দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মিত্রশক্তিবর্গের মধ্যে কয়েকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এইসব সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করে সমন্বয় সাধন ও ঐক্যবদ্ধভাবে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা এবং যুদ্ধের শেষে রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন সম্পর্কে পরিকল্পনা তৈরি করা। ইয়াল্টা সম্মেলনও ছিল তার অন্যতম।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিন দেশের শীর্ষ নেতা চার্চিল, রুজভেল্ট ও স্ট্যালিন রাশিয়ার ক্রিমিয়া প্রদেশে ইয়াল্টায় এক সম্মেলনে মিলিত হন।
এই সম্মেলনে আলোচ্য বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি স্থাপনে উদ্যোগ গ্রহণ এবং জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রশ্নের মীমাংসা ও পোল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ।
ঐতিহাসিক ফ্লেমিং-এর মতে, ইয়াল্টা সম্মেলনে তিন প্রধান অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে বিষয়গুলি আলোচনা করেন। কোনো রকম আদর্শবাদের ফুলঝুরি না উড়িয়ে তিন প্রধান সুস্থ মস্তিষ্কে অবস্থার মোকাবিলার পথ অনুসন্ধানের চেষ্টা করে যান।
আন্তর্জাতিক সংস্থা স্থাপনের প্রস্তাব :
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, তিন প্রধান সানফ্রান্সিসকোতে সমবেত হয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে’র একটি সনদ (charter) রচনা করবেন।
অবশ্য জার্মানির বিরুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব রাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করা হবে। সম্মেলনে জাতিপুঞ্জের গঠন সম্পর্কেও মোটামুটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ব্রিটেন, আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া ও চিনকে প্রস্তাবিত জাতিপুঞ্জের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ভিটো প্রয়োগের অধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রস্তাবে বলা হয় ব্রিটেন, ফ্রান্স, চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বৃহৎ পরাষ্ট্র প্রস্তাবিত জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করবে।
জার্মানি সম্পর্কিত শর্ত :
ইয়াল্টা সম্মেলনে জার্মানির ভবিষ্যৎও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। সম্মেলনে জার্মানি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে,
- (১) জার্মানির পতন হলে তাকে নাৎসি প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা হবে,
- (২) জার্মানিকে প্রধানত তিন মিত্রশক্তি ব্রিটেন, আমেরিকা ও রাশিয়া তিন অঞ্চলে ভাগ করে দখল করবে।
- (৩) ফ্রান্সকে জার্মানির এক-চতুর্থাংশ দেওয়া হবে।
- (৪) অনুরূপভাবে জার্মানির রাজধানী বার্লিনকেও চার ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
- (৫) চারশক্তির অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে একই প্রকার আইন ও শাসন প্রবর্তনের কথা বলা হয়।
- (৬) জার্মানির অর্থনীতি মিত্রপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে;
- (৭) জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হবে এবং উদারনৈতিক সংস্কার প্রবর্তন করা হবে এবং
- (৮) জার্মানিকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ মিত্রপক্ষকে দিতে হবে। একটি ক্ষতিপূরণ কমিশন’ ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ধার্য করবে বলে ঠিক হয়।
🔥আরও পড়ুনঃ-
পোল্যান্ড সম্পর্কিত শর্ত :
পোল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইয়াল্টা সম্মেলনে রাশিয়া এবং ব্রিটেন ও আমেরিকা ঐক্যমত্যে আসতে পারেনি। সম্মেলনে পোল্যান্ড সম্পর্কে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে,
(১) জার্মানির পতনের পর লন্ডনে ও রাশিয়ায় যে দুটি পোল সরকার সমান্তরালভাবে কাজ করে যাচ্ছিল, তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হবে। এই সরকারের তত্ত্বাবধানে পোল্যান্ডে অবাধ ও স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থায়ী সরকার গঠন করা হবে।
(২) পোল্যান্ডের পূর্ব সীমা কার্জন লাইন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে।
(৩) স্ট্যালিন পোল্যান্ডের ওডার-নিসি নদী বরাবর দাবি করেন। অবশ্য চার্চিল, রুজভেল্টের এ ব্যাপারে আপত্তি থাকায় প্রশ্নটি ভবিষ্যতের জন্য মুলতুবি রাখা হয়।
(৪) যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জার্মানির কতক অংশ পোল্যান্ডকে দেওয়া হবে।
(৫) স্ট্যালিন শর্ত রাখেন যে, নির্বাচনের মাধ্যমে পোল্যান্ডে যে সরকার গঠিত হবে তাকে রাশিয়ার গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
দূরপ্রাচ্য সম্পর্কে গোপন চুক্তি :
ইয়াল্টা সম্মেলনে এক গোপন চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়ার বিশেষ স্বার্থ স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই চুক্তিতে বলা হয়
(১) জার্মানির পতনের অব্যবহিত পরে রাশিয়া মিত্রশক্তির পক্ষে জাপানের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে যোগ দেবে। এজন্য রাশিয়াকে বর্হিমঙ্গোলিয়া দক্ষিণ শাখালিন, কিউরাইল দ্বীপপুঞ্জ ও পোর্ট আর্থার দেওয়া হবে।
(২) মাঞ্চুরিয়ায় রুশ অবস্থান স্বীকার করা হবে। তাছাড়া পূর্ব ইউরোপের জার্মান অধিকৃত রাষ্ট্রগুলিকে পুনর্গঠন করে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করা হবে বলে সম্মেলনে স্থির হয়।
গুরুত্ব :
যুদ্ধকালীন সম্মেলনগুলির মধ্যে ইয়াল্টা সম্মেলনের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। কারণ এই সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলি যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। রাশিয়ার সঙ্গে ব্রিটেন ও আমেরিকার বিভিন্ন বিষয়ে মনকষাকষি হলেও তা থেকে কোনো বড়ো রকমের সংঘাতের সৃষ্টি হয়নি।
জার্মানির ভবিষ্যৎ বা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের ব্যাপারে চার্চিল, রুজভেল্ট এবং স্ট্যালিন ঐকমত্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন।
তবে ইয়াল্টা চুক্তির পর থেকে রাশিয়া, আমেরিকা ও ব্রিটেনের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের মেঘ ঘনিয়ে উঠে। পূর্ব ইউরোপে রুমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভিয়া প্রভৃতি দেশগুলিতে রাশিয়ার প্রাধান্য স্বীকৃত হয়।