গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের প্রতিষ্ঠায় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা

WhatsApp Group (Join Now) Join Now
Telegram Group (Join Now) Join Now
Rate this post

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবরে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের অভ্যুদয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগের একটা যুগান্তকারী ঘটনা। একদিকে সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপশাসন, অন্যদিকে বৈদেশিক শক্তিগুলির শোষণ-এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে চিনে দফায় দফায় বিপ্লবের ঘটনা ঘটে।

অবশেষে মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করে সমস্ত রকম শোষণ, অত্যাচারের অবসান ঘটায়।

চিনা কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা :

চিনে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন, উচ্চশিক্ষা লাভের সঙ্গে চিনা ছাত্রদের বিদেশে গমন প্রভৃতির ফলে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রাদর্শের সঙ্গেও চিন পরিচিত হয়।

মার্কসবাদের সঙ্গেও চিনের ছাত্র সমাজ পরিচিত হয়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য চিনের বুদ্ধিজীবীদের মার্কসবাদের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছিল।

ইতিমধ্যে চিনের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে গোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। শেষে ১৯২১ খ্রিঃ ১ জুলাই সাংহাইয়ে এই সব বিভিন্ন গোষ্ঠীর এক কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবং এই সম্মেলনে মার্কসবাদী অধ্যাপক লি-তা-চাও এবং চেন- তু-এর উদ্যোগে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়।

মাও-সে-তুং চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নিযুক্ত হন। পার্টির কর্মসুচিতে বলা হয় যে, কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান লক্ষ্য হল—

  • (১) চিন থেকে বিদেশি শক্তি বিতাড়ন,
  • (২) চিনের সমর নায়কদের উচ্ছেদ, এবং
  • (৩) জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা।

কুও-মিন-তাং ও কমিউনিস্ট বিরোধ :

এ সময় ড. সান-ইয়াৎ-সেন ছিলেন কুয়ো-মিনতাং দলের প্রধান এবং চিন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি । তিনি শুধু কমিউনিস্ট পার্টি নন রাশিয়ার সঙ্গেও সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন।

বহু কমিউনিস্ট কুয়ো মিন তাং দলের সদস্য পদও লাভ করেছিলেন। ফলে বামপন্থী গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়। রুশ উপদেষ্টা বোরোদিনের পরামর্শে সান-ইয়াৎ-সেন কুও-মিন- তাং দলকে পুনর্গঠিত করেন।

কুয়ো-মিন-তাং দলের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে কমিউনিস্টরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে। ১৯২৫ খ্রি, সান ইয়াৎ সেনের মৃত্যু হলে চিয়াং-কাই-শেক, কুও-মিন-তাং দলের এবং সরকারের প্রধান হন।

রাশিয়া ও চিনা কমিউনিস্টদের সহযোগিতায় তিনি উত্তর চিনের সমর নায়কদের পরাজিত করে উত্তর চিনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেন।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি উত্তর চিনের পিকিং দখল করলে সমগ্র চিন ঐক্যবদ্ধ হয়। এই ঐক্যবদ্ধে চিনের রাজধানী হয় নানকিং।

কিন্তু ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কুয়ো-মিনতাং ও কমিউনিস্ট সুসম্পর্ক হ্রাস পেতে থাকে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে চিয়াং সাম্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

দক্ষিণপন্থীদের প্ররোচনায় চিয়াং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এমনকি বহু শ্রমিক ও কমিউনিস্টদের হত্যা করান।

🔥আরও পড়ুনঃ-

👉 ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমাজতন্ত্রবাদী শক্তিগুলির সাফল্য সংক্ষেপে বিবৃত করো।

চিনে গৃহযুদ্ধের সূচনা :

এই অবস্থায় মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা শহর থেকে ঘরে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ মনোনিবেশ করে। মাও’এর নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা কিয়াংসি প্রদেশে তাদের প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে।

মাও-সে-তুং ও চু-তে কৃষকদের নিয়ে কিয়াংসিতে ‘লাল ফৌজ’ গঠন করেন। ব্রিটিশ, আমেরিকা ও জাপানি সৈন্যের সাহায্য নিয়ে চিয়াং-কাই-শেক কমিউনিস্টদের দমনের চেষ্টা করলে চিনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

লং মার্চ :

চিনে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের সুযোগে জাপান চিনের সমৃদ্ধ অঞ্চল মাঞ্চুরিয়া দখল করে জোহান অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপন করে।

এ সময় জাপানি আগ্রাসন প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা না করে চিয়াং কমিউনিস্ট নিধন যজ্ঞে মেতে ওঠেন। কুয়ো-মিন-তাং দল কমিউনিস্টদের প্রধান ঘাঁটি কিয়াংসি অবরোধ করে (১৯৩৪ খ্রিঃ)।

এই অকথায় ১৯৩৪ খ্রীঃ ১৬ই অক্টোবর মাও-সে-তুং তার আত্মীয়- স্বজন সহ প্রায় ১ লক্ষ কমিউনিস্ট নেতাকে নিয়ে সরকারি অবরোধ অগ্রাহ্য করে ৬,০০০ মাইল পথ অতিক্রম করে দক্ষিণ-চিন থেকে উত্তর-পশ্চিম চিনের পর্বতসঙ্কুল শেনসি প্রদেশে উপস্থিত হন (১৯৩৫খ্রিঃ, ২০ শে অক্টোবর)।

চিনের ইতিহাসে এটিই বিখ্যাত লিং মার্চ’ বা ‘দীর্ঘ পদযাত্রা’ নামে পরিচিত। এই ঐতিহাসিক পদযাত্রার মধ্য দিয়ে মাও-সে-তুং কমিউনিস্টদের কাছে সুযোগ্য নেতার মর্যাদা পান। চিনা কমিউনিস্টরা এর পর থেকে অনেক বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন।

সিয়াং-ফু ঘটনা :

অন্যদিকে চিয়াং-কাই-শেক কমিউনিস্টদের পশ্চাদ্ধাবন করে শেনসি প্রদেশে সৈন্য পাঠান। মাও-সে-তুং শেনসিতে একটি অর্ধ-স্বাধীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গঠন করেন এবং এর রাজধানী হয় সিয়াং-ফু।

১৯৩৬ খ্রিঃ চিয়াং-কাই-শেক নিজেই সিয়াং ফুতে এলে কমিউনিস্ট নেতা চ্যাং-শিউ-লিয়াং তাঁকে অপহরণ করেন (১২ই ডিসেম্বর)। অবশ্য বুশ হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি পান (২৫শে ডিসেম্বর)।

এরপর তিনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে একযোগে জাপানি আক্রমণের মোকাবিলায় সম্মত হন। এই ঘটনা ‘সিয়াং-ফু’ ঘটনা নামে খ্যাত।

২৯ মাও-সে-তুং ও চিনা-প্রজাতন্ত্র ঃ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাপান পুনরায় চিনের ওপর আক্রমণ করে চিনের বহু স্থান দখল করে নেয়।

কুয়ো-মিন-তাং ও মাও-সে-তুং-এর কমিউনিস্ট দলের সেনারা মিলিতভাবে জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ করে। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণ করলে প্রাধান্য লাভের প্রশ্নে দুইদলের মধ্যে আবার সংঘাত বাধে।

মাও-সে-তুং একে একে বহু চিনা ভূখণ্ড দখল করতে থাকলে কুয়ো-মিন তাং দলের সঙ্গে তাঁর দলের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত চিয়াং কাই-শেক ও তাঁর অনুগামীরা পরাজিত হয়ে ফরমোজা বা তাইওয়ান দ্বীপে আশ্রয় নেন।

এখানে তাঁরা জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। আর মাও-সে-তুং তাঁর বিজিত অঞ্চলগুলিকে নিয়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা অক্টোবর পিকিং-এ চিনের গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠন করেন।

এই সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন চৌ এন-লাই এবং রাষ্ট্রপতি হন মাও-সে-তুং। এইভাবে চিনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে এবং শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও পুনর্গঠনের পর্ব।

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায়, সুসংহত আধুনিক চিনের বিকাশে মাও-সে-তুং এর ভূমিকা ছিল অভূতপূর্ব। তিনি চিনাবাসীদের ঐক্যবদ্ধ মুক্তি সংগ্রামের যে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন তারই পরিণতিতে সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত নতুন প্রজাতান্ত্রিক চিনের জন্ম হয়।

১৯১৯ খ্রি. ৪ঠা মে অন্দোলনের মধ্য দিয়ে চিনের ইতিহাসে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় তার পরিসমাপ্তি ঘটল ১৯৪৯ এর ১লা অক্টোবর গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকারের গঠনের মধ্য দিয়ে।

ওই দিন মাও-সে-তুং এক ভাষণে বলেন যে, চিনের মানুষ আর কখনো দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে না বা কোনো প্রকার বিদেশি হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবে না। এরপর শুরু হল এক নতুন যুগের ইতিহাস, যা সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রগতির ইতিহাস।

Hey, My Name is Priyanka From Diamond Harbour, West Bengal & I Have Been Blogging Since 3 Years Ago. I Have 10+ Websites Which I Manage by Myself. I completed my graduation in philosophy.

Leave a Comment