ইন্দোচিনে।

এই ব্যাপক বোমাবর্ষণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ধ্বংস করলেও সামরিক বিজয় প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এদিকে সমগ্র বিশ্বে ভিয়েতনামে মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ঝড় ওঠে।

এই নীতির বিরুদ্ধে আমেরিকাতেও প্রতিবাদ উঠতে থাকে। তিনবছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সন নিঃশর্তে উত্তর ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ বন্ধ করেন।

শাস্তি স্থাপন:

কমিউনিস্টদের উচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ খ্রিঃ একটি চুক্তির দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক যুদ্ধ বিরতি করে। ১৯৭৫ খ্রিঃ এর মধ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনামী বাহিনী বিধ্বস্ত হয়।

ভিয়েতনামের বিপ্লবীরা রাজধানী সায়গন অধিকার করে। এর ফলে উভয় ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ১৯৭৬ খ্রিঃ দুই ভিয়েতনামের মিলনে জন্ম নেয়, ‘সোস্যালিস্ট রিপাবলিক অফ্ ভিয়েতনাম’এর রাষ্ট্রপতি হন ফাম ভান দং।

যুদ্ধের ফলাফল:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রান্তনীতির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে এবং শেষে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেমন সুনাম নষ্ট হয় তেমনি তার অন্যান্য ক্ষয় ক্ষতিও কম হয়নি।

এই যুদ্ধে ৫৮,০০০ মার্কিন সেনা নিহত হয় এবং বহু সেনা আহত হয়। যুদ্ধের জন্য ১৬৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন নীতি কিছু দিনের জন্য শ্লথ হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে আমেরিকার মতো সমর সজ্জায় সজ্জিত বিশাল দেশ ভিয়েতনামের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় তা শুধু ভিয়েতনামীদের মুক্তি আকাঙ্খাকেই পরিতৃপ্ত করেনি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুক্তির নব জাগরণ এনেছিল।

বহু দেশকে নবশক্তিতে জেগে ওঠার প্রেরণা জুগিয়েছিল ভিয়েতনাম। সারা বিশ্বের সাম্যবাদীদের উৎসাহ করেছিল। বিভিন্ন অঞ্চলের সাম্যবাদীরা নব উদ্যমে শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment